ব্যবসায়ীদের ‘অতি মুনাফাপ্রবণতা’র কারণে সয়াবিন তেলের দামে কারসাজি

দ্য রিপোর্ট ডেস্ক

মে ৫, ২০২৩, ০১:০৬ পিএম

ব্যবসায়ীদের ‘অতি মুনাফাপ্রবণতা’র কারণে সয়াবিন তেলের দামে কারসাজি

সয়াবিন তেলের সরবরাহে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে সরকারকে চাপ দিয়ে দাম বাড়িয়ে ব্যবসায়ীরা 'অতি মুনাফা' করছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।

নিত্যপ্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্য এই রিফাইন্ড ও খোলা সয়াবিন তেল নিয়ে ব্যবসায়ীদের কারসাজির কারণে নিম্ন আয়ের বিশাল জনগোষ্ঠী একটি পণ্যে বাড়তি ব্যয়ের পর মাসিক আয় ও ব্যয়ে ভারসাম্য হারাবে।

দেশের ১৭ কোটি মানুষের জন্য বাৎসরিক সয়াবিন তেলের চাহিদার পরিমাণ প্রায় ২১ লাখ মেট্রিক টন। সামান্য দেশীয় উৎপাদন বাদ দিলে এর প্রায় পুরোটাই আমদানি করতে হয়।

এবার দেখা যাক, ব্যবসায়ীরা অতি মুনাফা কিভাবে করছে।

অংকটা এমন যে ২০২০ সালের মে মাসে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতি মেট্রিক টন সয়াবিন তেলের দাম ছিল ৮৩৮ মার্কিন ডলার। সে সময় ডলারের বিনিময় মূল্য ৮৫ টাকা ধরে প্রতি লিটার সয়াবিন তেলের দাম পড়তো ৭১ টাকা ২৩ পয়সা। আর বাংলাদেশে সেইসময় সয়াবিন তেল বিক্রি হতো (বোতলজাত) ১০৪ থেকে ১১০ টাকা। আর খোলা সয়াবিন তেলের দাম ছিল ৮৫ থেকে ৯০ টাকার মধ্যে। 

এখন কথা হলো, ৭১ টাকা ২৩ পয়সা দরে আন্তর্জাতিক বাজার থেকে রিফাইন্ড সয়াবিন তেল কিনে এনে দেশের ব্যবসায়ীরা খোলা ও বোতলজাত যথাক্রমে ৮৫ ও ১১০ টাকায় বিক্রি করেও মুনাফা করতো। এর মধ্যে একজন ব্যবসায়ীকে আমদানি ব্যয়, ভ্যাট, শুল্কসহ বাজারজাত করণের ব্যয় নির্বাহ করতো।

২০২৩ সালের মে মাসে এসে আন্তর্জাতিক বাজারে রিফাইন্ড সয়াবিন তেলের দাম প্রতি টন ১০৮৫ মার্কিন ডলার হিসেবে লিটার প্রতি ক্রয়মূল্য দাঁড়ায় ১১৩ টাকা ৯৩ পয়সা (ডলারের বিনিময় মূল্য ১০৫ টাকা দরে)। বাজারজাত করতে একজন ব্যবসায়ীকে আমদানী ব্যয়, ভ্যাট, শুল্কসহ একই ব্যয় নির্বাহ করতে হচ্ছে। কিন্ত ১১৩ টাকা দরে কেনা এক লিটার সয়াবিন তেল ব্যবসায়ীরা বিক্রি করছে ১৭৬ টাকা (খোলা) ও ১৯৯ টাকা (বোতলজাত)।

এখানে খোলা ও বোতলজাত তেলে ক্রয় ও বিক্রয়মূল্যের ব্যবধান যথাক্রমে ৬২ টাকা ও ৮৬ টাকা। এই ব্যবধান ২০২০ সালে ছিল যথাক্রমে ১৮ টাকা ও ৩৮ টাকা।

তাহলে দু বছর আগে খোলা ও বোতলজাত সয়াবিন তেলে ক্রয় ও বিক্রয়মূল্যের পার্থক্য ১৮ ও ৩৮ টাকা থেকে ২০২৩ সালে এসে একই ব্যবধান বেড়ে দাঁড়িয়েছে যথাক্রমে ৬২ ও ৮৬ টাকা।

এ বৈষম্যমূলক ব্যবধান নিয়ে কনজুমার এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) এর সভাপতি সাবেক সচিব গোলাম রহমান দ্য রিপোর্ট ডট লাইভকে বলেন, "এই যে ব্যবধান, এতেই বুঝা যায় ব্যবসায়ীরা অতি মুনাফাপ্রবণ হয়ে উঠেছে। আন্তর্জাতিক বাজারের দামের সাথে সঙ্গতি রেখে তার ডিভিডেন্ড ভোক্তাকে দেয়া উচিত। আর এটাই দেখার জন্য সরকারের ডেডিকেটেড এজেন্সি রয়েছে।"

তিনি বলেন, "সব খরচের সাথে টাকার অবমূল্যায়ন যোগ করা হলেও এটি অতিরিক্ত মুনাফা।"

এ বিষয়ে বাংলাদেশ ট্রেড এন্ড ট্যারিফ কমিশনের চেয়ারম্যান মো. ফয়জুল ইসলামের বক্তব্য জানতে একাধিকবার ফোনে চেষ্টা করা হয়। কিন্ত তিনি ফোন রিসিভ করেননি।

সর্বশেষ ৩ মে বুধবার ট্যারিফ কমিশন ব্যবসায়ীদের সাথে আলোচনাপূর্বক সয়াবিন তেলের নতুন দর ঠিক করে দেয়। এর প্রেক্ষিতে ব্যবসায়ীদের প্রতিনিধিত্বশীল সংগঠন বাংলাদেশ ভেজিটেবল অয়েল রিফাইনার্স এন্ড বনস্পতি ম্যানুফ্যাকচারার্স এসোসিয়েশন গণমাধ্যমকে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে সয়াবিনের সমন্বিত নতুন দামের উল্লেখ করে। নতুন দর অনুযায়ী, প্রতি লিটার খোলা সয়াবিন ১৭৬ টাকা, বোতলজাত ১৯৯ টাকা ও পাম অয়েল ১৩৫ টাকা করে বিক্রির সিদ্ধান্ত জানায় সংগঠনটি।

বিজ্ঞপ্তির কপি বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও ট্যারিফ কমিশনকেও পাঠানো হয়েছে বলে সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়।

এদিকে, অন্যান্য নিত্যপণ্যের সাথে দফায় দফায় সয়াবিন তেলের দাম উচ্চমাত্রায় বৃদ্ধির ফলে নিম্ন আয়ের মানুষের দুর্ভোগ চরমে উঠেছে।

রাজধানীর মহানগরের বাসিন্দা পেশায় নির্মাণশ্রমিক জাকির হোসেন বলেন, তেল, চিনি, পেঁয়াজ আর সবজির বাজারে গেলে পকেটের টাকায় কুলায় না। বাজারে আর যেতে মন চায় না।"

ঢাকার পল্টনে একটি প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরি করেন শফিকুল ইসলাম। তিনি বলেন, "গত তিন বছরে একবারও বেতন বাড়েনি। বাজার খরচ মেটাতে হিমসিম খাই। আমি বনশ্রী থেকে হেঁটে পল্টনে অফিস করি। এতে করে কয়টা টাকা বাঁচে। তা দিয়ে সংসারের জন্য খরচ করি।"

২০২২ সালের ৩০ আগস্ট বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি সাংবাদিকদের বলেছিলেন, এখন থেকে আন্তর্জাতিক বাজারদর ও অভ্যন্তরীণ উৎপাদন ও সরবরাহ পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে ৯টি পণ্যের যথার্থ দাম নির্ধারণ করে দেবে সরকার।

পণ্যগুলো হলো- চাল, আটা, ময়দা, তেল, চিনি, মসুর ডাল, ডিম, সিমেন্ট ও রড।

গত বছর বাজেট ঘোষণার দিন সয়াবিন তেলের দাম হঠাৎ করেই ২০০ টাকায় উঠে যায়। এরপর দফায় দফায় ব্যবসায়ীদের সাথে আলাপ করে অবশেষে ৩০ আগস্ট বাণিজ্যমন্ত্রী সরকার কর্তৃক ৯ পণ্যের দাম নির্ধারণ করার কথা ঘোষণা দেন।

এরপরও ব্যবসায়ীদের দাবির মুখে সরকার ভোজ্যতেল আমদানিতে মাত্র ৫ শতাংশ ভ্যাট রেখে বাকি সব শুল্ক, কর ও ভ্যাট প্রত্যাহার করে নেয়। 

সরকারের এ কর অব্যাহতির সুবিধার মেয়াদ শেষ হয় গত ৩০শে এপ্রিল। অতঃপর আবারও ভোজ্যতেলের দাম বাড়ালো ব্যবসায়ীরা।

ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি)'র হিসেবে বোতলজাত সয়াবিন তেল প্রতি লিটার ২০২০ সালের মে মাসের প্রথম সপ্তাহে ছিল ১০০ টাকা থেকে ১১০ টাকা ও ২০২১ সালের মে মাসে একই সময়ে দাম ছিল ১৩৫ থেকে ১৪০ টাকা।

আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কতো?

ইউএস সয়াবিন অয়েল ফিউচার ওভারভিউ কে কোড করে ইনভেস্টিং ডট কম বলছে মে ২০২২ এর তুলনায় সয়াবিন তেলের দাম ২০২৩ সালের মে মাসে ৪৭ দশমিক ১১ শতাংশ কমেছে। আগের মে মাসে প্রতি মেট্রিক টন দাম ছিল ১৯৬২ দশমিক ৮৮ মার্কিন ডলার। এ বছর দাম নেমে এসেছে ১০২৯ দশমিক ৯৭ ডলার থেকে ১০৮৫ ডলারে।

এগ্রিওয়াচ এর রিপোর্ট বলছে প্রতিবেশী ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে প্রতি ১০ লিটার সয়াবিন তেলের দাম কমবেশি ১০৫৫ টাকা থেকে ১১১০ টাকার মধ্যে। সে হিসেবে লিটারপ্রতি দাম হয় ১০৫ ও ১১০ টাকা।

সর্বোচ্চ সয়াবিন উৎপাদনকারী দেশ চীনের 'চায়না সয়াবিন অয়েল ফিউচার প্রাইস' এর তথ্য বলছে, চীনে মে ৪ তারিখের স্পট মার্কেট প্রাইস অনুযায়ী এক টন রিফাইন্ড সয়াবিন তেল ৭ হাজার ৪৯৮ ইউয়ান বা ১ হাজার ৮৩ মার্কিন ডলার ৮৫ সেন্ট এ ক্রয় বিক্রয় হচ্ছে। 

চীনের পর সয়াবিনের বৃহৎ উৎপাদন ও সরবরাহকারী দেশ হলো যুক্তরাষ্ট্র, ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ভারত ও মেক্সিকো।

Link copied!