দেশে ধর্ষণের অভিযোগে বিভিন্ন থানায় করা মামলার প্রায় ২১ শতাংশই তদন্তে প্রমাণিত হয় না। এরমধ্যে আবার ১২.০৯ শতাংশ মামলা প্রমাণিত হচ্ছে পুরোপুরি মিথ্যা। আইন বা তথ্যের ভুলও মিলছে ৮.৭২ শতাংশ ক্ষেত্রে।
গত পাঁচ বছরে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) তদন্ত করা ১ হাজার ৯টি মামলার তদন্তে উঠে এসেছে এমন তথ্য। সংস্থাটির পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০১৭ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২১ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ১২২টি ধর্ষণ মামলা মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে। একই সময়ে ৮৮টি মামলায় মিলেছে আইন বা তথ্যের ভুল।
পিবিআই প্রধান অতিরিক্ত পুলিশ মহাপরিদর্শক বনজ কুমার মজুমদার বলেন, ধর্ষণের মামলা তদন্তের ক্ষেত্রে আমরা ভুক্তভোগীর পক্ষে থাকার চেষ্টা করি। কিছু ক্ষেত্রে দেখা যায়, দু'জন প্রাপ্তবয়স্ক নারী-পুরুষ স্বেচ্ছায় একটা সম্পর্কের বন্ধনে থেকেছেন। পরে কোনো কারণে মতবিরোধ বা বিচ্ছেদ হওয়ায় ধর্ষণের অভিযোগ আনা হয়েছে। এ ছাড়া মিথ্যা তথ্য দিয়ে মামলা করে প্রতিপক্ষকে ফাঁসানোর চেষ্টাও থাকে। এসব ক্ষেত্রে ধর্ষণ প্রমাণিত না হওয়ায় চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয়। প্রমাণ ও যুক্তিসাপেক্ষ হওয়ায় আদালত তা গ্রহণ করেন।
বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট সালমা আলী বলেন, সুষ্ঠু তদন্তের যোগ্যতা পিবিআইর আছে। তবে প্রশ্ন হলো, তদন্ত কি নিরপেক্ষ হয়েছে, নাকি কোনো প্রভাবশালী মহলের চাপ ছিল? চাপ থাকায় ঘটনা ধামাচাপা দিতেও তদন্ত ভিন্ন খাতে প্রবাহিত হতে পারে। আবার অনেক সময় তদন্তে দীর্ঘসূত্রতার কারণে আলামত নষ্ট হয়ে যায়, সাক্ষীও পাওয়া যায় না। তখন অভিযোগ প্রমাণও কঠিন হয়ে পড়ে।
তদন্ত-সংশ্লিষ্টরা জানান, ফৌজদারি কার্যবিধি অনুযায়ী থানায় হওয়া মামলাগুলোকে জেনারেল রেজিস্ট্রার বা সংক্ষেপে জিআর কেস বলা হয়। ধর্ষণের অভিযোগে হওয়া বিপুলসংখ্যক জিআর মামলা তদন্ত করেছে পিবিআই। তাতে দেখা যায়, এগুলোর বড় অংশ ভুয়া অভিযোগে করা হয়। পরিকল্পিতভাবে প্রতিপক্ষকে হয়রানি করতে, প্রেমের সম্পর্কের পর বিয়েতে রাজি না হওয়ায় বা ব্যক্তিগত সম্পর্কের অবনতির কারণে অনেক মামলা হয়। প্রচলিত ও প্রযুক্তিগত তদন্তে সেসব মিথ্যা ধরা পড়ে। একইভাবে আদালতে করা কমপ্লেইন রেজিস্ট্রার বা সিআর মামলার তদন্তেও প্রচুর অভিযোগ মিথ্যা প্রমাণিত হয়।
পিবিআই সূত্র জানায়, ২০২০ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর গাজীপুরের শ্রীপুর থানায় পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির পরিচালক ড. নুরুল ইসলামের বিরুদ্ধে ধর্ষণ মামলা করেন এক নারী। মামলায় নুরুলের বাগানবাড়িকে ঘটনাস্থল হিসেবে উল্লেখ করা হয়। তদন্তে দেখা যায়, জায়গাটি আসলে কলাবাগান এবং সেখানে একটি ছোট টিনশেড ঘর আছে। ওই ঘরে কেয়ারটেকার জহিরুল ইসলাম থাকেন। তবে অভিযোগকারী ওই বাড়িতে কখনও যাননি। এমনকি বাদী যে ঠিকানা দিয়েছেন, সেই ঠিকানায়ও তিনি কখনও থাকেননি। মামলায় দেওয়া তাঁর মোবাইল ফোনটিও বন্ধ পাওয়া যায়। একই বছরের ১৬ আগস্ট আরেক নারী গাজীপুরের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে একই ব্যক্তি অর্থাৎ নুরুল ইসলামের বিরুদ্ধে ধর্ষণ মামলা করেন। মামলায় ঘটনাস্থল বলা হয়েছে নুরুলের অফিস 'বাংলাদেশ-নরওয়ে ফ্রেন্ডশিপ হাসপাতাল অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টার'। তদন্তে দেখা যায়, অফিস কক্ষটি হাসপাতালের নিচতলায়।
অফিসের সামনের অংশ স্বচ্ছ কাচের তৈরি হওয়ায় বাইরে থেকে সবই দেখা যায়। এ ছাড়া ওই কক্ষের পাশেই প্যাথলজি এবং আলট্রাসনোগ্রাম কক্ষ। ফলে হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে যাওয়া রোগী ও স্বজনরা সহজেই অফিস কক্ষের ভেতরের দৃশ্য দেখতে পান। ঘটনার সময় উল্লেখ করা হয়েছে সন্ধ্যা ৬টা, যখন হাসপাতালে অনেক মানুষের সমাগম থাকে। অথচ ধর্ষণের ঘটনা বা সন্দেহজনক গতিবিধি কেউ দেখেননি। আবার মামলার বাদীকেও খুঁজে পাওয়া যায়নি। বাদী ও বিবাদীর মোবাইল ফোনের কললিস্ট চেক করে দু'জনের কথোপকথনের প্রমাণ মেলেনি। ফলে ধর্ষণের অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যায়নি।
এরপর ২১ আগস্ট গাজীপুরের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত-৩-এ একই আসামির বিরুদ্ধে যৌতুক মামলা হয়। পিবিআইর তদন্তে বেরিয়ে আসে, ভিন্ন নাম ব্যবহার করা হলেও তিনটি মামলার বাদী একজনই। মূলত গাজীপুর পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-২-এর কিছু কর্মকর্তার দুর্নীতি সমর্থন না করায় নুরুলের বিরুদ্ধে একের পর এক মামলা দেওয়া হয়।
পিবিআইর পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০২১ সালে আগের বছরের নিষ্পত্তি না হওয়া ৯১টিসহ ধর্ষণ-সংক্রান্ত মোট ২১৯টি মামলা তদন্ত করে পিবিআই। এর মধ্যে ৩৪টি মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে। আইন বা তথ্যের ভুল ছিল ১৫ মামলায়। একইভাবে ২০২০ সালে তদন্তাধীন মোট ধর্ষণ মামলা ছিল ২৪১টি। এর মধ্যে ২০টি ছিল মিথ্যা মামলা, তথ্যের ভুল ছিল ১৫টির। এর আগে ২০১৯ সালে তদন্ত করা ২৫২ মামলার মধ্যে মিথ্যা ছিল ২৩টি। আর তথ্যের ভুল ছিল ২০ মামলায়। ২০১৮ সালে পিবিআই মোট ১৬৪টি ধর্ষণ মামলা তদন্ত করে। এর মধ্যে ২৭টি মিথ্যা এবং ২২টিতে ছিল তথ্যগত ভুল। আর ২০১৭ সালে এমন মামলা ছিল ১৩৩টি। এর মধ্যে ১৮টি ছিল মিথ্যা মামলা। আইন বা তথ্যের ভুল ছিল ১৬টি মামলায়।
পিবিআই প্রধান কার্যালয়ের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আবু ইউসুফ বলেন, তদন্তে যেসব মামলায় বাদীপক্ষের অসৎ উদ্দেশ্য স্পষ্ট হয়, সেসব মামলার বাদীদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হয়।
সূত্র: সমকাল