‘বেচার পর নিজের হাতে কাউরে যখন লাল-সবুজ পতাকাগুলান দেই, তখন আমার মনে হয় নিজের দেশটাই যেন তুইল্যা দিলাম তার কাছে।’ ঢাকা শহরে জাতীয় পতাকার মৌসুমী বিক্রেতা মাদারীপুরের শিবচরের বাসিন্দা রবিউল ইসলাম সম্প্রতি এভাবেই নিজের অনুভূতি প্রকাশ করেন দ্য রিপোর্ট ডট লাইভের কাছে।
সারা বছর চোখে না পড়লেও জাতীয় দিবসগুলোতে রাজধানীতে দেখা মেলে লাল-সবুজের পতাকা বিক্রেতাদের। মৌসুমী পতাকা বিক্রেতা রবিউল ইসলামও তাদেরই একজন। এইচএসসি দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী তিনি। ঢাকায় এসেছেন পতাকা বিক্রি করে বাড়তি আয় ও রাজধানীতে ঘুরে বেড়ানোর ভিন্নধর্মী এক নেশায়।
আইনালও একজন মৌসুমী পতাকা বিক্রেতা। তিনিও একই ধরনের অনুভূতি প্রকাশ করে বলেন, আমি শুধু লাভের জন্য নয়, দেশ প্রেম থেকেই পতাকা বিক্রি করি। গত দুই বছর ধরে ডিসেম্বর মাস এলেই আমি ঢাকা এসে বিভিন্ন মাপের পতাকা কিনে নিয়ে বিক্রি করি। এতে পুরো শহর ঘুরে দেখার সাথে সাথে আমার বাড়তি কামাই রোজগারও হয়। এই রোজগার দিয়ে আমার বাকি দিনগুলোও ভাল কাটে।
আইনাল আরো বলেন, একেবারে ছোট পতাকা ১০ টাকা থেকে শুরু হয়ে মাপ অনুযায়ী ৩০, ৫০, ১০০ থেকে ৫০০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি করি। ডিসেম্বরের ১৬ তারিখ পর্যন্ত পতাকা বিক্রি করে আমার ১০-১৫ হাজার টাকা আয় হয়।
বিজয়ের চেতনায় বিজয়ের মাসের শুরু থেকে জাতীয় পতাকা বিক্রির উৎসব শুরু হয়ে চলে বিজয় দিবস পর্যন্ত। মৌসুমি পতাকা বিক্রেতারা সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ব্যস্ত সময় পার করে জাতীয় পতাকা বিক্রি করে। বিজয়ের মাসে বাড়ির ছাদে, ঘরের বারান্দায়, এমনকি বিভিন্ন ব্যক্তিগত গাড়িতেও লাল-সবুজের পতাকা উড়তে দেখা যায়।
কথা হয় মৌসুমি পতাকা বিক্রেতা মো. খোকনের সাথে। সদরঘাট, গাবতলী, ফার্মগেট, হাতিরঝিল, কারওয়ান, বাজার, মিরপুর, মগবাজার, প্রেসক্লাব সব জায়গায় ঘুরে ঘুরে পতাকা বিক্রি করেন তিনি। শুধু ডিসেম্বরেই না, মার্চ মাসেও ঢাকায় আসেন তিনি পতাকা বিক্রি করতে।
দ্য রিপোর্ট ডট লাইভকে খোকন বলেন, সারাবছর কৃষি কাজ করি। কিন্তু এই সিজনে শহরে আসি ঘুরতে, কিছু বাড়তি আয় করতে। সব শেষে বাজার কইরা বাড়ি যাই। একটা স্বাদ, একটু তৃপ্তি আর হাতে কিছু টাকাকড়ি নিয়ে বাড়ি যাই।
শ্যামপুর-কদমতলী থেকে মৌসুমি পতাকা ফেরিওয়ালা কিছুটা বাড়তি আয়ের জন্য ঢাকায় এসেছেন। ৩৩ বছর বয়সী ফরিদ দ্যা রিপোর্ট ডট লাইভকে বলেন, আমি সারা বছর ক্ষেতি করি, লাঙল চালাই। আর ডিসেম্বর মাসে ঢাকায় আসি পতাকা বিক্রি করতে। নানা সাজে এই সময় ঢাকা সাজানো হয়। সেটা দেখতেও আমার বেশ ভাল লাগে।
তবে তার কথায় একটু আক্ষেপও ঝরে। ফরিদ বলেন, এখন আর মানুষ দেশকে ভালবাসে না, সবাই খালি ছবি তুলে সেই পতাকা পরে ফেলে দেয়! দেশকে ভালবাসা যেনো শুধু একদিনের। বিশেষ দিনের। এই দিনের পর ছোট পতাকাগুলো মানুষের পায়ের নিচে পরে থাকে! এটা দেখে খুব খারাপ লাগে।
ডিসেম্বর বা মার্চ মাস এলেই লাখো শহীদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে শুরু হয় জাতীয় পতাকা কেনার হিড়িক। এতে কিছু মানুষের উপার্জনের পথও হয়। কেউ কেউ পতাকার ব্যবসাকে কেন্দ্র করে অনেকের কর্মসংস্থান করেন। এরকমই একজন হলেন কামাল হোসেন। তিনি প্রায় ২০ বছর ধরে পাইকারী ও খুচরা মূল্যে পতাকা বিক্রি করছেন। দ্যা রিপোর্ট ডট লাইভকে কামাল বলেন, ছোটকাল থেকেই আমার পতাকার প্রতি ভালবাসা ছিলো। মুক্তিযুদ্ধের অনেক গল্প শুনে পতাকার প্রতি একটা সম্মান, শ্রদ্ধা আসে।
কামাল আরও বলেন, পতাকা বিক্রি আমার নেশা। আর তাই নেশাকেই আমি পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছি। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে বুকে নিয়ে আমি পতাকার ব্যবসা শুরু করেছিলাম। পতাকার দৈর্ঘ্য, প্রস্থ অনুপাতে আমরা পতাকা বানাই। ছোট থেকে ধরে একদম বড় পতাকা আমার নিজের কারখানায় তৈরি করে তারপর বেচাবিক্রি করি আমি। দলীয় পতাকা, মুক্তিযুদ্ধের পতাকা, আমাদের দেশের মানচিত্রের পতাকা থেকে শুরু করে সব ধরনের পতাকা আমার কাছে আছে।
সারাবছর পতাকা কেমন বিক্রি হয়? এমন প্রশ্নে কামাল বলেন, সারাবছর টুকটাক বিক্রি হলেও এই ডিসেম্বর মাসে ভাল বেচাকেনা হয়।
দেশজুড়ে এখন বিজয় উল্লাস, মহান বিজয় দিবসের সুবর্ণ জয়ন্তী উদযাপনের অপেক্ষায় আছে গোটা জাতি। মুক্তিকামী বাঙালি তাদের বুকের তাজা রক্তের বিনিময় এ মাসেই ছিনিয়ে এনেছিল চূড়ান্ত বিজয়। বিজয়ের এ মাসকে স্মরণ করিয়ে দিতেই যেন পতাকা বিক্রি করে লাল-সবুজের ভালবাসার রঙ সবার মাঝে ছড়িয়ে দিচ্ছেন এই ফেরিওয়ালারা।