জওয়ানরা উল্লাস করছিলো কে কয়জনকে মেরেছে!

দ্য রিপোর্ট ডেস্ক

ফেব্রুয়ারি ২৫, ২০২১, ০৩:৫০ পিএম

জওয়ানরা উল্লাস করছিলো কে কয়জনকে মেরেছে!

২০০৯ সালের ২৫ ও ২৬শে ফেব্রুয়ারি ঢাকার পিলখানায় বিদ্রোহের নামে যে নৃশংস সেনা হত্যাযজ্ঞ হয় সেদিন পিলখানার ভেতরে আটকা পড়েছিলেন অনেকে। তখন ৯ম শ্রেণীর ছাত্রী ফাবলিহা বুশরা তাদেরই একজন। তার বাবা তৎকালীন বিডিআর হাসপাতালের মনোরোগ বিশেষজ্ঞ লেফটেন্যান্ট কর্নেল লুৎফর রহমান খানও ওইদিন জওয়ানদের হাতে খুন হন।

সেদিন হত্যাযজ্ঞ চালাকালে ৩৬ ঘণ্টারও বেশি সময় পিলখানা কোয়ার্টার গার্ডে জিম্মি ছিলেন বুশরা ও তার পরিবারের সদস্যরা। ওই ঘটনার ৯ বছর ২০১৮ সালে ওই হৃদয়বিদারক ঘটনার ভয়াল স্মৃতি বিবিসিকে দেয়া এক সাক্ষাতকারে তুলে ধরেন ফাবলিহা বুশরা।

বুশরা বলেন, ‘সেদিন যারা ভেতরে ছিলাম আমরা কোনো বিদ্রোহ দেখিনি। কোনো অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া দেখিনি। আমরা মানুষ মারার পর জওয়ানদের উল্লাস দেখেছি। আমরা মানুষকে নির্যাতন করা দেখেছি।’

বুশরার চোখে দেখা সেদিনের ঘটনার কিছু চিত্র পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো।

সেদিন যা দেখেছিলেন

ফাবলিহা বুশরা বলেন, ‘ ওই দিনটা আসলে গোলাগুলির শব্দ দিয়ে শুরু হয়। আমি তখন সকালের নাস্তা করছিলাম। ওইদিন আমার ছুটি ছিল। আমাদের বাসাটা ছিল ডিজি আঙ্কেলের বাসাটার ঠিক পাশে। তো বাবা যখন কলটা দেয় তখন ফোনটা আমিই রিসিভ করেছিলাম। আমার সাথে তেমন কথা হয় নাই, শুধু বলছিলেন যে তোমার আম্মুকে দাও তোমার আম্মুর সঙ্গে কথা বলবো।’

‘তারপর বেশি গোলাগুলি শুরু হয়ে গেল। আমরা চারতলার উপর থাকতাম। একটা বুলেট এসে আমাদের জানালার রডটা বেকে ঘরে ঢুকে গেল। আমাদের বাসার নিচে তিনটা গাড়ি ছিল, ততক্ষণে গাড়িতেও ওরা আগুন লাগিয়ে দেয়।’

সেদিনের বিদ্রোহীদের বর্ণনা দিতে গিয়ে বুশরা জানান, সৈনিকরা কেউ মুখে কাপড় বেঁধে, কেউ মাস্ক পরে ছিলো। এতো বেশি সৈনিক পিলখানায় তারা আগে কখনোই দেখেননি। তখন পর্যন্ত কোনো ধারণাও করতে পারেননি আসলে বাইরে কী ঘটছে বা তাদের জন্য কী অপেক্ষা করছে।

বুশরা বলেন, ‘দুজন সৈনিক এসে আমাদেরকে ঘর থেকে বের করে নিয়ে যাচ্ছিল। এসময় একজন সৈনিক এসে আমার মায়ের বুকে বন্দুক ধরে বলছিল তুই শেষ, তুই শেষ। তোর জামাই কে? তোর জামাইতো শেষ। এসময় আমার মার দুই হাতে আমি ও আমার ছোট ভাই ধরা।’

তিনি বলেন, ‘আমি জানতাম না কোয়ার্টার গার্ড কী জিনিস বা সেখানে কী করা হয়। আমাদের আগে পুরাতন ডিজি কোয়ার্টার থেকে কিছু ফ্যামিলি নিয়ে আসা হয়েছিল। আমাদের সামনে লাইন ধরে ধরে রুমটার মধ্যে যখন সবাইকে ঢুকাচ্ছিল।’

‘সবচেয়ে বীভৎস যেটা লাগছিল যে ওনারা বেধড়কভাবে অফিসারের মিসেস যারা, ইভেন মা এবং সন্তানদের পেটাচ্ছিল। তখন আমার পেছনে একটা লাথি লাগে। আমার কানের পেছনে বন্দুকের বাঁট দিয়ে একটা আঘাত করে।’

বুশরা জানান, একটা রুমে ৭০/৮০ জনকে গাদাগাদি করে রাখা হয়। এসময় বিডিআর জওয়ানরা উল্লাস করছিল এবং কে কয়জনকে মেরেছে সেটি জানান দিচ্ছিল। জিম্মি অবস্থায় অল্প বয়সে নৃশংস ঘটনার চাক্ষুষ সাক্ষী হয়েছিলেন কিশোরী বুশরা।

‘একজন ধুপী ছিলেন উনি একজন অফিসারকে বাঁচানোর চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু উনি সৈন্যদের হাতে ধরা পড়ে যান। আমরা বাইরে বসে দেখছিলাম যে, তার ওপর জাস্ট ২০-২৫ জন লোক ঝাঁপিয়ে পড়লো। এবং তাকে যে যে জিনিস পাচ্ছে তাই দিয়ে পেটাচ্ছে। লোকটার চিৎকার আমি কোনোদিন ভুলবোনা। আমি অনেক রাত ঘুমাতে পারি নাই এই জিনিসটা এক্সপিরিয়েন্স করার পর।’

কোয়ার্টার গার্ডে বুশরা তার মা ও ভাইয়ের সঙ্গে একরুমে অবরুদ্ধ ছিলেন। সেখানে এক ঘটনা কিশোরী বুশরার জন্য মারাত্মক ভীতির সঞ্চার করেছিল।

‘আমি আর আমার মা পাশাপাশি বসে ছিলাম। গরাদের দরজার ভেতর দিয়ে বন্দুক ঢুকিয়ে নল দিয়ে আমার দিকে তাক করে একজন বলছিলেন, চোখ বন্ধ কর, চোখ বন্ধ কর। হাসতেছে আর বলতেছে যে কিছু বোঝা যাবে না চোখ বন্ধ কর।’

‘দে ওয়্যার লাফিং দ্যাট ইট ওয়াজ অ্যা জোক। আমি যে ভয় পাচ্ছি, আমি যে গুটিয়ে যাচ্ছি - এই জিনিসটা দেখে ওরা খুব আনন্দ পাচ্ছিল। আমরা শুধু ওয়েট করছিলাম যে কখন তারা আমাদেরকে মেরে ফেলবে।’

বুশরা জানান, ৩৬ ঘণ্টা অবরুদ্ধ থাকার সময় তারা দোয়া-কলেমা পড়েছেন। শুধু পানি খেয়ে কাটিয়েছেন পুরোটা সময়। রাতে একটু ঘুমিয়েছিলেন স্যান্ডেল মাথায় দিয়ে। যখন পিলখানা থেকে বের হন তখনো আতঙ্ক কাটেনি তাদের।

বুশরা বলেন, ‘আমাদেরকে যখন বলা হয়ছিল যে তোমরা চলে যাও। ট্রাকে করে উঠিয়ে দেয়া হচ্ছিল আমাদের। আমরা তখন যেতে চাচ্ছিলাম না। ঘটনার বীভৎসতাটা এত বেশি ছিল যে আমাদের মনে হচ্ছিল যে আমরা গাড়িতে উঠবো আর আমাদের পেছন থেকে গুলি করবে।’

ঘটনার পর মানসিক অবস্থা

বুশরা বলেন, ‘আমার কাছে মনে হয় যে, এই সময়টা নিজেদের জিম্মি থাকার অভিজ্ঞতাটা যতটা কষ্টকর ছিল, তার চেয়ে বেশি কষ্টকর ছিলো বাবার জন্য অপেক্ষা করা। আর তারপরে তার লাশ পাওয়ার অভিজ্ঞতাটা আরও অনেক বেশি কষ্টকর ছিলো।’

‘আমি তিনবার আইসিইউতে গিয়েছিলাম। আমার বাবার যেদিন জানাযা ছিল সেদিন আমাকে চারটা সিডেটিভ দেয়া হয়েছিল টু কাম মাই নার্ভস। আমি কাঁদতে পারতাম না। আমি চিৎকার করতাম। আমার অনেক আউটবার্স্ট হতো। আমি এই জিনিসটা মেনেই নিতে পারিনি।’

বুশরা জানান, ওই ঘটনার পর ৭ বছর পর্যন্ত টানা মানসিক চিকিৎসা আর থেরাপির মধ্য দিয়ে তাকে যেতে হয়েছে। তিনি বলেন, ‘আমার বাবার প্রতি এত এটাচড ছিলাম আর পুরো ঘটনাটা আমি কিছুই এড়াতে পারি নাই। মাইন্ড ডাইভার্ট করতে পারি নাই। আমার পড়াশোনার ক্ষতি হতো। পড়াশোনা করতে চাইতাম না। আমার মানসিক অবস্থা দেখে অনেকে চিন্তা করতো যে আমি হয়তো আর পড়াশোনায় এগিয়ে যেতে পারবো না!"

এখন তার পরিস্থিতি

মৃত্যুবার্ষিকী এলে তিনি চেষ্টা করেন, তার যে শোক সেটা ব্যক্তিগতভাবে পালন করতে। সবাই চলে যাওয়ার পরে কবরস্থানে যান । একটু নিজের মতো করে যতটুকু সময় পার করা যায় এটাই চেষ্টা করেন।

২০০৯ সালের ঘটনাকে বিদ্রোহ বলতে চান না বুশরা। তিনি বলেন, ‘আমরা যারা ভেতরে ছিলাম আমরা কোনো বিদ্রোহ দেখিনি। কোনো অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া দেখিনি। আমরা মানুষ মারার পর তাদের উল্লাস দেখেছি। আমরা মানুষকে নির্যাতন করা দেখেছি। ছোট ছোট বাচ্চাকে গিয়ে গালিগালাজ করা, মহিলাদের গায়ে হাত দেয়া - এটা কী ধরনের প্রতিবাদ?

‘আমি এটাকে বিদ্রোহ বলতে চাই না, আমরা কেউই এটাকে বিদ্রোহ বলতে চাই না। আমি এটাকে কারনেজ বলতে চাই। আমি এটাকে ম্যাসাকার বলতে চাই।’

সূত্র: বিবিসি বাংলা।

Link copied!