জুলাই ১১, ২০২৪, ০৬:০৮ এএম
প্রায় ১৭৫ কোটি ডলার বকেয়া থাকায় বিপাকে পড়েছে দেশের জ্বালানি ও বিদ্যুৎ বিভাগ। এলএনজি, জ্বালানি তেল ও বিদ্যুৎ আমদানির পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ কূপ থেকে গ্যাস উত্তোলন বাবদ বকেয়া থাকায় এই বিভাগ বিপাকে পড়েছে বলে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের (টিবিএস) প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছে।
সম্প্রতি জ্বালানি বিভাগের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ৭ জুলাই পর্যন্ত বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনের (বিপিসি) ২৩ কোটি এবং বাংলাদেশ তেল, গ্যাস ও খনিজ সম্পদ কর্পোরেশনের (পেট্রোবাংলা) ৭৮ কোটি ডলার বকেয়া তৈরি হয়েছে।
পেট্রোবাংলার এলএনজি আমদানি বাবদ বকেয়া রয়েছে ৪৫ কোটি ডলার। শেভরন দেশের ভেতরের গ্যাসক্ষেত্র থেকে উত্তোলন করা গ্যাস সরবরাহে সংস্থাটির কাছ থেকে পাবে ২৫ কোটি ডলার। অন্যদিকে ঋণদাতা সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক ট্রেড ফাইন্যান্স কর্পোরেশন (আইটিএফসি) পাবে ৮ কোটি ডলার। জ্বালানি বিভাগের ওই প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে এসব তথ্য জানায় দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড (টিবিএস)।
সূত্র জানায়, বিপিসি ও পেট্রোবাংলার বকেয়া তৈরির কারণ ডলার সংকট। এসব সংস্থার যদিও পর্যাপ্ত তহবিল রয়েছে, এগুলো বাংলাদেশ ব্যাংক ও অন্যান্য ব্যাংক থেকে প্রয়োজনীয় বৈদেশিক মুদ্রা পাচ্ছে না। পাশাপাশি বকেয়া দেনার জন্য জরিমানাও দিতে হচ্ছে।
বিদ্যুৎ বিভাগের সূত্র অনুযায়ী ভারতের আদানি গ্রুপ বিদ্যুৎ সরবরাহ বাবদ ৬০ কোটি ডলার পাবে। এছাড়া ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য থেকে সরবরাহকৃত বিদ্যুতের জন্য ১০ কোটি ডলার বিল রয়েছে বকেয়া। এর বাইরে কলয়া আমদানির বিলও বকেয়া আছে বলে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে (টিবিএস) জানিয়েছে জ্বালানি বিভাগ সূত্র।
এর আগে গত ৭ জুলাই চলমান সমস্যাগুলো সমাধানের জন্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ। চীন সফর শেষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেশে ফেরার পর তাকে এসব বিষয়ে জানানো হবে বলেও উল্লেখ করেন তিনি। বকেয়া নিষ্পত্তির জন্য প্রয়োজনীয় বৈদেশিক মুদ্রা সংগ্রহের উদ্যোগ নেওয়ার পরিকল্পনার কথাও জানান প্রতিমন্ত্রী।
বৈঠকের একদিন পর ৮ জুলাই জ্বালানি সচিব মো. নূরুল আলম টেলিফোনে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে (টিবিএস) বলেন, “চলতি বছর বিদ্যুৎ খাতে বেশি গ্যাস সরবরাহ করা হয়েছে ও স্পট মার্কেটে দাম কমার কারণে এলএনজি সরবরাহ বেড়েছে। এতে জ্বালানি তেলের ওপর চাপ কমেছে। এর ফলে এলএনজি আমদানির বিল বকেয়া বেড়েছে। এটা স্বাভাবিক ও আমরা এর মোকাবিলায় বিশেষ উদ্যোগ নিচ্ছি।”
পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান জনেন্দ্র নাথ সরকারও ৮ জুলাই দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে (টিবিএস) বলেন, “বাংলাদেশ ব্যাংক আমাদেরকে পর্যায়ক্রমে বৈদেশিক মুদ্রা সরবরাহ করছে। এবার একটু বেশি (বকেয়া) জমে গেছে। আমরা আশা করছি, কেন্দ্রীয় ব্যাংক দ্রুত ডলার সরবরাহ শুরু করবে এবং সমস্যার সমাধান হবে।”
তিনি আরও বলেন, “উদ্বেগের কোনো কারণ নেই। এপ্রিল, মে ও জুন মাসে গরমের কারণে গ্যাসের সরবরাহ বেশি ছিল। যার ফলে কার্গো বেড়েছে ও বকেয়ার পরিমাণ বেড়েছে। আশা করি, জুলাইয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক সময়মতো ডলার সরবরাহ করলে আমাদের এসব বকেয়া ধীরে ধীরে পরিশোধ করতে পারবো।”
জ্বালানি তেল ও এলএনজির মতো প্রয়োজনীয় পণ্য আমদানির জন্য সোনালী ব্যাংককে ডলার দেওয়ার কথা ছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংকের। তবে মে মাসের মধ্যভাগ থেকে এই খাতে ডলার সরবরাহ বন্ধ রেখেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
সরকারি সংস্থার আমদানির বেশির ভাগ হয় সোনালী ব্যাংকের মাধ্যমে। রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকটির একজন কর্মকর্তা নামপ্রকাশ না করার শর্তে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে (টিবিএস) বলেন, “আইএমএফের শর্ত অনুযায়ী বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ধরে রাখতে গিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক চাহিদা অনুযায়ী ডলার সরবরাহ করছে না আগে থেকেই। তবে গত ফেব্রুয়ারি থেকে সরবরাহের মাত্রা আরও বেশি কমানো হয়েছে। মে মাসের মাঝামাঝি সময় থেকে ডলার সরবরাহ কার্যত বন্ধ রাখা হয়েছে। ফলে সোনালী ব্যাংক বিদেশি বিভিন্ন ব্যাংকের জরিমানার মুখে পড়ছে।”
আইএমএফ (আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল) থেকে ৪৭০ কোটি ডলার ঋণ নিচ্ছে বাংলাদেশ। বেশ কয়েকটি শর্ত বাস্তবায়ন সাপেক্ষে সাত কিস্তিতে এ ঋণ ছাড় করবে আইএমএফ। প্রতি কিস্তি ছাড়ের আগে শর্তগুলোর বাস্তবায়ন অগ্রগতি দেখে নেয় আইএমএফ। এজন্য চলতি বছর এপ্রিলের শেষ সপ্তাহে আইএমএফের একটি প্রতিনিধি দল বাংলাদেশ সফর করে।
আইএমএফের শর্ত অনুযায়ী জুনের শেষে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ২০১৯ কোটি ডলার রাখার কথা ছিল। কিন্তু এ লক্ষ্য অর্জন করা সম্ভব হবে না বলে জানায় বাংলাদেশ ব্যাংক। এরপর আইএমএফ বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের লক্ষ্যমাত্রা কমিয়ে ১৪৭৫ কোটি ডলার নির্ধারণ করে দেয়।
আইএমএফের বেঁধে দেওয়া এই শর্ত পূরণে সব ধরনের বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় কমিয়ে এনেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। সরকারি ও বেসরকারি ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার চাহিদা থাকলেও সরবরাহে লাগাম টেনে ধরে রেখেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
জানা গেছে, জ্বালানি আমদানির দায় পরিশোধে প্রতিদিন বাংলাদেশ ব্যাকের আড়াই কোটি ডলার দেওয়ার কথা। কিন্তু তার বদলে সোনালী, জনতা, অগ্রণী ও রূপালী ব্যাংককে বাংলাদেশ ব্যাংক ডলার সংগ্রহ করে দেওয়ার নির্দেশনা দিয়েছে। কিন্তু এ ব্যাংকগুলোর নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় যে পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা আছে, তা থেকে জ্বালানি আমদানির পুরো দায় মেটানো সম্ভব হচ্ছে না। ফলে বকেয়া বেড়ে যাচ্ছে।
বিপিসি সূত্রে জানা গেছে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বাংলাদেশ ৪৮ কোটি ৮০ লাখ মেট্রিক টন পরিশোধিত জ্বালানি তেল এবং ১৩ কোটি ১৪ লাখ মেট্রিক টন অপরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানি করেছে।
পেট্রোবাংলা চলতি বছরের ৩ জুলাই পর্যন্ত স্পট মার্কেট থেকে ২১টি এলএনজি কার্গো কিনেছে। একই সময়ে রাষ্ট্রীয় চুক্তির অধীনে কাতার ও ওমান থেকে অতিরিক্ত ২১টি কার্গো আমদানি করা হয়েছে।