রপ্তানিতে আশা দেখাচ্ছে পশুর অণ্ডকোষ, লিঙ্গ, হাড়সহ অঙ্গবর্জ্য

গোলাম রাব্বানী

জুলাই ৩, ২০২৩, ০৩:০৯ পিএম

রপ্তানিতে আশা দেখাচ্ছে পশুর অণ্ডকোষ, লিঙ্গ, হাড়সহ অঙ্গবর্জ্য

ছবি: দ্য রিপোর্ট ডট লাইভ

কোরবানির মাংস ও চামড়ার কদর সবারই জানা। যদিও গত কয়েক বছর ধরে চামড়ার বাজারে মন্দা। কিন্তু এমন পরিস্থিতির মধ্যে আশা দেখাচ্ছে কোরবানির পশুর ফেলে দেওয়া বর্জ্যগুলো। বিশেষ করে গরু, মহিষ, ছাগল ও ভেড়ার হাড়, শিং, অণ্ডকোষ, নাড়িভুঁড়ি, মূত্রথলি, পাকস্থলী ও চর্বি আর ফেলনা থাকছে না! সাধারণত কোরবানির পর পশুর এই বর্জ্যগুলো ফেলে দেওয়া হলেও এখন আর তা করতে হচ্ছে না। কারণ এসব বর্জ্য থেকেই হচ্ছে শতকোটি টাকার বাণিজ্য।

গত কয়েক বছর ধরেই পশুর এই বর্জ্যগুলো বিদেশে রপ্তানি হচ্ছে। এরমধ্যে থাইল্যান্ড, মিয়ানমার, জাপান ও চীনে গরু-মহিষের পেনিস বা লিঙ্গ অত্যন্ত দামি বস্তু। এ দিয়ে তৈরি স্যুপ ওইসব দেশে খুবই জনপ্রিয় ও দামি খাবার। ওষুধ তৈরির কাঁচামাল হিসেবেও তারা ব্যবহার করে পশুর অন্যান্য বর্জ্যগুলো। এসব দেশে পশুর একেকটি লিঙ্গ ৮-১০ ডলারে বিক্রি হয়। এ ছাড়া গরু-মহিষের দাঁত ও হাড় থেকে তৈরি হয় ক্যাপসুলের কাভার।

কোরবানির পশুর এসব হাড়, তেল-চর্বি ও লিঙ্গের রমরমা ব্যবসা চলছে বেশ কয়েক বছর ধরেই। বাংলাদেশ রফতানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) ও বাংলাদেশ মাংস ব্যবসায়ী সমিতি সূত্রে  জানা যায়, গত বছর বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পশুর বর্জ্য রপ্তানিতে আয় হয়েছে প্রায় ২০০ কোটি টাকা। এবার এই ব্যবসা আরও বেশি হবে বলে আশা করছেন উদ্যোক্তারা। এখন এই ব্যবসার সাথে জড়িত ব্যবসায়ীদের ব্যস্ত সময় কাটছে। বিশেষ করে নগরীর হাজারীবাগ ও কামরাঙ্গীরচর এলাকার পশুর হাড়ের বেপারিরা এখন ব্যস্ত সময় পার করছেন।

লিঙ্গ ও অণ্ডকোষ রাখা হচ্ছে হিমাগারে

বিভিন্নি দেশে পশুর একেকটি লিঙ্গ ৮-১০ ডলারে বিক্রি হয়। তবে শুকিয়ে বিক্রি না করে গত বছর থেকে ফ্রিজারে রেখে দেওয়া হচ্ছে লিঙ্গ ও অণ্ডকোষ। কেন না এই সময়ে যোগান বেশি থাকায় দাম কম দিচ্ছে আমদানিকারক দেশগুলো। তাই ফ্রিজারে সংরক্ষণ করে পরে বিক্রি করার পরিকল্পনা করা হচ্ছে।

হাজারীবাগে সরেজমিনে দেখা যায়, একেকটি লিঙ্গ ৫০ থেকে ৮০ টাকা দরে ক্রয় করছেন আড়তদাররা। এক ব্যবসায়ী জানালেন, লিঙ্গ শুকালে এটাতে কেমিকেল দেওয়া লাগে। তাই ইউরোপের দেশগুলোতে রপ্তানি করা যেত না। গত বছর থেকে আমরা ফ্রিজারে রাখার চেষ্টা করছি। যাতে কেমিকেল ছাড়াই সঠিক মূল্য আমরা পাই।

বাড়েনি হাড়ের দাম

গরু-মহিষের দাঁত ও হাড় থেকে তৈরি হয় ক্যাপসুলের কাভার। রাজধানীতে রয়েছে পশুর বর্জ্যের বিশাল বাজার। বুড়িগঙ্গা নদীর ওপারে কেরানীগঞ্জে রয়েছে দুটি বাজার। একটি জিঞ্জিরায়, অন্যটি হাসনাবাদ এলাকায়। আগে কেবল ঢাকার আশপাশ থেকে এই বাজারে শিং ও হাড় এলেও এখন দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকেই এই বাজারে আসছে গরু-মহিষের শিং ও হাড়।

হাজারীবাগ ঘুরে দেখা গেছে, রাজধানীর গুলশান, মহাখালী, পুরান ঢাকাসহ সারাদেশের বিভিন্ন এলাকায় বর্জ্য হিসেবে ফেলে দেওয়া পশুর বিভিন্ন অঙ্গ কসাই, পথশিশু, পরিচ্ছন্নকর্মী ও ফেরিওয়ালারা সংগ্রহ করে দোকানে বিক্রি করছে। ভেজা হাড়, মাথা, দাঁতের প্রতি কেজি ৮ থেকে ১০ টাকা আর শুকনো হাড় ১৫ থেকে ২০ টাকা কেজি দরে লেনদেন হচ্ছে।

আবিদান ব্রাদার্সের কর্ণধার ভোলা মিয়া বললেন, এখন পর্যন্ত হাড় ও শিংয়ের বাজার নীতিমালার অধীনে আসেনি। যে কারণে এ থেকে যে পরিমাণ আয় করা যেত তা হচ্ছে না। সরকার এই খাতে বিশেষ স্বীকৃতি দিলে রাজস্ব আয়ও বাড়ত।

রক্তও বিক্রি হয় কেজিদরে

পশুর অণ্ডকোষ ৪০ টাকা, শিং ১৫ টাকা কেজি দরে বিক্রিই শুধু নয়, চর্বি বিক্রি করা হয় ৩০ থেকে ৬০ টাকায়। সাবান তৈরিতে ব্যবহার হয় এই চর্বি। রক্ত প্রতি কেজি ৮ থেকে ১৫ টাকা। রক্ত শুকিয়ে পোল্ট্রি ও পাখির খাবার তৈরি হয়।

হাজারীবাগের এক আড়তের মালিক বললেন, হাড় ওষুধ কোম্পানির কাছে বিক্রি করা হবে। প্রতি টন ২৩ হাজার থেকে ৩০ হাজার টাকায় প্রতি টন বিক্রি করা হয়।

হাড় গুঁড়া করার নিজস্ব মেশিন আছে জানিয়ে ওই ব্যবসায়ী আরও বলেন, দেশে প্রায় ১৫০ ওষুধ কোম্পানি ও হারবাল প্রতিষ্ঠান তাদের ব্যবহারের জন্য প্রতি মাসে ৩০ থেকে ৪০ কোটি ক্যাপসুল তৈরি করে থাকে। বেশ কিছু কোম্পানি গুঁড়া করা হাড় থেকে ক্যাপসুলের সেল তৈরি করে। এতে প্রতি মাসে টনে টনে পশুর হাড় প্রয়োজন হয়। জাপান, কোরিয়া, চীন, জার্মানির সবচেয়ে জনপ্রিয় খাদ্য সুসেড রুলসহ বিভিন্ন ধরনের খাবার অণ্ডকোষ দিয়ে তৈরি হয়।

নানা কাজে লাগে এই বর্জ্য

পশুর হাড় দিয়ে ওষুধ ক্যাপসুলের কাভার, মুরগি ও মাছের খাবার, জৈব সার, চিরুনি ও পোশাকের বোতাম তৈরি হয়। নাড়ি দিয়ে অপারেশনের সুতা, রক্ত দিয়ে পাখির খাদ্য, চর্বি দিয়ে সাবান, অণ্ডকোষ দিয়ে তৈরি হয় জাপানের সবচেয়ে জনপ্রিয় খাদ্য সুসেড রুল। গরুর রক্ত শুকিয়ে ব্লাড মিল তৈরি করা যায়। সিরামিক শিল্পের কাঁচামাল হিসেবেও হাড় ব্যবহৃত হয়। এছাড়া জার্মানি ও ইতালিতে ব্যাপক চাহিদা থাকায় পশুর শিং সরবরাহ করা হয়ে থাকে।

গরু, মহিষ ও ছাগলের শিং ভারতে রফতানি হয়। শিং দিয়ে বিভিন্ন কারুপণ্য তৈরি করা হয়। এছাড়া মাথার হাড় দিয়ে মেলামাইন তৈরিসহ অন্যান্য কাজে ব্যবহার করা হয়। পশুর শিং দিয়ে তৈরি হয় চিরুনি, বোতাম, এক্স-রে ফিল্ম, ক্যামেরার ফিল্ম, ঘর সাজানোর দ্রব্য।

বাড়ছে ব্যবসার পরিধি

ইপিবিরে তথ্য অনুযায়ী, গত বছর (২০২২ সালে) ২০০ কোটি টাকার বেশি পশুর হাড়, যৌনাঙ্গ ও গোল্লা বিভিন্ন দেশে রফতানি হয়েছে।

বাংলাদেশ মাংস ব্যবসায়ী সমিতির তথ্য অনুযায়ী, গত বছর শুধু কোরবানির পশু থেকে দেড় হাজার মণ হাড়, সাত হাজার কেজি লিঙ্গ ও ৭০০ মণ গোল্লা (নাড়িভুঁড়ি) সংগ্রহ করা হয়েছিল। সাধারণভাবে সমিতি সারাদেশ থেকে মাসে আড়াইশ’ মণ হাড় সংগ্রহ করতে পারে। সেই হিসেবে বছরজুড়ে সংগ্রহ করা হাড়ের এক-তৃতীয়াংশই আসে কোরবানির সময়। এ কারণে এ সময় বর্জ্য সংগ্রহে লোকবল বাড়ানো হয়।

স্থানীয়রা জানান, আগে টোকাইদের কাছ থেকে নগদ টাকা দিয়ে এসব বর্জ্য কেনা হতো। তবে এখন সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের কাছ থেকেই কেনা হয় এগুলো। সব মাল একসাথে ট্রাকে করে নিয়ে যাওয়া হয় সীমান্তে। ওপারের ব্যবসায়ীরা এসে সেখান থেকে মাল নিয়ে যান। অনেক সময় ব্যবসায়ীদের প্রতিনিধি থাকেন। তাদের দিয়েও মাল পাঠিয়ে দেওয়া হয়। হাড় ও শিং একটু বেশি পরিষ্কার হলে ভালো দাম পাওয়া যায়।

রাজধানীর হাজারীবাগ, কামরাঙ্গীরচর ছাড়াও হাড় ভাঙার কারখানা আছে যাত্রাবাড়ী ও মৃধাবাড়ী এলাকায়। চট্টগ্রামের কালুরঘাট শিল্প এলাকায় গড়ে উঠেছে চারটি হাড়ের কারখানা। খুলনা মহানগরীর লবণচরা এলাকায় রূপসা নদীর তীর ঘেঁষে গড়ে ওঠা ৩টি হাড় কারখানা প্রতিবছর দেড় কোটি টাকার হাড় বিদেশে রফতানি ও স্থানীয় বাজারে বিক্রি করছে। ৩টি কারখানাই বর্তমানে লাভজনকভাবে চলছে। এছাড়া সৈয়দপুর, বরিশাল, যশোরসহ দেশের বিভিন্ন জেলা শহরেও এখন হাড়ের কারখানা গড়ে উঠেছে।

Link copied!