পুরাণে, ইতিহাসে কামরূপ-কথা

হাসনাত আসিফ কুশল

এপ্রিল ২৩, ২০২৪, ১২:১৮ পিএম

পুরাণে, ইতিহাসে কামরূপ-কথা

ছবি: সংগৃহীত

কামরূপ-কামাখ্যা নিয়ে আছে অজস্র কৌতুহল। আছে নানা প্রশ্ন। ভারতের আসাম রাজ্যের একটি জেলার নাম কামরূপ। আর কামাখ্যা হলো ওই জেলায় অবস্থিত একটি মন্দিরের নাম।

আসামের গুয়াহাটি শহর থেকে পশ্চিমের দিকে গিয়ে নীলাচল পাহাড়ের চূড়ায় আছে কামরূপ কামাখ্যা মন্দির। সনাতন বিশ্বাস মতে, এই মন্দির অত্যন্ত পবিত্র একটি শক্তিপীঠ।

এই মন্দিরকে ৫১ সতীপীঠের একটি বলে বিশ্বাস করা হয় এবং মনে করা হয়, শিব যখন প্রলয়নৃত্য করেছিলেন, তখন মা পার্বতীর যোনির অংশটি এই স্থানে পড়েছিল।

গর্ভ এবং যোনির অংশ পড়ার কারণে এই স্থান বিশেষভাবে পূজিত হয়ে থাকে। সন্তান লাভের আকাঙ্ক্ষায় কিংবা অন্য কোনো মনোস্কামনায় নিঃসন্তান দম্পতিকে এখানে আসতে দেখা যায়।

যেভাবে হলো শক্তিপীঠ
হিন্দু পুরাণ অনুসারে, সতী দেবী তার বাবা দক্ষ রাজার অমতে বিয়ে করেছিলেন দেবাদিদেব মহাদেবকে। প্রতিশোধপরায়ণ দক্ষ রাজা এক যজ্ঞের আয়োজন করেছিলেন। আর সেই যজ্ঞে সবাই আমন্ত্রিত হলেও সতী ও মহাদেব কাউকেই নিমন্ত্রণ করেননি তিনি। মহাদেবের অনিচ্ছা সত্ত্বেও বাবার সেই শিবহীন যজ্ঞানুষ্ঠানে যান সতী। সেখানে মহাদেবকে অপমান করেন দক্ষ রাজা। সহ্য করতে না পেরে যজ্ঞে দেহত্যাগ করেন সতী। শোকে ক্রুদ্ধ মহাদেব যজ্ঞ ভণ্ডুল করে দিয়ে সতী দেবীকে তুলে নেন এবং প্রলয় নৃত্য শুরু করেন। মহাদেবের তাণ্ডব বন্ধ করতে অন্যান্য দেবতাদের অনুরোধে বিষ্ণুদেব তার সুদর্শন চক্র দিয়ে সতীদেবীর মরদেহ ছেদন করেন।

বিষ্ণুর ছেদন করে দেওয়া সতী দেবীর দেহখণ্ড ভারতীয় উপমহাদেশের ৫১টি জায়গায় পড়েছিল। সেসব স্থানেই গড়ে ওঠে একেকটি শক্তিপীঠ, যা সতীপীঠ নামেও সমধিক পরিচিত। কামাখ্যা মন্দির সেই শক্তিপীঠের অন্যতম। কারণ দেবী সতীর গর্ভ এবং যোনির অংশ এখানে পড়েছিল।

যখন দেবীর এই দিন থেকে ঋতুস্রাব শুরু হয়, সেই দিন থেকে গর্ভগৃহের দরজা আপনাআপনি বন্ধ হয়ে যায়।

প্রকৃত ইতিহাস
প্রকৃতপক্ষে কামরূপ হলো আসাম রাজ্যের একটি জেলার নাম। প্রাচীন যুগে এটি একটি রাজবংশের নাম ছিল। ৩৫০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে ষোড়শ শতাব্দী পর্যন্ত ব্রহ্মপুত্র নদের উপত্যকা জুড়ে বিস্তৃত ছিল কামরূপ রাজাদের রাজত্ব। পরে অহম রাজা কামরূপ দখল করেন।

ভক্তের বিশ্বাসে প্রকট হন দেবী। ফাইল ছবি

কামাখ্যা মন্দিরের মাহাত্ম্য
দেবী কামাখ্যাকে উর্বরতার দেবী বলা হয়। মন্দিরটির চত্বরের বিশেষত্ব হলো এখানে দশ মহাবিদ্যার মন্দির আছে। কামাখ্যা মন্দিরের মূল অংশ মন্দিরের মধ্যে থাকা একটি পাহাড়ের গুহার ভেতরে। কামাখ্যা মন্দিরের চূড়াগুলো মৌচাকের মতো দেখতে। এসব মন্দিরে চারটি কক্ষ আছে। গর্ভগৃহ এবং চলন্ত, পঞ্চরত্ন ও নাটমন্দির নামে তিনটি মণ্ডপ। মণ্ডপগুলোর স্থাপত্য তেজপুরের সূর্যমন্দিরের সমতুল্য। খাজুরাহো বা অন্যান্য মধ্য ভারতীয় মন্দিরের আদলে খোদাইচিত্র দেখা যায়।

মন্দিরের গর্ভগৃহ পঞ্চরথ স্থাপত্য শৈলীতে নির্মিত, এটি ভূগর্ভস্থ একটি গুহা। ছোট এবং অন্ধকারাচ্ছন্ন গুহায় সরু খাঁড়া সিঁড়ি বেয়ে প্রবেশের সময় অন্যরকম এক অনুভূতি হয়। ভেতরে কোনো প্রতিমা নেই। ঢালু পাথরের একটি খণ্ড রয়েছে, যা যোনি আকৃতির। এটিতে প্রায় দশ ইঞ্চি গভীর গর্ত, ভূগর্ভস্থ প্রস্রবণের জল বেরিয়ে গর্তটি সবসময় ভর্তি রাখে। এই শিলাখণ্ড দেবী কামাখ্যা নামে পূজিত হন, যা দেবীর পীঠ হিসেবে প্রসিদ্ধ।

সনাতন ধর্মাবলম্বীদের বিশ্বাস, আষাঢ় মাসের মৃগ শিরা নক্ষত্রের তিনটি পদ (৭, ৮, ৯ তারিখ) শেষ হলে ধরিত্রী মা ঋতুমতী হয়। এই সময়ের মধ্যেই অম্বুবাচী পালন করা হয়। অম্বুবাচীর দিন থেকে তিন দিন দেবী কামাখ্যা মন্দির বন্ধ থাকে, কোনো মাঙ্গলিক কাজ করা যায় না। চতুর্থ দিন দেবীর স্নান ও পূজা শেষে মন্দিরে দেবী দর্শনের অনুমতি দেওয়া হয়।

অম্বুবাচী কি? কারা পালন করে থাকেন?
সাধারণত হিন্দু বিধবা কিংবা নারী-পুরুষ নির্বিশেষে ব্রহ্মচারীরা অম্বুবাচী পালন করে থাকেন। আষাঢ় মাসের ৭ তারিখের যেকোনো সময় এই অম্বুবাচী শুরু করা যায়। অম্বুবাচীতে শস্যজাতীয় খাবার না খেয়ে ৯ তারিখ পর্যন্ত থাকার নিয়ম আছে।

চলতি বছর অম্বুবাচী শুরু হবে ২২ জুন, বৃহস্পতিবার (বাংলা সন মোতাবেক ৬ আষাঢ়) ভোররাত দুইটা ৩২ মিনিটে। চলবে ২৬ জুন, সোমবার (বাংলা সন মোতাবেক ১০ আষাঢ়) দুপুর দুইটা ৫৬ মিনিট পর্যন্ত।

সনাতন ধর্মশাস্ত্র অনুযায়ী কোনো নারী রজঃস্বলা হলে সন্তান ধারণের উপযুক্ত হন।

অম্বুবাচী পালনের বিশেষ নিয়ম
অম্বুবাচীর ব্রত পালনের বিশেষ কিছু নিয়ম আছে:
১. অম্বুবাচী চলাকালীন বিভিন্ন মন্দির ও বাড়ির ঠাকুরঘরের মাতৃ শক্তি যেমন কালী, দুর্গা, জগদ্ধাত্রী, বিপত্তারিণী, শীতলা, চণ্ডীর প্রতিমা বা ছবি লাল কাপড় দিয়ে ঢেকে দেওয়া উচিত। অম্বুবাচী শেষ হওয়ার পর দেবীর আসন পাল্টে নিন। তারপর স্নান করিয়ে পূজা শুরু করতে পারেন।
২. অম্বুবাচী চলাকালীন পুজো করার সময় মন্ত্রপাঠ করা উচিত না। শুধুমাত্র ধূপ ও প্রদীপ জ্বালিয়ে প্রণাম করতে হয়।
৩. অম্বুবাচীতে গুরুপূজা করতে কোনো বাধা নেই। এমনকি গুরু প্রদত্ত মন্ত্রও অনায়াসে জপ করতে পারবেন।
৪. বাড়িতে তুলসী গাছ থাকলে তার গোড়া মাটি দিয়ে উঁচু করে রাখতে ভুলবেন না।
৫. কোনো শুভ কাজও এই কয়েকদিন নিষিদ্ধ থাকে। এমনকি কৃষিকাজ বন্ধ রাখা হয়। অম্বুবাচীর তিনদিন পর, ফের কোনো মাঙ্গলিক অনুষ্ঠান ও চাষাবাদ শুরু হয়।
৬. প্রচলিত বিশ্বাস অনুযায়ী, ঋতুকালে মেয়েরা অশুচি থাকেন। একই ভাবে মনে করা হয়, পৃথিবীও এই সময়কালে অশুচি থাকে। সেজন্যই এই তিনদিন ব্রহ্মচারী, সাধু, সন্ন্যাসী, যোগীপুরুষ ও বিধবারা ‘অশুচি’ ধরিত্রীর ওপর আগুনের রান্না করে কিছু খান না। বিভিন্ন ফলমূল খেয়ে এই তিনদিন কাটাতে হয়।

Link copied!