রাজধানী ঢাকা মেগাসিটির মর্যাদা পেয়েছে সেই আশির দশকেই। এই মেগাসিটির যেমন নানা সম্ভাবনা রয়েছে, রয়েছে এর নানাবিধ সংকটও। মোটা দাগে যেসব সমস্যা এই মহানগরীকে বসবাসের অযোগ্য করে তুলেছে, সেসব নিয়ে নগর বিশ্লেষক-পরিকল্পক, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য, যানবাহনের চালক, ব্যবসায়ী ও সাধারণ মানুষদের সাথে কথা বলে দ্য রিপোর্ট ডট লাইভ ধারাবাহিক রিপোর্ট প্রকাশ করছে। আজ থাকছে এর প্রথম পর্ব। রিপোর্ট তৈরি করেছেন ফারুক আলম।
প্রতিদিনই রাজধানীর জনসংখ্যায় যুক্ত হচ্ছে নতুন নতুন মুখ। জনসংখ্যার ভারে নুয়ে পড়ছে শহরটি। ধারণক্ষমতা ৫০ লাখ হলেও এর জনসংখ্যা এখন দুই কোটিরও বেশি। এ কারণে নগরবাসীকে সেবা দিতে যে সংস্থাগুলো নিয়োজিত, সেগুলোও চাপে বিপর্যস্ত। সরকারি হাসপাতাল, ঢাকা ওয়াসা, তিতাস গ্যাসসহ ২৬টি সেবাদানকারী সংস্থা তাদের দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে রীতিমত হয়রান। অতিরিক্ত মানুষের চাপে সংস্থাগুলো নুয়ে পড়ছে। এতে গত ১৫ বছরে নাগরিকসেবা উন্নয়নের চেয়ে ভোগান্তি বেড়েছে কয়েকগুণ। নগরে সড়কের পরিধি বাড়েনি, অথচ বেড়েছে গাড়ির সংখ্যা। এর ফলে সৃষ্টি হয়েছে অসহনীয় যানজট। নষ্ট হচ্ছে মানুষের মূল্যবান বহু কর্মঘণ্টা।
জানা গেছে, ১৯৬০ সালে কলকাতা শহরের ১০ ভাগের ১ ভাগ মানুষ ঢাকা ছিল। ২০ বছর পর ৩ ভাগের ১ ভাগ দাঁড়ায় ঢাকায়। সর্বশেষ ২০০৫ সালে জনসংখ্যা হিসাবে কলকাতা শহরকে ছাড়িয়ে যায় ঢাকা। পরিকল্পনার অভাবে ঢাকা শহরে দ্রুতই জনসংখ্যা বেড়েছে বলে মনে করেন পরিকল্পনাবিদরা।
সর্বশেষ বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) তথ্যমতে, বাংলাদেশের জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৫১ লাখ ৫৮ হাজার ৬১৬ জন। এর মধ্যে ঢাকা বিভাগে বাস করেন ৪ কোটি ৪২ লাখ ১৫ হাজার ১০৭ জন। দেশের মোট জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ১ দশমিক ২২ শতাংশ সেখানে ঢাকায় ১ দশমিক ৯৪ শতাংশ। এছাড়াও ঢাকায় বছরে প্রায় ৬ লাখ মানুষ যুক্ত হচ্ছেন। যা দিনে ১ হাজার ৬৪২ জনের কাছাকাছি। এভাবে চলতে থাকলে ২০৩০ সালে ঢাকা বিশ্বের ষষ্ঠ বৃহত্তম মেগাসিটিতে রূপান্তরিত হবে। যদিও বিবিএসে’র এই প্রতিবেদন নিয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনসহ অনেকের প্রশ্ন রয়েছে।
সড়ক বাড়েনি, বেড়েছে গাড়ির সংখ্যা
একটি শহরের আয়তনের ২৫ শতাংশ সড়ক থাকা দরকার হলেও ঢাকায় আছে মাত্র ৯ শতাংশ। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে শহরে বাস ও মিনিবাসের চেয়ে দ্বিগুণ হারে বাড়ছে ব্যক্তিগত ও ছোট গাড়ি। সবচেয়ে বেশি নিবন্ধিত হচ্ছে মোটর সাইকেলের। সব মিলিয়ে ঢাকায় প্রায় ১৯ লাখের কাছাকাছি যানবাহন নিবন্ধিত হয়েছে। আছে ২০ লাখের ওপরে রিকসা!
এ বিষয়ে রমনা ট্রাফিক বিভাগের এএসআই সোলাইমান দ্য রিপোর্ট ডট লাইভকে বলেন, ‘স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে সড়কে গাড়িই পাওয়া যেত না, এখন যিনি খয়রাত করেন তাঁরও তিন থেকে চারটা প্রাইভেটকার আছে। বিদেশে গাড়ি কিনতে আয়ের উৎস লাগে, বাংলাদেশে লাগে না। বাংলাদেশের মতো বিশ্বের কোনো রাষ্ট্রে এতো গাড়ি আমদানি হয় না। বর্তমানে গাড়ির চাপে রাস্তায় যানজট সৃষ্টি হলেও ধীরে ধীরে তবু যাতায়াত করা যাচ্ছে। ১০ বছর পর যানজটে রাস্তায় গাড়ি রেখে মানুষকে অফিসে হেঁটে যেতে হবে। তখন কী রিপোর্ট লেখবেন? প্রশ্ন করেন এই পুলিশ কর্মকর্তা।
বাড়ে হাসপাতাল, বাড়ে ক্লিনিক; বাড়ে না শুধু সেবার মান
ঢাকায় সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিক বাড়লেও বাড়েনি সেবার মান। সেবার নামে মানুষকে জিম্মি করে ব্যবসায়িক চিন্তা-ভাবনায় গড়ে উঠেছে হাসপাতাল-ক্লিনিক। রোগীর সেবা পেতে রীতিমত বাধার পাহাড় ডিঙাতে হয়।
পুরানো ঢাকার মিটফোর্ড হাসপাতালে মেডিসিন বিভাগে চিকিৎসা নিতে আসা সেফালি বেগম গত সপ্তাহে দ্য রিপোর্ট ডট লাইভকে বলেন, সামান্য কারণেই ডাক্তার টেষ্ট করতে দেয়। হাসপাতালে এই টেষ্ট করাতে গেলে কর্মচারীরা নানা অজুহাত দেখায়। অনেক সময় বলে টেষ্ট করার যন্ত্রপাতি নষ্ট। কোনো সময় বলে যে টেষ্ট করবেন সেই বিশেষজ্ঞ নেই। শুধু মিটফোর্ডই নয়, ঢাকা মেডিকেল হাসপাতালসহ সরকারি সবগুলো হাসপাতালে রোগী ভোগান্তির এখন এরকমই।
মির্টফোর্ড হাসপাতালে কর্মরত একাধিক আয়া নাম প্রকাশ না করে বলেন, হাসপাতালে মেডেসিন বিভাগসহ প্রতিটি বিভাগে সিন্ডিকেট আছে। ওই সিন্ডিকেটের বাইরে সাধারণ রোগী চিকিৎসা নিতে গেলে নানা ভোগান্তিতে পড়েন। কর্মচারীদের এই সিন্ডিকেটের মাধ্যমে রোগীর চিকিৎসা নিতে গেলে বাড়তি টাকা গুণতে হয়। মাঝে মাঝে বড় স্যার (হাসপাতাল পরিচালক) এদেরকে পুলিশের হাতে তুলে দেয়। কিন্তু অবস্থার তাতে বদল ঘটে না।
ড্রেনেজ ব্যবস্থার বেহাল দশা
ঘিঞ্জি ঢাকায় ফাঁকা জায়গা নেই বললেই চলে। এতে বৃষ্টির পানি নিষ্কাশনের একমাত্র ভরসা ড্রেনেজ ব্যবস্থা। কিন্তু সেই ড্রেনেজ ব্যবস্থাও বেহাল। ড্রেনেজ ব্যবস্থার এই দুরবস্থার কারণে শহরে বৃষ্টি হলেই বিভিন্ন এলাকায় সৃষ্টি হয় জলাবদ্ধতা। রাস্তায় জমে থাকে পানি। ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের সাথে যুক্ত নতুন ওয়ার্ডগুলো নিচু এলাকা হওয়ায় সীমিত বৃষ্টিতে নেমে আসে চরম দুর্ভোগ। দীর্ঘ সাড়ে ৫ বছরে নতুন ওয়ার্ডগুলোর রাস্তা ও ড্রেনেজ ব্যবস্থার খুব একটা উন্নয়ন হয়নি।
পানির আছে সংকট, যে সরবরাহ আছে তাতেও দুর্গন্ধ
বিগত ২০ বছরে ঢাকায় মানুষের সংখ্যা বাড়ায় পানির চাহিদা বেড়েছে কয়েকগুণ। মানুষের পানির চাহিদা মেটাতে ঢাকা ওয়াসাও পানি উৎপাদন বাড়িয়েছে। শীতের মৌসুমে পানির চাহিদা মেটাতে হলেও গরমের মৌসুমে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় পানি সংকট দেখা দেয়। পানি সংকটের পাশাপাশি ঢাকা ওয়াসার পানিতে মিলছে ময়লা ও দুর্গন্ধও। এবার ঢাকা ওয়াসার নথিতেও পানিসংকট ও দুর্গন্ধের বিষয়টি উঠে এসেছে। ওয়াসার তথ্য অনুযায়ী, রাজস্ব জোন-৪ (মিরপুর-আগারগাঁও) অঞ্চলের বিভিন্ন এলাকায় তীব্র পানিসংকট চলছে। পানি এলেও তা দুর্গন্ধযুক্ত।
এ বিষয়ে ঢাকা ওয়াসার রাজস্ব জোন-৪-এর রাজস্ব কর্মকর্তা মো. সামছুল ইসলাম খান বলেন, পানি সংকট ও দুর্গন্ধের বিষয়টি চিঠির মাধ্যমে ওয়াসার বাণিজ্যিক ব্যবস্থাপক, প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা ও তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলীকে জানানো হয়েছে। ঢাকা ওয়াসা, সরকারি হাসপাতাল সহ রাজধানীতে অবস্থিত সেবা সংস্থায় অনিয়ম-দুর্নীতি রয়েছে।
তবে এসব অভিযোগ মানতে নারাজ ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) প্রকৌশলী তাকসিম এ খান। তিনি দ্য রিপোর্ট ডট লাইভকে বলেন, রাজধানীর কোথাও পানির সংকট নেই। চাহিদার চেয়ে পানি বেশি উৎপাদন করতে সক্ষমতা ঢাকা ওয়াসা। বর্তমানে ঢাকা ওয়াসার পানি উৎপাদন ঢাকা শহরের মানুষের চাহিদার চেয়ে বেশি। ওয়াসার দৈনিক পানির উৎপাদন সক্ষমতা ২৬৫ কোটি লিটার। ঢাকা শহরে শীত-বর্ষা অনুযায়ী ২১০ থেকে ২৪৫ কোটি লিটার পর্যন্ত চাহিদা রয়েছে। এখনও ২০ কোটি লিটার পানি বেশি উৎপাদনে সক্ষমতা রয়েছে ওয়াসার। আর ওয়াসার পানিতে যে দুর্গন্ধের কথা বারবার বলা হচ্ছে সেটিও ভিত্তিহীন। কারণ ওয়াসার পানিতে কোনো দুর্গন্ধ নেই। বাসা-বাড়ির পানির ট্যাংক অপরিষ্কার থাকে। সেই ট্যাংকের কারণে পানিতে দুর্গন্ধ হতে পারে।
ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং ডেভেলপমেন্টের (আইপিডি) নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান দ্য রিপোর্ট ডট লাইভকে বলেন, ঢাকা ও এর আশপাশে জনসংখ্যা বৃদ্ধির পেছনে রয়েছে কর্মসংস্থানের সুযোগ। দেশের প্রায় ৭৫ শতাংশ পোশাক কারখানা ঢাকা বিভাগে। সর্ববৃহৎ শিল্পাঞ্চল, সরকারের গুরুত্বপূর্ণ অফিস-আদালত, উচ্চ শিক্ষা, হাসপাতাল ও বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড সবই ঢাকা কেন্দ্রীক। ফলে গ্রাম ছেড়ে স্রোতের মতো মানুষ ঢাকায় আসছেন। নগরের এই জনস্রোত ঠেকানো না গেলে এই শহরের সমস্যা কখনোই সমাধান হবে না। গ্রামাঞ্চলে নতুন নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে হবে। দেশের অন্যান্য অঞ্চল বা বিভাগীয় শহরগুলো অবহেলিত পড়ে আছে।