কাশির সিরাপ কতটা কাজ করে, জানালেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক

সম্পা আক্তার

এপ্রিল ৪, ২০২৪, ০৫:২৮ পিএম

কাশির সিরাপ কতটা কাজ করে, জানালেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক

বাংলাদেশে কয়েক মাস ধরে কাশিতে ভুগছেন বহু মানুষ। আমাদের অনেকেরই সচরাচর এই কাশি হয়ে থাকলেও অতিরিক্ত কাশি, কাশির সঙ্গে রক্ত, পিঠে ব্যথা অনেক সময় ভয়ের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। দীর্ঘদিন কাশিতে করণীয় ও  সতর্কতা অবলম্বন নিয়ে নানা প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন স্বনামধন্য মেডিসিন ও বক্ষব্যাধি বিশেষজ্ঞ ডা. শামীম আহমেদ।

সম্প্রতি ঠাণ্ডা কাশি বেড়ে যাওয়ার কারণ কি?

ডা. শামীম আহমেদ: দীর্ঘমেয়াদি কাশি দূষণ, নতুন কোনো ভাইরাস বা পূর্ববর্তী ভাইরাসের প্রভাবে হয়ে থাকে। এ সময় দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত। এছাড়া, ঠাণ্ডা-জ্বর-সর্দি-কাশির মতো সমস্যা সারা বছর থাকলেও ঋতু পরিবর্তনের সময়, বিশেষ করে শীত, গ্রীষ্ম ও বর্ষাকালে সমস্যাগুলো বেড়ে যায়। এ সময় খুব বড় কোনো সমস্যা না হলে এসব রোগের চিকিৎসার জন্য সাধারণত চিকিৎসকের কাছে যাওয়ার প্রয়োজন পড়ে না।

একজনের কাশি হলে তার সংস্পর্শে থাকা অন্যদের এটি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে কি না?

ডা. শামিম আহমেদ: কাশি হলে আমাদের সবাইকে সামাজিকভাবে এক ধরনের সমস্যায় পড়তে হয়। ভাইরাল রোগ যেমন কাশি একজনের থেকে আরেকজনের কাছে ছড়ায় বলে ভদ্র সমাজের অনেকেই এই রোগটি ভালোভাবে গ্রহণ করেন না। আপনার আশেপাশে কারও কাশি হলে তার সাথে চলাফেরার সময় আপনিও এই রোগে আক্রান্ত হতে পারেন। তাই যেকোনো ভাইরাল বা সংক্রামক রোগ, যেমন করোনা ইনফ্লুয়েঞ্জা, বা যক্ষা রোগীর সঙ্গে দীর্ঘক্ষণ চলাফেরা করলে এটি একজনের কাছ থেকে আরেকজনের হতে পারে। এসব রোগীর আশেপাশে শ্বাস নিলেও এই ভাইরাসগুলো শ্বাসনালীতে পৌঁছে অন্যকে আক্রান্ত করতে পারে। তাই যাদের কাশি আছে, তাদের জনসম্মুখে রুমাল ব্যবহার করা, যেখানে সেখানে কফ না ফেলার মতো বিষয়গুলো মেনে চলা উচিত। যা আমাদের সমাজের সবাইকে ছোটবেলা থেকেই বাধ্যতামূলক শেখা দরকার।

এক মাসের বেশি কাশি থাকলে প্রতিকারে করণীয় কি? কখন চিকিৎসকের পরামর্শ নিবেন?

ডা. শামিম আহমেদ: ৪ সপ্তাহের কাশি নিয়ে কোনভাবেই ঘরে বসে না থেকে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া উচিত। কারন এক মাসের বেশি কাশি থাকলে সেটি টোটকা চিকিৎসা দিয়ে নিরাময় সম্ভব না। এর জন্য একজন ভালো বক্ষব্যাধি বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়া দরকার। এক্ষেত্রে চিকিৎসকের নানা প্রশ্ন থাকতে পারে।  যেমন, কতদিন ধরে কাশি ও সঙ্গে জ্বর আছে কি না, কাশির সঙ্গে রক্ত যাওয়া বা মারাত্মক শ্বাসকষ্ট হয় কিনা এবং কাশির সঙ্গে বুকে ব্যথা ও শরীর শুকিয়ে যাচ্ছে কি না, পরিবারে অ্যাজমা কি না এমন বিভিন্ন ধরনের জিজ্ঞাসা করবেন । এসব প্রশ্নের উত্তরের ওপর নির্ভর করে চিকিৎসক বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা দেবেন যার ওপর ভিত্তি করে  চিকিৎসা চলবে।

ঘরোয়া চিকিৎসায় কাশি ভালো হয় কি না?

ডা. শামিম আহমেদ: কাশি হলে তুলসী , আদার রস, লেবু বা মধু  এগুলো খেলে এক ধরনের ভালো লাগা কাজ করে। তবে এটাই মূল চিকিৎসা নয়। একটা প্রচলিত কথা অনুযায়ী, ভাইরাল সমস্যা চিকিৎসা করলে কমে সাতদিনে, না করলে এক মাসে। অর্থাৎ বেশির ভাগ মানুষ এই সমস্যা কাটিয়ে উঠতে পারলেও কারও কারও ক্ষেত্রে এটি খুব খারাপ হতে পারে। বিশেষ করে ইনফ্লুয়েনজা ভাইরাস , চিকেন পক্স , করোনা এগুলো একবার হয়ে গেলে সহজে ভালো হতে চায় না।  বিশেষ করে যাদের হার্টের রোগ বা  ডায়াবেটিসের সমস্যা রয়েছে তাদের ক্ষেত্রে এই ভাইরাল রোগ মারাত্মক রূপ ধারন করতে পারে।  এক্ষেত্রে তুলসীর রস, গরম পানি, আদা রস, মধু এগুলো কিছু সময়ের জন্য ভালো অনুভব করালেও একজন বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিয়ে ওষুধ খাওয়া বাধ্যতামূলক।

ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া কাশির সিরাপ খেলে এর ফলে কি হতে পারে?

ডা. শামিম আহমেদ: কাশি হলে ফার্মেসি থেকে অনেকেই কাশির সিরাপ কিনে খান। তবে মেডিসিন বইয়ে স্পষ্ট লেখা আছে  কাশির ওষুধ হিসাবে সিরাপ খুব একটা কাজ করে না। তবে সবচেয়ে বেশি বিক্রয়কৃত কাশির ওষুধের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে সিরাপ। এটা অনেকটা প্লাসিবো টাইপের যার মধ্যে ওষুধের খুব একটা উপাদান না থাকলেও রোগীরা খেলে কিছুটা আরাম পায়। তবে কাশির চিকিৎসায় রেজিস্টার চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে ওষুধ খাওয়া  ভালো। তবে অনেক রোগী দাবি করেন, এই কাশির সিরাপ খেয়ে তারা অনেকটা ভালো আছেন।

কাশির ওষুধে ঘুম ধরে এটা কি আসক্তি হতে পারে কি না।

ডা. শামিম আহমেদ: কাশি হলেই লোকাল ফার্মেসী থেকে সিরাপ খাওয়া কোনো সমাধান নয়। এ ধরনের সিরাপ অনেক সময় আসক্তির সৃষ্টি করে যা অস্বাভাবিক হৃৎস্পন্দন ও যকৃতের সমস্যাসহ শরীরের নানা ক্ষতি করে থাকে। এখন পর্যন্ত তারকা খচিত মাদকের নাম ফেনসিডিল। যা এক ধরনের কাশির সিরাপ হিসেবে পরিচিত। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশে এটি বিক্রি হয় এবং এটি বিভিন্ন দোকান বা ফার্মেসিতেও পাওয়া যায়। প্রত্যেকটা ওষুধের ভালো-মন্দ দুই দিক আছে। এটি নির্ভর করে আপনি কোন উদ্দেশ্যে এটি সেবন করছেন। কিছুদিন আগে বেশ কয়েকটি  কাশির সিরাপে কোডেইন নামের একটি উপাদান পাওয়া গেছে । যেটি নেশার জন্য ব্যবহৃত হয়ে থাকে। এজন্য যেকোনো কাশির সিরাপ খাওয়ার আগে এতে ব্যবহৃত উপাদান সম্পর্কে জানা দরকার। এছাড়া ফেনসিডিল টাইপের কাশির সিরাপ  চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া নেওয়াও উচিত নয়।

কাশির সঙ্গে রক্ত ও পিঠে ব্যথা হলে যা করবেন

ডা. শামিম আহমেদ: কাশির সঙ্গে রক্ত অনেক সময় মারাত্মক হতে পারে। এ সময় দ্রুত চিকিৎসা না নিলে বড় ধরনের ক্ষতির সম্ভাবনা রয়েছে। কাশি একটি ভায়োলেন্ট প্রসেস। কাশি দেওয়ার সময় ফুসফুসের নিচে এক ধরনের পর্দা থাকে যার সংকোচন প্রসারণ হয়। ফলে শ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে যুক্ত বিভিন্ন মাসেল তখন কাজ করায় ব্যথা অনুভব হয়। যা থেকে অনেকে ভয় পেলেও  এতে ভয়ের কিছু নেই। চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে ওষুধ খেলেই ঠিক হয়ে যায়।

এছাড়া কাশির সঙ্গে রক্ত আসা কে বলে হিমপ্টিসিস যা চিকিৎসকরা সবসময় গুরুত্বের সঙ্গে নিয়ে থাকেন। এই রক্ত আসার পেছনে অনেকগুলো কারণ থাকে। আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে, প্রথম কারণ হলো যক্ষা যদিও সারা বিশ্বে এটি হচ্ছে অন্যতম কারণ। প্রবীণদের যদি কাশির সঙ্গে রক্ত আসে, বিশেষ করে ধূমপায়ীদের ক্ষেত্রে তবে আমরা সন্দেহ করি ক্যান্সার আছে কি না? এমন অসংখ্য কারণ থাকায় কাশির সঙ্গে রক্ত এলে আমরা বলি চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে। এক্ষেত্রে ডাক্তার রোগীর ইতিহাস শুনে, শারীরিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা, ল্যাবরেটরির এক্সরে বা অন্যান্য পরীক্ষা করে  নির্ণয় করেন যে কেন রক্ত আসে। তবে এখন অনেকের ক্ষেত্রে ভাইরাসের আক্রমণে কাশি হলে, সেখান থেকেও প্রচণ্ড চাপের কারণে শ্বাসনালীর মিউকোসা, সাবমিউকোসা থেকে হালকা রক্ত আসতে পারে। যা অনেক বেশি ভয়ের কারণ না ।

এ ধরনের  সমস্যা চলে গেলে রক্ত আর পড়বে না। তবে যেকোনো রোগের দীর্ঘমেয়াদী কাশির সঙ্গে রক্ত এলে বা জ্বর ছাড়া কাশির সঙ্গে রক্ত এলে দ্রুত অবশ্যই একজন বক্ষব্যাধি বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হতে হবে।

Link copied!