ক্রিকেটার হওয়ার স্বপ্নে বিভোর লিমন যেভাবে আরাভের ফাঁদে জেলে যান

দ্য রিপোর্ট ডেস্ক

মার্চ ১৮, ২০২৩, ০১:৪৩ পিএম

ক্রিকেটার হওয়ার স্বপ্নে বিভোর লিমন যেভাবে আরাভের ফাঁদে জেলে যান

আসামি না হয়েও একটি খুনের মামলায় স্বেচ্ছায় জেলে যান চাঁদপুরের কচুয়ার এক যুবক। আজ থেকে চার বছর আগে ক্রিকেটার হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে ঢাকায় এসেছিলেন তিনি। তার নাম আবু ইউসুফ ওরফে লিমন (২১)। এই লিমনকেই প্রলোভন দিয়ে পুলিশ হত্যা মামলার আসামী হিসেবে রবিউল ইসলাম ওরফের আরাভ খান তাকে প্রক্সি দেওয়ান। আরাভ খান ওরফে রবিউল ইসলাম এখন টক অব দ্য কান্ট্রি। তারই জুয়েলারি শপ উদ্বোধন করতে দুবাই গিয়েছিলেন ক্রিকেটার সাকিব আল হাসানসহ আরও অনেক তারকা।

জানা যাচ্ছে, মিরপুরের সিটি ক্লাব মাঠে প্রশিক্ষণ নিতেন ক্রিকেটার হওয়ার স্বপ্নে বিভোর আবু ইউসুফ লিমন। ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে নিখোঁজ হন তিনি। খোঁজ না পেয়ে গত ২০২১ সালের ১৪ জানুয়ারি কচুয়া থানায় ডায়েরি করেন তার বাবা। কিছুদিন পর জানতে পারেন একটি হত্যা মামলায় তার ছেলে লিমন কাশিমপুর কারাগারে জেল খাটছেন।

আরাভ বিকেএসপিতে খেলার সুযোগ করে দেবে বলে ইউসুফের আইডিকার্ড-সার্টিফিকেটসহ বিভিন্ন কাগজপত্র তখন নিয়ে নেয়। লিমন এখন জামিনে আছেন। অপরদিকে, হত্যার অভিযোগ থাকলেও দেশ থেকে পালিয়ে দুবাইয়ে স্বর্ণের ব্যবসা করছেন আরাভ খান।

এ ঘটনা নিয়ে দেশজুড়ে চলছে আলোচনা-সমালোচনা। এতদিন চুপ থাকলেও আরাভ খানের বিষয়ে অবশেষে মুখ খুলেছে আবু ইউসুফের পরিবার। দ্য ডেইলি স্টারের সঙ্গে আলাপচারিতায় তারা জানিয়েছেন অনেক কিছু।

চাঁদপুরের কচুয়া থানার সিংগাড্ডা পোস্ট অফিসের অধীন আইনপুর গ্রামের মো. নুরুজ্জামান ও হালিমা বেগম দম্পতির এক ছেলে ও দুই মেয়ে। আবু ইউসুফ লিমন (২২) বড়। নুরুজ্জামান কচুয়া স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চাকরি করেন।

ইউসুফের মা হালিমা বেগম গণমাধ্যমকে বলেন, ২০১৬ সালে এসএসসি পাশের পর আবু ইউসুফকে কুমিল্লার ঠাকুরপাড়ার ম্যাটস-এ মেডিকেল অ্যাসিস্ট্যান্ট কোর্সে ভর্তি করানো হয়। ৩ বছর পড়ার পর সে ফাইনাল ইয়ারের পরীক্ষা না দিয়ে ক্রিকেট খেলতে ঢাকায় চলে যায়। এ নিয়ে বাবা ও আমাদের সঙ্গে তার মনোমালিন্য হয়। একসময় বাবা তার খরচ চালানো বন্ধ করে দেয়।

ঢাকায় গিয়ে আবু ইউসুফ ক্রিকেট খেলার জন্য ভালো সুযোগ খুঁজতে থাকে। সেখানে আরাভের সাথে ওর যোগাযোগ হয়। আরাভ বিকেএসপিতে খেলার সুযোগ করে দেবে বলে ইউসুফের আইডিকার্ড-সার্টিফিকেটসহ বিভিন্ন কাগজপত্র নেয়। পরে কাগজপত্র হাতে পেয়ে আরাভ ভয়-ভীতি প্রদর্শন করে তার মামলায় ইউসুফকে জেলে যেতে বাধ্য করে।

ইউসুফের মা বলেন, প্রলোভনে পড়ে ইউসুফ জেলে গেলেও পরিবারের কাছে বিষয়টি গোপন রাখে। এরমধ্যে আরাভ একদিন ইউসুফের বাবাকে ফোন করে জানায়, সে ইউসুফকে বিকেএসপিতে ট্রেনিংয়ে পাঠিয়েছে। ইউসুফের খেলাধুলার সমস্ত দায়িত্ব তার।

তিনি আরও বলেন, ইউসুফকে দেড় মাসের মধ্যে জেল থেকে বের করার আশ্বাস দিয়েছিল আরাভ। ৩ মাসেও বের করতে না পারায় বাসায় ফোন করে সব ঘটনা খুলে বলে ইউসুফ। কান্নাকাটি করে।

ইউসুফের বাবা নুরুজ্জামান বলেন, ইউসুফ ৩ মাস জেলে থাকার পর জানতে পেরেছি। এরপর তার জামিন পেতে আরও ৬ মাস লেগেছে। মোট ৯ মাস সে জেল খেটেছে। ওই মামলায় ছেলেকে জামিনে আনতে গিয়ে অনেক ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন।

ভুক্তভোগী আবু ইউসুফ লিমন বলেন, ফেসবুক সূত্রে আরাভের সাথে পরিচয়। ভালো জায়গায় ক্রিকেট খেলার সুযোগ পেতে আমার একটু সাপোর্টের প্রয়োজন ছিল। বাড়ি থেকে সাপোর্ট না পাওয়ায় আমি কাজ খুঁজছিলাম। আরাভকে ফেসবুকে আমার ক্রিকেটের প্রতি আগ্রহের কথা জানাই। পাশাপাশি টাকা-পয়সার সাপোর্ট নেই, এসব বলি।

করোনাকালীন সময়ে আরাভের সঙ্গে ফেসবুকে আরও কথা হয়। সে জানায়, দেশে আসলে আমার সব ব্যবস্থা করে দেবে। একটা ভালো দলে খেলার পাশাপাশি সাকিব আল হাসানের সাথে খেলার সুযোগ করে দেবে, কিন্তু মামলার কারণে সে দেশে আসতে পারছে না। আরাভ আমাকে অনুরোধ করে তার হয়ে আদালতে গিয়ে কাস্টডিতে গেলে সে আমাকে দেড় মাসের মধ্যে জামিনে মুক্ত করবে। আমার ক্রিকেট খেলার ব্যবস্থা করে দেবে। একসময় আমি তার প্রস্তাবে রাজি হয়ে যাই', যোগ করেন ইউসুফ লিমন।

ইউসুফ বলেন, ২০২০ সালের ২০ অক্টোবর আরাভের কথা মতো আমি ঢাকা মুখ্য মহানগর আদালতে যাই। কী এক কারণে সে দিনের পরদিন আমি আরাভের পরিচয়ে আদালতে আত্মসমর্পণ করি।

জেলে যাওয়ার পর একাধিকবার আমার জামিনের চেষ্টা ব্যর্থ হয়। এসময় আরাভ আস্বস্ত করে যে, ১৬ ডিসেম্বরের আগেই জামিনের ব্যবস্থা করবে। এরপর ডিসেম্বরেও সে আমার জামিন করাতে ব্যর্থ হয়, যোগ করেন তিনি।

ইউসুফ বলেন, আমাকে তখন কাশিমপুর জেলে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। সেখানে এই মামলার অন্য আসামিদের সঙ্গে কথা হয়। পরে আমি পরিবারের সাথে যোগাযোগ করি।

আরাভ অনেক ক্ষমতাশালী— উল্লেখ করে ইউসুফ বলেন, আমার মতো অনেক তরুণ ছেলে আরাভের ভক্ত। আমার যেহেতু আর্থিক সামর্থ্য নেই, আমি চাই না আরাভের সাথে কোনো দ্বন্দ্বে জড়াতে। সে চাইলে আমার আরও অনেক ক্ষতি করতে পারে।

ইউসুফ লিমন ও তার পরিবারের দাবি, কোনো টাকাপয়সার জন্য নয়, শুধু ভালো দলে খেলার সুযোগ পেতেই আরাভের হয়ে হাজতে গিয়েছিল  আবু ইউসুফ লিমন।

Link copied!