করোনাকালে দীর্ঘদিনের লকডাউনে অন্যান্য খাতের মতো বিপর্যস্ত পর্যটন শিল্পও। দেশে এরমধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে অসংখ্য ট্যুর ও ট্রাভেলস প্রতিষ্ঠান। চাকরি হারিয়েছেন চার লাখেরও বেশি মানুষ। পাশাপাশি পেশাও পরিবর্তন করেছেন অনেকে। বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের তথ্যমতে, প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকার মত ক্ষতি হয়েছে এ খাতে।
এ খাতকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিলো অনেক ফেসবুক ট্যুর গ্রুপ। করোনাতে তারা মুখ থুবরে পরেছে। ২০১৭ সাল থেকে নিয়মিত ট্যুর দিয়ে আসা একটি জনপ্রিয় ফেসবুক গ্রুপ হচ্ছে উইকেন্ড ট্যুর। করোনায় পুরোপুরি বসে যায় তারা। শূণ্য থেকে তলানিতে চলে যাওয়ার কথা জানালেন উইকেন্ড ট্যুরের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইমন ইসলাম। দ্য রিপোর্ট ডট লাইভ এর সাথে আলাপকালে তাদের নানা কষ্টের কথা জানান তিনি।
ইমন ইসলাম বলেন, ’আমরা যারা পুরো সময় ধরে পর্যটন কেন্দ্রগুলো নিয়ে কাজ করি, তাদের সবার জীবনযাত্রায় প্রভাব পড়েছে এই করোনার সময়। শুধু যে অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছি তা নয়, আমদের চলমান কাজের মধ্যেও অনেক ধরনের ক্ষতির শিকার হয়েছি। অথচ আমাদের জীবন-জীবিকা পুরোটাই চলে এই সেক্টরের উপর নির্ভর করে।’
কি পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে জানতে চাইলে ইমন ইসলাম বলেন, ’যে ক্ষতি হয়েছে তা আসলে অংক দিয়ে পরিমাপ করা যাবে না। কারণ আমরা শূণ্যেও নেই, আমরা মাইনাসে চলে গিয়েছি। এই ক্ষতিটা পুরোপুরি কাটিয়ে উঠা কখনোই সম্ভব হবে না।’
এখন নতুন করে শুরুর জন্য সব খরচ বেড়ে যাওয়ার কথাও জানান তিনি। তিনি বলেন, ’দীর্ঘদিন পর খোলার কারণে হোটেল, মোটেল, বাস ভাড়া, ট্রলার ভাড়াসহ সব কিছুরই খরচ অল্প হলেও বাড়ানো হয়েছে। যার ফলে আমাদেরকে টোটাল খরচে এক ধরনের বাড়িয়ে ইভেন্ট তৈরি করতে হয়। যা কাস্টমারের কাছে অনেক বেশি হয়ে যাচ্ছে। এটাও একটি বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়াচ্ছে।’
দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ থাকায় শুধু যে ট্যুর গ্রুপগুলো ক্ষতির মুখে পড়েছে তা নয়, বন্ধ ছিলো রিসোর্টগুলো। ফলে রিসোর্ট মালিকদের অনেক ধরনের ভোগান্তির শিকার হতে হয়েছে। তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা বললেন সাজেকের ম্যাডভেনচার রিসোর্টের নির্বাহী পরিচালক শফিকুল ইসলাম।
তিনি দ্য রিপোর্ট ডট লাইভকে বলেন, ’ক্ষতি বলতে গত দুই বছরে আমাদের আয় তো একেবারে বন্ধ, তার ওপর এই দুই বছরে রিসোর্ট ও অন্যান্য বিষয় নবায়ন করতে প্রায় ২৫-৩০ লাখ টাকা ব্যয় হয়েছে। আমরা ঘুরে দাঁড়াতে পারবো কিনা বলতে পারি না, কিছু মানুষের সাড়া পাওয়া যাচ্ছে যদিও। আশা করছি করোনা পরিস্থিতি যদি অনুকূলে আসে, পর্যটন কেন্দ্রগুলো যদি আর বন্ধ না হয়, তবে ঘুরে দাঁড়ানো সম্ভব।’
রিসোর্ট এর ভাড়া বাড়ানো বিষয়ে তিনি বলেন, ’দীর্ঘদিন ধরে রিসোর্ট বন্ধ থাকার পরও আমাদের নবায়ন খরচ ও স্টাফ খরচসহ অন্যান্য খরচ দিয়ে আসতে হয়েছে। তো সে জায়গা থেকে অল্প কিছু টাকা বাড়ানো হয়েছে। এছাড়া আমাদের রিসোর্টটি হচ্ছে সাজেক ভ্যালিতে। তো এই জায়গায় পানি, বাঁশ যা বলেন সব কিছু আমাদের ৫০ কিলোমিটার নিচে থেকে নিয়ে আসতে হয়। সে জায়গা থেকে আমাদের এক বড় ধরনের খরচ বহন করতে হয়।’
একই ধরনের ভোগান্তির কথা জানান সেন্টমার্টিন এর দ্বীপান্তর রিসোর্টের মালিক রকিব শাওন। তিনি দ্য রিপোর্ট ডট লাইভকে বলেন, ’এই দুই বছরে আমাদের আয় হতো প্রায় ২০ লাখ টাকার মতো, সেটাতো হয়নি উল্টো প্রতিমাসে রিসোর্টের পেছনে খরচ হয়েছে ১-২ লাখের মতো। এই পুরো ক্ষতিটা রিকোভার করতে দীর্ঘ সময় লাগবে। যদি মোটামুটি কাটিয়ে ওঠার কথা বলি সেটাও ১-২ বছরের মধ্যে সম্ভব হবে। কারণ এখনো মানুষ বের হতে ভয় পাচ্ছে পাশাপাশি অর্থনৈতিকভাবেও অনেকে ক্ষতির মধ্যে পরেছে। তার ফলে সাড়াও কমে গিয়েছে। এখন আমরা মাত্র ৫০ শতাংশ মানুষের সাড়া আমরা পাচ্ছি।’
রিসোর্টের খরচ তেমন বাড়ানো হয়নি বলেও দাবি করেন শাওন। তিনি বলেন, ’আমাদের নতুন ভাগে বিনিয়োগে যেতে হচ্ছে। অন্যদিকে সাস্থ্যবিধিসহ অনেক ধরনের বাধা নিষেধের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি। পাশাপাশি আমাদের অনেক কিছুরই দাম বেড়ে যাচ্ছে। এ জন্য রিসোর্টের খরচটাও একটু বাড়ছে।’
বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের এক গবেষণায় দেখা গেছে, করোনা শুরুর প্রথম ৬ মাসে ১ হাজার ২২ কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছে। এছাড়া বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশনের ক্ষতি হয়েছে সাড়ে ১৪ কোটি টাকা। ট্যুর অপরেটর অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের ক্ষতি হয়েছে ৫ হাজার ৭ শত কোটি টাকা। এসোসিয়েশন অব ট্রাভেল এজেন্টস অব বাংলাদেশের ক্ষতি হয়েছে ১২ হাজার কোটি টাকা। আর প্যাসিফিক এশিয়া ট্রাভেল এসোসিয়েশনের ক্ষতি হয়েছে ৯ হাজার ৭ শত ৫ কোটি টাকা।
ট্যুর গ্রুপ, রিসোর্ট এর পাশাপাশি ট্রাভেল এজেন্সিগুলোও ব্যাপক ক্ষতির শিকার হয়েছে। বিভিন্ন দেশের লকডাউন এখনো চলমান থাকায় চোখে মুখে অন্ধকার দেখছে ট্রাভেল এজেন্সিগুলো। তারা কখনো ঘুরে দাঁড়াতে পারবে কিনা তারও নিশ্চয়তা দিতে পারছে না। দ্য রিপোর্ট ডট লাইভের সাথে আলাপকালে এমনটাই বলছিলেন ই আর হলিডেস ট্রাভেল এজেন্সির অন্যতম ব্যবস্থাপনা অংশিদার মো. আশফাকুর রহমান।
আশফাকুর বলেন, ‘করোনায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতির শিকার হয়েছে ট্রাভেল এজেন্সিগুলো। কারণ আমাদের মূল যে টিকেটিং এর বিষয় সেটাতো বন্ধ ছিল। পাশাপশি ট্যুরিজম সেক্টরটাও পুরোপুরি বন্ধ ছিল। সিংগাপুর মালয়শিয়াসহ অনেক দেশ এখনো লকডাউনে আছে। কবে লকডাউন খুলবে তা-ও জানি না। তো এগুলো যদি এখনো না খুলে আমাদেরতো দাঁড়ানোর কোন উপায় নেই। এছাড়া করোনার প্রভাব হঠাৎ করে আসায় বাইরে আমাদের প্রচুর টাকা আটকে গেছে। হোটেল বুকিং, টিকেটিং, বিভিন্ন ইভেন্টের ইস্যুতে টাকা যা দেওয়া হয়েছিলো তা এখন পর্যন্ত ফেরত পাওয়া যায়নি। আমাদের মাসে পেমেন্ট দিতে হয় ১০-১৫ কোটি টাকা। সেখানে এখন মাসে ১ কোটি টাকাও আয় নেই।
আমাদেরকে অফিস ছাড়তে হয়েছে, স্টাফ ছাটাই করতে হয়েছে। কারণ আমরা নিজেরাই ঠিকমত চলতে পারতেছি না, স্টাফ কীভাবে চালবো? ক্ষতি পোষোনোর কথা এখন চিন্তা করাও সম্ভব নয়, তবে যদি সবকিছু ঠিকঠাক হয় সে জায়গা থেকে ৪-৫ বছরেরও বেশি সময় লাগতে পারে এই ক্ষতি পোষাতে। যুক্ত করেন আশফাকুর।
ক্ষতির ঘানি এখনো বয়ে বেড়াচ্ছেন বলে জানালেন ক্যামিয়ার ট্রাভেল লিমিটেড এর পরিচালক ইসতিয়াক আহমেদ। তিনি দ্য রিপোর্ট ডট লাইভকে বলেন, ’ক্ষতির কথা বলে শেষ করা যাবে না। ২০ সালের মার্চ থেকে এখন পর্যন্ত আমরা ক্ষতি বয়ে বেড়াচ্ছি। কারণ আমাদের বিভিন্ন দেশের ভিসা সেকশন এখনো চালু হয়নি। তার ওপর আমাদের ফ্লাইটগুলোও ঠিকমত যাচ্ছে না। আর ভিসা চালু না হলে টিকেটও হবে না। বলতে গেলে সবদিক থেকেই আমরা ক্ষতিগ্রস্ত।’
হয়ে যাওয়া ক্ষতি পোষানো সম্ভব না হলেও ঘুড়ে দাঁড়ানো সম্ভব হবে বলে জানান বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা জাবেদ আহমেদ। তিনি বলেন, পুরো ১৮ মাসই ক্ষতির মুখে ছিলো পর্যটন শিল্প। এই পুরো সময় প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকার মত ক্ষতি হয়েছে এই সেক্টরে। এতো বড় ক্ষতি কাটিয়ে উঠার মতো শক্তি আমাদের নেই। পৃথিবীর কোন দেশেই আসলে এ ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে পারবে না। তবে একটি রিকোভারি প্লান তৈরি হচ্ছে যার মাধ্যমে আমরা ঘুরে দাঁড়াবার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। কারণ মানুষ ঘুরতে যাবেই, সেটাকে কখনই দমিয়ে রাখা যাবে না। আর মানুষের এই ঘোরার মধ্যে দিয়েই একটি অর্ন্তনিহিত শক্তি আছে টুরিজমের। যে শক্তি দিয়েই টুরিজম সেক্টরটি ঘুরে দাঁড়াবে।