নিক্কেই এশিয়ার প্রতিবেদন

বহুমুখী সংকটে হুমকিতে বাংলাদেশের পোশাকখাত

দ্য রিপোর্ট ডেস্ক

মে ৩০, ২০২৫, ০২:৩৪ পিএম

বহুমুখী সংকটে হুমকিতে বাংলাদেশের পোশাকখাত

ছবি: সংগৃহীত

বাংলাদেশের রপ্তানিনির্ভর তৈরি পোশাক (আরএমজি) খাত গত এক বছরে ১০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে। তবে এই খাত বর্তমানে একাধিক জটিল সংকটে আক্রান্তযুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক বৃদ্ধি, ভারতের বাণিজ্য প্রতিবন্ধকতা এবং অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অস্থিরতা এ শিল্পের টেকসই প্রবৃদ্ধিকে গুরুতর হুমকির মুখে ফেলেছে।

জাপানভিত্তিক সংবাদমাধ্যম নিক্কেই এশিয়ার এক প্রতিবেদনে এই তথ্য জানানো হয়।

এতে বলা হয়, দেশের মোট রপ্তানির প্রায় ৮০ শতাংশ আসে এই খাত থেকে, যেখানে লাখ লাখ শ্রমিকের কর্মসংস্থান জড়িত। তবে চলতি বছরের ১৭ মে ভারত সীমান্তবর্তী স্থলবন্দরগুলো দিয়ে বাংলাদেশের তৈরি পোশাকসহ কিছু পণ্যের আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা জারি করে। এই পদক্ষেপটি বাংলাদেশ কর্তৃক ভারতীয় সুতা আমদানিতে আরোপিত নিষেধাজ্ঞার জবাবে দেওয়া হয়। এতে বাংলাদেশের ভারতের বাজারে রপ্তানির প্রায় ৪২ শতাংশ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে, ফলে রপ্তানিকারকদের ব্যয়বহুল ও সময়সাপেক্ষ সমুদ্রপথ ব্যবহার করতে হচ্ছে।

এদিকে যুক্তরাষ্ট্র এরই মধ্যে বাংলাদেশের পণ্যে অতিরিক্ত ১০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছে, যা ৩৭ শতাংশ পর্যন্ত বাড়তে পারে। যদিও ট্রাম্প প্রশাসনের এই শুল্ক আরোপকে মার্কিন আন্তর্জাতিক বাণিজ্য আদালত অনৈতিক বলে মন্তব্য করেছে, তবে এখনও তা প্রত্যাহার হয়নি।

বাংলাদেশ নিটওয়্যার প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিকেএমইএ) সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, ‘আমরা অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক উভয় দিক থেকেই সংকটে আছি। নীতিগত সহায়তার ঘাটতি, উচ্চ সুদের হার, গ্যাস সংকট, উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি এবং আমদানি-রপ্তানিতে প্রতিবন্ধকতা শিল্পকে চাপে ফেলেছে।’  

গ্যাস ঘাটতির কারণে অনেক টেক্সটাইল কারখানার উৎপাদন সক্ষমতা ৩০ থেকে ৪০ শতাংশে নেমে গেছে। সেই সঙ্গে জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি ও এনবিআর কর্মকর্তাদের ধর্মঘট ব্যবসা-বাণিজ্যে বড় ধরনের বিঘ্ন সৃষ্টি করছে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, ভারতের এসব পদক্ষেপ মূলত দুই দেশের রাজনৈতিক সম্পর্কের অবনতির প্রেক্ষাপটে এসেছে। গত বছরের আগস্টে শেখ হাসিনার পদত্যাগের পর দুই দেশের মধ্যে টানাপোড়েন বৃদ্ধি পেয়েছে। এর জেরে ভারত ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা স্থগিত করে, যার প্রভাব গার্মেন্টস রপ্তানিতে পড়ছে।

জায়ান্ট গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও বিজিএমইএ-এর সাবেক সভাপতি ফারুক হাসান বলেন, ‘ভারতের ট্রান্সশিপমেন্ট বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সরাসরি ফ্লাইট না থাকা দেশগুলোতে রপ্তানি ব্যয় বেড়েছে ও সময়ও বেশি লাগছে।’

বিজিএমইএ-এর তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৫ সালের মার্চ পর্যন্ত ভারত হয়ে ৩৬টি দেশে ৩৪,৯০০ মেট্রিক টন পোশাক রপ্তানি করেছে বাংলাদেশ, যার মূল্য প্রায় ৪৬২ দশমিক ৩৪ মিলিয়ন ডলার।

রাজনৈতিক অস্থিরতা ও ধর্মঘটও বড় প্রতিবন্ধকতা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সরকারি কর্মচারী থেকে শুরু করে পোশাকশ্রমিকরা নিয়মিত আন্দোলনে অংশ নিচ্ছেন, ফলে সরকারের মনোযোগ মূলত এসব দমনেই ব্যস্ত, বাণিজ্য নীতিনির্ধারণে নয়।

এই পরিস্থিতির মধ্যেও জুলাই ২০২৪ থেকে এপ্রিল ২০২৫ পর্যন্ত সময়ে তৈরি পোশাক খাত ৩২ দশমিক ৬৪ বিলিয়ন ডলারের রপ্তানি আয় করেছে, যা আগের বছরের তুলনায় ১০ শতাংশ বেশি।

হাতেম বলেন, ‘আমাদের উদ্যোক্তারা কঠোর পরিশ্রম করছেন, নতুন বাজার খুঁজছেন, পণ্যের মান ও বৈচিত্র্য বাড়াচ্ছেন। ক্রেতারাও আমাদের ওপর আস্থা রাখছেন।’

তবে সব কিছুর পরেও ছোট ও মাঝারি কারখানাগুলো মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ফারুক হাসান বলেন, ‘ছোট কারখানাগুলো রক্ষা না করলে ভবিষ্যতে পুরো খাত বিপদে পড়বে। কারণ এদের মধ্য থেকেই বড় শিল্প গড়ে ওঠে।’

বর্তমান রাজনৈতিক ও বাণিজ্যিক অনিশ্চয়তা চলতে থাকলে এই প্রবৃদ্ধি ধরে রাখা কঠিন হয়ে পড়বে বলেও তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেন।

এমন প্রেক্ষাপটে ব্যবসায়ীরা ২০২৫ সালের নভেম্বরে নির্ধারিত বাংলাদেশের স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে উত্তরণ পেছানোর দাবি জানিয়েছেন, যাতে শুল্কমুক্ত সুবিধা কিছু সময়ের জন্য বজায় থাকে। যদিও যুক্তরাজ্য ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন তিন বছর, চীন দুই বছর এবং কানাডা ২০৩৪ সাল পর্যন্ত এই সুবিধা অব্যাহত রাখবে।

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশিষ্ট ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘এই পরিবর্তনের প্রস্তুতি নিতে হলে আমাদের দক্ষতা ও উৎপাদনশীলতা বাড়াতে হবে, পণ্যে বৈচিত্র্য আনতে হবে এবং মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির দিকে দ্রুত এগোতে হবে।’

Link copied!