ভোজ্যতেলের বাজারে ফের অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। পাম অয়েলের সবচেয়ে বড় রপ্তানিকারক দেশ ইন্দোনেশিয়া রপ্তানি বন্ধ করে দেওয়ার ঘোষণায় বাজারে সব ধরনের ভোজ্যতেলের দাম বেড়ে গেছে। দুই দিনের ব্যবধানে সয়াবিনের দাম প্রতি লিটারে ২০ টাকা এবং পাম অয়েলের দাম প্রতি লিটারে ২৫ টাকা বেড়েছে। সরকার নির্ধারিত দামে কোথাও তেল মিলছে না। এমনকি বাজারে সয়াবিনের সরবরাহও কমে গেছে।
গত মার্চে আর্জেন্টিনা সয়াবিন রপ্তানি সীমিত করার ঘোষণা দিয়েছিল। এর দেড় মাসেরও কম সময়ে গত শুক্রবার ইন্দোনেশিয়া পাম অয়েল রপ্তানি বন্ধের ঘোষণা দিয়েছে। আগামী বৃহস্পতিবার থেকে দেশটির পাম অয়েল রপ্তানি বন্ধ। এতে দেশে ভোজ্যতেলের সরবরাহ নিয়ে দুশ্চিন্তা দেখা দিয়েছে।
বাংলাদেশে পাম অয়েলের ৯০ শতাংশ আমদানি হয় ইন্দোনেশিয়া থেকে। আমদানির ক্ষেত্রে ইন্দোনেশিয়ার বিকল্প দেশের সংখ্যাও হাতে গোনা। অন্যদিকে বিশ্ববাজারে মূল্যবৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে দেশে সয়াবিন ও পাম অয়েলের আমদানি কমে গেছে। এমন পরিস্থিতিতে ভোজ্যতেলের সরবরাহ বাড়াতে নানা পদক্ষেপ নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। মিলার, পাইকার ও খুচরা পর্যায়ে নির্ধারিত দামে ভোজ্যতেল বিক্রি করার পরামর্শ দিয়েছে জাতীয় ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদপ্তর। এ নিয়ে আতঙ্কিত না হওয়ার পরামর্শ দিয়েছে সংস্থাটি।
ভোজ্যতেলের দাম ফের বাড়বে- এ ধরনের একটি আতঙ্ক আগেই ছড়িয়েছেন ব্যবসায়ীরা। এর প্রভাব পড়তে শুরু করেছে দেশের খুচরা বাজারে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, তিন স্তরে ৩০ শতাংশ ভ্যাট কমানোর সুবিধা পুরোটাই ব্যবসায়ীদের পকেটে। এ থেকে ভোক্তাদের তেমন উপকার হয়নি। কারণ এখনো ক্রেতাদের বেশি দাম দিয়েই ভোজ্যতেল কিনতে হচ্ছে। ব্যবসায়ী পর্যায়ে বাড়ছে ভোজ্যতেলের মজুদের পরিমাণ। হুজুগে ক্রেতারাও বেশি করে তেল কিনছেন। ঈদ সামনে রেখে কৃত্রিম সংকটের আভাস পাওয়া যাচ্ছে।ইন্দোনেশিয়া রপ্তানি বন্ধ করায় বিকল্প উৎস থেকে ভোজ্যতেল আমদানির উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। ঈদের পর পাম অয়েল ও সয়াবিন তেল আনা হবে মালয়েশিয়া, ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, চীন ও যুক্তরাষ্ট্র থেকে। এ লক্ষ্যে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করছে সরকার। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাস কিংবা বাংলাদেশ হাইকমিশনের বাণিজ্যিক উইং থেকে ভোজ্যতেল আমদানির ব্যাপারে খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে। ঈদের পর ভোজ্যতেল আসবে আরও পাঁচ দেশ থেকে।
জাতীয় ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এএইচএম সফিকুজ্জামান বলেন, ‘সানফ্লাওয়ার এবং রিফাইনারি তেল আমদানির ওপর শুল্ক কমাতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কাছে চিঠি পাঠানো হয়েছে। ইন্দোনেশিয়া রপ্তানি বন্ধ করার পর এবার বিকল্প বাজারে যেতেই হচ্ছে। এক দেশের ওপর নির্ভরতা কমিয়ে অন্যান্য দেশ থেকেও যাতে বিভিন্ন ধরনের ভোজ্যতেল আনা যায়, সেই উদ্যোগ গ্রহণ করবে সরকার। এ ছাড়া ব্যবসায়ীদের সয়াবিন তেল আমদানির পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। আর ঈদের পর সয়াবিন তেলের মূল্য সমন্বয় করা হবে।’
কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, ‘ভোজ্যতেলের দাম বাড়ার পেছনে সরকারের হাত নেই। এসব পণ্য আমদানিনির্ভর। আমদানি বন্ধ থাকলে এসব পণ্যের দাম বাড়বে, এটাই স্বাভাবিক। তবে সংশ্লিষ্টদের নজরদারি বাড়াতে হবে।’ তিনি বলেন, ‘ব্যয়ের দিকে তাকিয়ে থাকলে এখন আর চলবে না। মানুয়ের আয় বাড়াতে হবে। তা হলে ভারসাম্য হবে।’
জানা গেছে, এক সময় বেশির ভাগ পাম অয়েল আমদানি হতো মালয়েশিয়া থেকে। তবে দামের পার্থক্যের কারণে দেশের এই বাজার এখন প্রায় পুরোটাই চলে গেছে ইন্দোনেশিয়ার হাতে। পাম অয়েলের ৯০ শতাংশের বেশি আসছে সেখান থেকে। অন্যদিকে বিশ্বে সবচেয়ে বেশি সয়াবিন তেল উৎপাদিত হয় চীন, যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রাজিলে। এর মধ্যে ২০১৯ সালে চীন ১ কোটি ৮০ লাখ টন ও যুক্তরাষ্ট্র ৮০ লাখ টন সয়াবিন তেল উৎপাদন করে, যা বিশ্বের মোট উৎপাদনের প্রায় ৪৫ শতাংশ। এ ছাড়া সয়াবিন উৎপাদনে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান ১৭তম। তবে বাংলাদেশের সয়াবিন বীজ দিয়ে ভোজ্যতেল করা হয় না। মাছের খাবার, পোল্ট্রিফিডসহ অন্যান্য কাজে ব্যবহার করা হয়। এর পাশাপাশি দেশে ভোজ্যতেল হিসেবে সরিষা, সূর্যমুখী এবং রাইস ব্রান তেল ব্যবহার করা হচ্ছে। তবে এসব তেলের দাম বেশি হওয়ায় ভোক্তাদের আগ্রহ নেই বললেই চলে।
সম্প্রতি বাংলাদেশ হাইকমিশন মালয়েশিয়ার বাণিজ্যক উইংয়ের কাউন্সেলর মো. রাজিবুল আহসান বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে একটি চিঠি দিয়ে ভোজ্যতেলের ব্যাপারে দেশটির (মালয়েশিয়া) অবস্থান তুলে ধরেছেন। বাণিজ্য সচিব বরাবর লেখা ওই চিঠিতে বলা হয়, ‘মালয়েশিয়া পাম অয়েল সেক্টরসংশ্লিষ্টদের মতে, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ আন্তর্জাতিক বাজারে ভোজ্যতেলের দাম বাড়ার অন্যতম কারণ। সয়াবিন ও পাম অয়েলের পরই বিশ্বে সবচেয়ে বেশি ব্যবহার হচ্ছে সানফ্লাওয়ার অয়েল। ইউক্রেন বিশ্বে প্রথম সানফ্লাওয়ার তেল উৎপাদনকারী দেশ। এরপরই রাশিয়ার অবস্থান।
কিন্তু দুই দেশের চলমান যুদ্ধের কারণে বিশ্বে সানফ্লাওয়ার তেলের সরবরাহ কমে গেছে এবং এর একটি প্রভাব পড়েছে পাম অয়েল ও সয়াবিনের ওপর। এ ছাড়া নিজ ভোক্তাদের সুরক্ষা দিতে ইন্দোনেশিয়া পাম অয়েল রপ্তানি নিরুৎসাহিত করে আসছে। অন্যদিকে মালয়েশিয়ার পাম অয়েল সেক্টর করোনার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। শ্রমিক সংকট এবং সারের মূল্য বৃদ্ধির কারণে মালয়েশিয়ার পাম অয়েল উৎপাদন কমে গেছে।
মালয়েশিয়ায় চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে গড়ে পাম অয়েল উৎপাদন হয়েছে ১ দশমিক ২৬ মিলিয়ন টন, যা আগের তিন মাসে ছিল ১ দশমিত ৬০ মিলিয়ন টন। মালয়েশিয়ান পাম অয়েল কাউন্সিলের তথ্যমতে, দেশটিতে গত মার্চে পাম অয়েলের মজুদ ছিল ১ দশমিক ৪৭ মিলিয়ন টন। অন্যদিকে ২০২২ সালের জানুয়ারি-মার্চ সময়ে বাংলাদেশ মালয়েশিয়া থেকে রেকর্ড পরিমাণ ৮৮ হাজার ১৮৫ টন পাম অয়েল আমদানি করে। ২০২১ সালের একই সময়ে আমদানি ছিল ৪৫ হাজার ৪৪৬ টন।