জীবনের অনেকক্ষেত্রে আমরা আপোষ করি। কখনও জীবিকা, কখনও ব্যক্তিগত জীবনে চলে সেই আপোষ। কারণ, স্রোতের বিপরীতে চলা শুধু কঠিন নয়, অনেক সময় অসম্ভবও। ‘একটু আপোষ করলে যখন সবকিছু পানির মতো সহজ হয়ে যায়, তখন অসুবিধা কোথায়?’- এই ভাবনা নিয়েই আমরা বেড়ে উঠি। আমাদের এ ধরনের চিন্তায় সজোরে ধাক্কা দেয় রেহানা। একটা দীর্ঘশ্বাস, তীব্র স্নায়ুচাপ ও একরাশ প্রশ্ন নিয়ে দর্শক দেখছেন রেহানা মরিয়ম নূর।
তাই মুক্তির চতুর্থ সপ্তাহে এসেও নিজের অবস্থানে অনড় রয়েছে কান-মাতানো বাংলাদেশের ছবি ‘রেহানা মরিয়ম নূর’।
রেহানা কেমন?
অভিনেত্রী আজমেরী হক বাঁধনকে এ ছবিতে বাঁধন মনে হয়নি। মনে হয়েছে জীবনযাতনায় এলোমেলো রেহানাই। একটা অস্থির রোলার কোস্টারের গতিতে ছুটছে তার জীবন। বেকার ভাই, অবসরপ্রাপ্ত বাবা, প্রথম শ্রেণিতে পড়ুয়া মেয়েকে স্কুল থেকে আনা–নেওয়া, চাকরি—সব সামাল দেওয়া সিঙ্গেল মা রেহানাকে করে তুলছিল আরও অস্থির।
রেহানার এই অস্থিরতার কারণ তিনি ‘সাধারণ’ কোন মানুষ নন। সিনেমা দেখার পর প্রশ্ন আসতেই পারে, কেন একজন শিক্ষক তার শিক্ষার্থীর জন্য এতটা করছেন?
এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হলে যেতে হবে গভীরে। রেহানা লড়াই ও দায়িত্বশীলতার প্রতীক। আজ আমরা হরহামেশা স্বার্থপরতার খেলা দেখি। সমাজে প্রতিনিয়ত ঘটে যাওয়া অন্যায় তো আছেই, আমাদের চারপাশেও কত অন্যায় ঘটে যায় যেগুলো আমরা দেখেও না দেখার ভান করে থাকি। ‘নিজে বাঁচলে বাপের নাম’- এটা আমাদের মগজে ঢুকে গেছে। সেখানে রেহানা আমাদের কাছে বড় বার্তা দিয়ে গেছেন।
লড়াই করার পথ সহজ না হলেও দিনশেষে লড়াই করেই মাথা উঁচু রাখতে হয়। রেহানা যেমন তার মেয়ের শারীরিক নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছেন, তেমনি ছাত্রীর পাশেও দাঁড়িয়েছেন। ছাত্রী যখন তার সহকর্মী দ্বারা যৌন হয়রানির শিকার হয়েছিল তখন রেহানাই সেই ছাত্রীর দিকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছে।
রেহানা `নীতি'র জায়গা
রেহানা মরিয়ম নূর নীতিবান মানুষের গল্প। রেহানা যেন মধ্যবিত্ত কিংবা নিম্নমধ্যবিত্ত নারীর প্রতীক যিনি পরিশ্রম করে আয় করেন। খারাপ পথে গিয়ে নিজের আদর্শকে বিসর্জন দেন না।
রেহানা খুবই অপরিচিত এক মানুষ। এ ধরনের মানুষ আমরা দেখতে পাই না। শেষ পর্যন্ত অন্যায়ের কাছে মাথা নত না করা সৈনিক এক।
প্রচলিত সমালোচনা
ক্যামেরাটা কাঁপছিল সারাক্ষণ। আসলে এটা দ্বারা নির্মাতা বোঝাতে চেয়েছেন রেহানার ভেতরের অস্থিরতা। অনেকেই বলেছেন রেহানার চোয়াল শক্ত কেন কিংবা ফোঁসফোঁস করছেন কেন?
ন্যায়বিচার ও সমতার জন্য যে নারী এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজে লড়াই করছেন তার মুখাবয়ব এমনই হবে। আমরা জানি, প্রতিবাদের ভাষা কখনও নরম হয় না। তবে এখানে একটি কথা না বললেই নয়, রেহানার জায়গায় একজন পুরুষ হলে এই প্রসঙ্গে আলোচনা হতো না। তখন দর্শক ভেবেই নিত, পুরুষরা একটুআধটু রাগ করবে। মুখের চোয়াল শক্ত রাখবে। কিন্তু নারীকে আমরা সহজ ও কোমল দেখতেই অভ্যস্ত। নারীর রূঢ় মুর্তি সমাজের চোখে ভালো লাগে না।
অনেকেই বলছেন, রেহানা তার বাচ্চার প্রতি যত্নশীল না। অথচ সিনেমায় অনেক জায়গায় দেখা গেছে রেহানা তার বাচ্চাকে খাওয়াচ্ছেন, মেডিকেলে নিয়ে আসেন এবং তাকে সময় দেন। স্কুলে নিয়ে যান। এ প্রেক্ষিতে প্রশ্ন রেখেই যেতে হয়, যারা কর্মজীবী নারী তারা সন্তানকে আর কীভাবে সময় দিলে দর্শকের কাছে রেহানা গ্রহণযোগ্যতা পেত?
সিনেমার একেবারে শেষে যখন রেহানা তার শিশুকে স্কুলের অনুষ্ঠানে যেতে দেননি তখন অনেকেই বলেছেন এতে শিশু অধিকার হরণ করা হয়েছে। অথচ একটু খেয়াল করলেই বোঝা যায়, রেহানা তার মেয়েকেও শেখালেন অন্যায় মেনে না নিতে। অন্যায়ের সঙ্গে আপোষ করে শুধু মেয়ের জেদ প্রাধান্য দেয়ার মতো মানুষ রেহানা নন। এ কথাটি আমরা তখনই বুঝতে পারবো যখন রেহানার দূরদর্শিতা, আদর্শ আর লড়াইয়ের জায়গা উপলব্ধি করতে পারবো।
কম্পোজিশন
চলচ্চিত্র নির্মাতা দেখাতে চেয়েছেন, রেহানার মধ্যে যে রিয়াকশন সেটা কম্পোজিশনেও আনতে। রেহানার বোরকা, ওড়নায় ঢাকা মাথা, আবহে আজানের ধ্বনি, রেহানার নামাজ পড়ার দৃশ্যে হঠাৎ হঠাৎ মনে হতেই পারে, ইরান নয়তো তুরস্কের ছবি। একটা নীলাভ অন্ধকার পুরো গল্পটাকে বাস্তবতা থেকে যতবারই দূরে সরিয়ে দিচ্ছিল, রেহানার ভাষাভঙ্গি ততবারই টেনে নিয়ে আসছিল ঘরের পরিবেশে, যেন প্রতিবেশী মেয়েটা।
নাচ, গান, কুস্তি, খিস্তির সিনেমায় অভ্যস্ত দর্শকের ছবি নয় ‘রেহানা মরিয়ম নূর’। খুব বিনোদন যে পাওয়া যাবে, তা–ও নয়। কিছু ঘুমন্ত প্রশ্নের ঘুম ভেঙে দেবে। প্রতিবাদ ও এর মাত্রার শেষ যাত্রা দেখিয়ে দেবে। ছবিজুড়েই যেন ছড়িয়ে রয়েছে সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম বার্তা। সর্বোপরি সিস্টেমের কাছে নতি স্বীকার না করার গল্পই রেহানা মরিয়ম নূর।