ফেব্রুয়ারি ১২, ২০২২, ০৪:৪৬ পিএম
বাংলা সাহিত্যে এমন লেখকও আছেন যারা লিখেছেন কম, কিন্তু তার প্রভাব ছিল সুদুরপ্রসারী। আখতারুজ্জামান ইলিয়াস সেই স্বল্পদেরই একজন। তিনি জীবনের অস্তিত্ব নিয়ে কথা বলা কথাসাহিত্যিক। তার লেখা উপন্যাস ‘খোয়াবনামা’ ও ‘চিলেকোঠার সেপাই’ বাংলা সাহিত্যের দ্রুপদী সম্পদ। তার সম্পর্কে ভারতের জ্ঞানপীঠ জয়ী বিখ্যাত আরেক কথাসাহিত্যিক মহাশ্বেতা দেবী যেমনটা বলেছিলেন, "কী পশ্চিমবাংলা, কী বাংলাদেশ— সবটা মেলালে তিনি শ্রেষ্ঠ লেখক।.... ইলিয়াসের পায়ের নখের তুল্য কিছু লিখতে পারলে আমি ধন্য হতাম।"
স্বল্পপ্রজ লেখক আখতারুজ্জামান মোহাম্মদ ইলিয়াস ১৯৪৩ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশের গাইবান্ধা জেলার গোটিয়া গ্রামে মামার বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। তার ডাক নাম মঞ্জু। পৈত্রিক বাড়ি বগুড়া জেলায়। বাবা বদিউজ্জামান মোহাম্মদ ইলিয়াস পূর্ব বাংলা প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য (১৯৪৭-১৯৫৩) এবং মুসলিম লীগে পার্লামেন্টারি সেক্রেটারি ছিলেন। তার মায়ের নাম বেগম মরিয়ম ইলিয়াস।
ইলিয়াস বগুড়া জিলা স্কুল থেকে ১৯৫৮ সালে ম্যাট্রিকুলেশন ও ঢাকা কলেজ থেকে ১৯৬০ সালে ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় অনার্স ও মাস্টার্স পাস করেন।
ইলিয়াস কর্মজীবন শুরু করেন জগন্নাথ কলেজে প্রভাষক পদে যোগদানের মাধ্যমে। এরপর তিনি মিউজিক কলেজের উপাধ্যক্ষ, প্রাইমারি শিক্ষা বোর্ডের উপ-পরিচালক, ঢাকা কলেজের বাংলার প্রফেসর ও বিভাগীয় প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি মফিজউদ্দিন শিক্ষা কমিশনের সদস্য ছিলেন।
১৯৭৩ সালে তিনি বিয়ে করেন। তার স্ত্রীর নাম সুরাইয়া তুতুল। ইলিয়াস মুক্তিযুদ্ধের সময় পরিচিত মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দেন, গোপনে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন। তার বিভিন্ন লেখায় মুক্তিযুদ্ধ এসেছে। যেমন ‘প্রতিশোধ’, ‘অন্য ঘরে অন্য স্বর’, ‘খোঁয়ারি’, ‘মিলির হাতে স্টেনগান’, ‘অপঘাত’, ‘জাল স্বপ্ন স্বপ্নের জাল’, ‘রেইনকোট’ প্রভৃতি গল্পে পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষভাবে উঠে এসেছে মুক্তিযুদ্ধ ও যুদ্ধপরবর্তী রাজনৈতিক এবং সামাজিক বাস্তবতার কাহিনী।
খুব কমই লিখতেন ইলিয়াস। কিন্তু যা লিখতেন তার সাহিত্যমান তাকে বাংলা সাহিত্যে অনন্য এক উচ্চতায় নিয়ে গেছে। ইলিয়াস জীবনের গভীরের অতলস্পর্শী গল্প বলেছেন। তিনি পাঠককে নিয়ে গেছেন ব্যক্তিসত্তার অতল গভীরে। বাস্তবতার নিপুণ চিত্রণ, ইতিহাস ও রাজনৈতিক জ্ঞান, গভীর অন্তর্দৃষ্টি ও সূক্ষ্ম কৌতুকবোধ ইলিয়াসের রচনাকে দিয়েছে ব্যতিক্রমী সুষমা।
দুটি উপন্যাস, গোটা পাঁচেক গল্পগ্রন্থ আর একটি প্রবন্ধ সংকলন নিয়ে ইলিয়াসের রচনাসম্ভার। বাংলা সাহিত্যে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর পরেই তিনি সর্বাধিক প্রশংসিত বাংলাদেশি লেখক। তার লেখা উপন্যাস ‘খোয়াবনামা’ ও ‘চিলেকোঠার সেপাই’ বাংলা সাহিত্যের এপিক। বয়ান ভঙ্গি, চরিত্রচিত্রণ, সমকালকে জীবন্ত করে তোলার বৈশিষ্ট্য নিয়ে তার উপন্যাস দুটি বাংলা সাহিত্যে অন্য সব উপন্যাস থেকে আলাদা সাহিত্যরসের সন্ধান দিয়েছে।
ইলিয়াস বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক সংগঠন বাংলাদেশ লেখক শিবিরের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তার উল্লেখযোগ্য রচনাগুলো হলো উপন্যাস- ‘চিলেকোঠার সেপাই’, ‘খোয়াবনামা’। ছোট গল্প সংকলন: ‘অন্য ঘরে অন্য স্বর’, ‘খোঁয়ারি’, ‘দুধভাতে উৎপাত’, ‘দোজখের ওম’ ও ‘জাল স্বপ্ন, স্বপ্নের জাল’। প্রবন্ধ সংকলনের মধ্যে রয়েছে ‘সংস্কৃতির ভাঙ্গা সেতু’।
ইলিয়াস সাহিত্যে নিজের কাজের স্বীকৃতি হিসেবে পেয়েছেন বেশ কয়েকটি পুরস্কার। এর মধ্যে রয়েছে ১৯৭৭ সালে হুমায়ুন কবির স্মৃতি পুরস্কার, ১৯৮৩ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার, ১৯৮৭ সালে আলাওল সাহিত্য পুরস্কার, ১৯৯৬ সালে আনন্দ পুরস্কার, সাদাত আলী আখন্দ পুরস্কার, কাজী মাহবুবুল্লাহ স্বর্ণপদক ও ১৯৯৯ সালে মরণোত্তর একুশে পদক।
ইলিয়াসের কিছু কাজ অন্য ভাষায় অনূদিত হয়েছে। তাছাড়া তার গল্প অবলম্বনে নির্মিত হয়েছে চলচ্চিত্র। ইলিয়াস সম্পর্কে পশ্চিমবঙ্গের প্রখ্যাত সাহিত্যিক মহাশ্বেতা দেবী বলেছিলেন, ‘কী পশ্চিম বাংলা, কী বাংলাদেশ সবটা মেলালে তিনি শ্রেষ্ঠ লেখক।’
আর ইলিয়াসের কাজ সম্পর্কে কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হক বলেছেন, ‘ইলিয়াসের উপন্যাস প্রকৃতপক্ষেই বিশ্বমানের, নোবেল পুরস্কার পেয়ে থাকেন যেসব কথাসাহিত্যিক, তিনি ছিলেন সেই মাপের লেখক।’
আখতারুজ্জামান ইলিয়াস সারা জীবন লড়াই করেছেন ডায়াবেটিস, জন্ডিসসহ নানাবিধ রোগের সঙ্গে। ১৯৯৭ সালের ৪ জানুয়ারি আখতারুজ্জামান ইলিয়াস ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে ঢাকা কমিউনিটি হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন।