বসুন্ধরায় আগুন লাগলে পানি আনতে হয়েছিল সোনারগাঁওয়ের সুইমিং পুল থেকে

দ্য রিপোর্ট ডেস্ক

এপ্রিল ২৪, ২০২২, ০৭:০৮ পিএম

বসুন্ধরায় আগুন লাগলে পানি আনতে হয়েছিল সোনারগাঁওয়ের সুইমিং পুল থেকে

যে কোনো দুর্যোগে ফায়ার সার্ভিস যেন উদ্ধার কাজ চালাতে পারে সেটা মাথায় রেখে পরিকল্পনা করার জন্য স্থপতি ও প্রকৌশলীদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

আজ রবিবার সকালে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে তিনি এ কথা বলেন। অনুষ্ঠানে গণভবন থেকে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে ৫ বিভাগের ২৫ জেলার ৩৯টি উপজেলায় নবনির্মিত ৪০টি ফায়ার স্টেশনের উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী।

তিনি বলেন, ৭৫'র প্রায় ২১ বছর পর আওয়ামী লীগ সরকারে আসে। আমি যখন ক্ষমতায় আসি তখন মাত্র ১০৯টি ফায়ার স্টেশন আমাদের দেশে ছিল। ইতোমধ্যে আমাদের জনসংখ্যা বেড়েছে। বিভিন্ন এলাকায় আগুন লাগলে অথবা কোনো দুর্যোগ দেখা দিলে উদ্ধার কাজের তেমন কোনো ব্যবস্থা ছিলই না। ৯৬ সালেই উদ্যোগ নিয়েছিলাম আরও ১০০টি ফায়ার স্টেশন নির্মাণ করার। এর বেশি আর বাড়েনি। আমরা যতটুকু করে যাই ২০০৯ সালে এসেও দেখি একই অবস্থা। মাত্র ২০৪টি ফায়ার স্টেশন, এর বেশি আর হয়নি।



প্রধানমন্ত্রী বলেন, বসুন্ধরা শপিং মলে যখন আগুন লাগলো, তখন সেই আগুন নির্বাপনের তেমন ব্যবস্থা ছিল না। এই শপিং মলটি পান্থপথে যেখানে হয়েছে সেখানে ছিল খাল। নদীর সঙ্গে সংযুক্ত, ওখানে নৌকাও আসতো। এলাকাটা ছিল বিশাল বিল এলাকা। সেই বিল এলাকা ভরাট এবং খালে বক্স কালভার্ট করার ফলে বসুন্ধরায় যখন আগুন লাগলো; যে বিল্ডিং গড়ে উঠেছে বিলের ভেতরে। সেই বিল্ডিংয়ে আগুন নেভানোর জন্য পানি দেওয়ার ব্যবস্থা নেই। পানি আনতে হয়েছিল সোনারগাঁওয়ের সুইমিং পুল থেকে। সে সময় মাত্র ৪ তলা পর্যন্ত পানি দেওয়ার ব্যবস্থা ছিল, সে পর্যন্ত ল্যাডার ছিল। এরপর আমরা বিভিন্ন উদ্যোগ নেই যেন এই প্রতিষ্ঠান আরও সুন্দরভাবে গড়ে ওঠে, আধুনিক হয়। বিভিন্ন সময় আগুন নেভাতে যারা যান, তাদের সুরক্ষা বিষয়ে কারো তেমন দৃষ্টি ছিল না। আমরা তাৎক্ষণিকভাবে টাকা দিয়ে আলাদাভাবে সরঞ্জামাদি কেনার ব্যবস্থা নেই। যুগোপযোগী করার বিভিন্ন উদ্যোগ আমরা নিয়েছি। আমি সিদ্ধান্ত দিয়েছিলাম প্রতিটি উপজেলায় ফায়াস সার্ভিস স্টেশন অবশ্যই হতে হবে। পাশাপাশি আমাদের দেশের মানুষকে আরও সচেতন হতে হবে।

ফায়ার ফাইটারদের আধুনিক প্রশিক্ষিত ও আন্তর্জাতিক মানের করে গড়ে তুলতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ফায়ার একাডেমি প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ইতোমধ্যে জমি হস্তান্তর করা হয়েছে। ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা আমরা নিচ্ছি। তাছাড়া বেশি কিছু ফায়ার ফাইটারদের বিদেশে ট্রেনিং করিয়ে আনা হয়েছে। প্রায় ১ হাজারের বেশি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পেশাগত দক্ষতা উন্নীত করার জন্য বিদেশে ট্রেনিং করিয়েছি।

তিনি আরও বলেন, আমাদের মাত্র ২০৪টি ফায়ার স্টেশন ছিল, জনসংখ্যা বেড়ে গেছে—১৬ কোটি উপরে। সেদিকে লক্ষ রেখে আমরা উদ্যোগ নিয়েছি প্রত্যেকটা উপজেলা তো এই প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠবেই, এছাড়া বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে যেখানে খুব জরুরি প্রয়োজন হতে পারে সেখানেও ফায়ার স্টেশন গড়ে তোলা হবে। বর্তমানে ৪৫৬টি ফায়ার স্টেশন আমাদের আছে, আজ আরও ৪০টির উদ্বোধন করতে যাচ্ছি। আগামী জুনের মধ্যে আরও ৫৫টি তৈরি হয়ে যাবে।

যারা আমাদের উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, আমাদের স্থপতি ও প্রকৌশলী প্রত্যেককে একটি কথা মনে রাখতে হবে, যে কোনো একটি প্রজেক্ট যদি আপনারা তৈরি করেন তাহলে সেই প্রতিষ্ঠানে অগ্নি নির্বাপনের আধুনিক ব্যবস্থা আছে কি না সেটা যেমন নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি যদি কখন আগুন লাগে সেটা নেভানোর জন্য পর্যাপ্ত পানি পাওয়া যায় কি না সেটাও নিশ্চিত করতে হবে। জলাধারগুলো সংরক্ষণ করতে হবে। বক্স কালভার্ট বা জলাধার ভরাট করে সব কিছু করা ঠিক না। তাতে ওইটাই হবে, যেখানে শুধু বিল ছিল সেখানে একটা বিল্ডিংয়ে অগ্নি নির্বাপনের জন্য পানি পাওয়া যায় না। ঢাকা শহর যেখানে অজস্র খাল-বিল-পুকুরের জায়গায়। বাংলাদেশটাই এ রকম। ভরাট করার আগে এ কথাটা মাথায় রাখা উচিত ছিল। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে যারা প্রজেক্ট তৈরি করেন, ফায়ার সার্ভিসের জন্য যেন সুবিধা থাকে সে বিষয়টা দেখতে হবে। তাদের গাড়ি যাওয়ার ব্যবস্থা, তাদের পানি পাওয়ার ব্যবস্থা—বলেন শেখ হাসিনা।

তিনি আরও বলেন, এখন অনেক উঁচু তলা বিল্ডিং হয়। আমাদের এখন মাত্র ২০ তলা পর্যন্ত ফায়ার ফাইটিংয়ের সক্ষমতা আছে। সেখানে আমি দেখতে পাই, কেউ হয়তো ৩০ তলা বিল্ডিং করবে নানা রকম প্ল্যান করে বসে আছে। তার আগে এটা চিন্তা করতে হবে, এখানে কোনো দুর্ঘটনা দেখা দিলে উদ্ধার কাজ করার মতো সক্ষমতা কতদূর আছে। আমাদের সেই চিন্তা করেই পরিকল্পনা নেওয়া উচিত বলে আমি মনে করি। আমরা বাংলাদেশের মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য কাজ করে যাচ্ছি। পাশাপাশি তাদের নিরাপত্তা দেখাও আমাদের দায়িত্ব। আমাদের দেশে দেখা যাচ্ছে লঞ্চে বা স্টিমারে আগুন লেগে যাচ্ছে। এত বড় বড় জলযান সেখানে তাদের অগ্নি নির্বাপকের তেমন সুযোগ থাকে না।

আগুন লাগলে কী কী করণীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও শিল্প কারখানায় সেই প্রশিক্ষণ দেওয়ার পরিকল্পনার কথা জানান প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, অনেক জায়গায় ফায়ার ফাইটিংয়ের ব্যবস্থা থাকে কিন্তু অনেকে ব্যবহার করতে পারে না বা হয়তো একটা মানুষ সে-ই ব্যবহার করতে পারে।

মানুষকে সচেতন হওয়ার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, প্রতিটি বিল্ডিংয়ে আগুন লাগলে বের হওয়ার জন্য একটি আলাদা সিঁড়ি থাকে। অফিস-আদালতে এটা বেশি দেখা যায়, যেহেতু এটা ব্যবহার হয় না তাই এটা হয়ে যায় মাল রাখার ডাম্পিং স্পেস। যে অফিসে কাজ করতে যাচ্ছে, ওখানে যে আলাদা সিঁড়ি আছে; আগুন লাগলে তাড়াতাড়ি বের হতে পারবেন, সেটা অনেকের জানাই থাকে না। যারা কাজে যান, তারা এ ব্যাপারে এতই বেখেয়ালি থাকেন, সেটা যে জেনে নিতে হবে সেটাও তারাও জানেন না।

ভবন তৈরির ক্ষেত্রে স্থপতি ও প্রকৌশলীদের প্রতিটি তলায় খোলা বারান্দা রাখার পরামর্শ দেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, ল্যাডার দিয়ে একটা মানুষকে তুলে আনতে হলে শক্ত প্ল্যাটফর্ম দরকার। এক ইঞ্চি জায়গা কেউ ছাড়তে চায় না। ওইটুকু স্কয়ার ফিট ভাড়া দিলেই তো টাকা। টাকার জন্য এই অন্ধত্বটা মানুষের জীবনকে ঝুঁকিপূর্ণ করে ফেলে।

স্থপতি ও প্রকৌশলীদের প্রতি অসন্তোষ প্রকাশ করে শেখ হাসিনা বলেন, বহুতল ভবন বানাতে গিয়ে ফুটপাতগুলোর ওপর র‌্যাম্প তুলে দেওয়া হয়। এটা স্থপতি-প্রকৌশলীরাই করেন। ফুটপাতও দখল হয়ে যাচ্ছে। ঢাকার বহু এলাকায় কোনো ফুটপাত আর হাঁটার জন্য নেই। গুলশাল এলাকায় এত বিশাল বিল্ডিং বড়লোকরা বানাচ্ছেন, সেখানে দেখা যাচ্ছে ফুটপাতের ওপর দিয়ে গাড়ি নিয়ে যেতে হচ্ছে। ফুটপাত কেন ব্যবহার হবে! ওখান থেকে তো জায়গা কিছু ছেড়ে দেওয়া যায়।

ফায়ার ফাইটারদের ওপর হামলা করলে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে জানিয়ে তিনি বলেন, আগুন লাগলো, সেখানে গেল ফায়ার ফাইটাররা গাড়ি নিয়ে আর গাড়ির ওপর আক্রমণ। গাড়িতেই আগুন ধরিয়ে দিলো। ধরনের ঘটনা যেন না ঘটে। যারা এ রকম করবে সঙ্গে সঙ্গে তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তাদের শাস্তি দিতে হবে। উদ্ধার কাজে যারা যাবে তাদের যারা আক্রমণ করতে আসে তারা তো আসলে মানুষের শত্রু হয়ে যায়। বহু ঘটনা এ রকম ঘটে বলেই আমি কথাগুলো বললাম।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, করোনার কারণে সারা বিশ্বে অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দিয়েছে। ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধ এর ওপর আরও বেশি প্রভাব ফেলছে। তারপরও আমি বলবো উন্নত অনেকে দেশে এখন খাদ্যের জন্য হাহাকার। মূল্যস্ফীতি হার ১৭ শতাংশ পর্যন্ত বেড়ে গেছে। তারপরও আমরা সাধ্য মতো চেষ্টা করে যাচ্ছি দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখতে। যারা মজুত করবে, মানুষের প্রয়োজনীয় জিনিস নিয়ে কোনো রকম খেলা খেলতে যাবে তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে। দেশের মানুষকেও বলবো, এই যুদ্ধের কারণে বিদেশ থেকে যেসব জিনিস আমরা আমদানি করি সেগুলো আনা খুব কষ্ট হয়ে গেছে। পাওয়া যাচ্ছে না। অনেক দেশ তাদের উৎপাদিত পণ্য আর রপ্তানি করছে না। তারাও বিপদে আছে। সে ক্ষেত্রে আমাদের দেশে আমাদের যে মাটি-মানুষ আছে সেটাই ব্যবহার করে আমাদের নিজেদের স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে হবে। ১ ইঞ্চি জমিও অনাবাদি থাকবে না। যেখানে যার যতটুকু আছে তারা আবাদ করবেন। নিজের প্রয়োজনীয় জিনিস নিজেরা উৎপাদন করে নিজেরা ব্যবহার করার ব্যবস্থা নিতে হবে। যেন কারো মুখাপেক্ষী হয়ে আমাদের থাকতে না হয়। সেদিকে আমাদের বিশেষভাবে দৃষ্টি দিতে হবে।

সূত্র: বাসস

Link copied!