গ্রীষ্মকালীন রোগ প্রতিকারে চিকিৎসকের পরামর্শ

সম্পা আক্তার

এপ্রিল ২৩, ২০২৪, ১১:০২ পিএম

গ্রীষ্মকালীন রোগ প্রতিকারে চিকিৎসকের পরামর্শ

গরমের বিভিন্ন রোগের প্রতিকারের পথ বলে দেন ডা. মো. ফজলের রাব্বি চৌধুরী। ছবি: দ্য রিপোর্ট ডট লাইভ

অতিরিক্ত তাপদাহে জনজীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। সেই সঙ্গে দেখা দিয়েছে নানাবিধ স্বাস্থ্য সমস্যা। চিকিৎসকরা বলছেন, সতর্ক হয়ে চললে এসব সমস্যার সমাধান করা সম্ভব। গ্রীষ্মকালীন রোগব্যাধি সম্পর্কে দ্য রিপোর্ট ডট লাইভকে বিস্তারিত জানিয়েছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএসএমএমইউ) সহযোগী অধ্যাপক ডা. মো. ফজলে রাব্বি চৌধুরী।

গরমের প্রভাবে তাপমাত্রার গতিবিধির ওপর নির্ভর করে বেশ কয়েকটি রোগ হওয়ার আশঙ্কা আছে বলেও জানিয়েছেন তিনি।

হিটস্ট্রোক: রোদে বেশি সময় থাকলে হিট স্ট্রোক হতে পারে। যা বড়সড় সমস্যা সৃষ্টি করে। কারণ এসময় রোগীর তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রির ওপরে উঠে যায়। ফলে রোগীর খিঁচুনি ওঠা, মাথাব্যথা, বমি, মাংস পেশী কাঁপুনি এমনকি রোগী জ্ঞান হারিয়ে ফেলতে পারে।

চর্মরোগ: কারও কারও এই সময়ে প্রচণ্ড তাপদাহের কারণে চর্মরোগ দেখা দিতে পারে। যাদের শুষ্ক ত্বকের সমস্যা রয়েছে, তাদের এই গরমে চর্মরোগের ঝুঁকি বেশি থাকে। এছাড়া গরমে ফাংগাল ইনফেকশনের আশঙ্কা অনেকটাই বেশি। কারণ গরমে মানব দেহে প্রচুর ঘাম হয়, যা ফাঙ্গাস এর প্রজনন ও বৃদ্ধিতে সহায়তা করে।

এছাড়া এই গরমে পানিশূন্যতার কারণে অনেকেরই কোষ্ঠকাঠিন্য দেখা দেয়। যার ফলে চর্মরোগের আশঙ্কা দ্বিগুণ হয়। এই গরমে ব্রণ-প্রবণ ত্বকে ব্রণের সমস্যা বেড়ে যেতে পারে। কারণ এ সময় আমাদের ত্বকের যেসব গ্রন্থি থেকে ঘাম বের হয় সেগুলো বন্ধ হয়ে ফুসকনি বা চুলকানির মতো নানা ধরনের চর্মরোগ দেখা দেয়।

ডায়রিয়া (প্রদাহ): গরমে বেশির ভাগ লোকই পানি কিংবা তরল পানীয় বেশি পছন্দ করেন। সুযোগ হলেই অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ অথবা রাস্তার ধারে শরবত বা তরল পানীয় খেয়ে থাকেন তারা। যা থেকে ডায়রিয়া (প্রদাহ), হেপাটাইটিস বা টাইফয়েড প্রভৃতি পানিবাহিত যেকোনো রোগ বিস্তার লাভ করে। এসবের মধ্যে এদেশে ডায়রিয়া (প্রদাহ) গ্রীষ্মকালে প্রকট আকার ধারণ করে থাকে। কারণ গরমে খাবারদাবার নষ্টের আশঙ্কা বেশি থাকে।

ডায়রিয়া (প্রদাহ) হলে ঘরে বসেই সুস্থ হতে পারেন রোগী। এক্ষেত্রে সবসময় বাথরুম থেকে আসার পরে ১-২ গ্লাস স্যালাইন খেতে হবে। এটা না করলে রোগীর শরীরে পানি শূন্যতা এবং বড়সড় সমস্যা দেখা দিতে পারে। ডায়রিয়া রোগীদের এই গরমে পানি শূন্যতার পাশাপাশি বমি হতেও দেখা যায়। এই বমির কারণে যদি পর্যাপ্ত খাবার খেতে না পারে, তাহলে রোগীর শরীর অতিরিক্ত দুর্বল হয়ে পরে। তখন দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। তবে অবস্থা বেশি খারাপ না হলে, ঘরে থেকেই বারবার স্যালাইন খাওয়ার মাধ্যমে ডায়রিয়ার সমাধান সম্ভব। এর সঙ্গে সঙ্গে বমি-পায়খানা বন্ধের ওষুধও করানো যেতে পারে। আপনার নিকটস্থ ফার্মেসিতে এই ধরনের ওষুধ পাওয়া যায়।

শ্বাসতন্ত্রের সমস্যা: অতি গরমে প্রবীণ ও শিশুর শ্বাসতন্ত্রের সমস্যা দেখা দিতে পারে। হাসপাতালে শ্বাসতন্ত্রের ভাইরাল ইনফেকশনে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা অনেক বেশি। আমাদের বহির্বিভাগ (আউটডোর) বা প্রাইভেট চেম্বারেও এ ধরনের রোগীর সংখ্যা অনেক। কারণ গরমে শ্বাসতন্ত্রের বিভিন্ন রকমের ভাইরাসজনিত প্রদাহ বা সংক্রমণ বেড়ে যায়। যেসব রোগীর হাঁপানি সমস্যা আছে, তাপমাত্রার তারতম্যের কারণে তাদের ক্ষেত্রে শ্বাসতন্ত্রের সমস্যার ঝুঁকি বেশি থাকে।

হৃদপিণ্ড-কিডনি-সাইনাসের সমস্যা: সাইনাসের সমস্যা যাদের আছে, এই গরমে তাদের সাইনোসাইটিস বেড়ে যেতে পারে। এছাড়া রোদে অতিরিক্ত সময় পার করার সবচেয়ে ভয়াবহ বিষয় হচ্ছে অনেক সময় রোগীর কিডনিতে বড়সড় সমস্যা দেখা দিতে পারে। যেমন, কিডনি ড্যামেজ হয়ে যাওয়া। এছাড়া অতিরিক্ত তাপদাহের ফলে হৃদপিণ্ডের সমস্যা দেখা দিতে পারে।

এই গরমে এই ধরনের রোগব্যাধি থেকে সুরক্ষিত থাকতে বেশ কিছু পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ডা. ফজলে রাব্বি চৌধুরী। তার পরামর্শগুলো হলো-
১. প্রয়োজন ছাড়া বাইরে না বের হবেন না।
২. প্রবীণ ও শিশুদের অপেক্ষাকৃত ঠাণ্ডা জায়গায় রাখুন।
৩. যেসব কক্ষে পর্যাপ্ত আলো-বাতাস চলাচল করতে পারে, সেসব কক্ষে প্রবীণ ও শিশুদের রাখুন।
৪. প্রচণ্ড গরমের এই সময়ে সবাইকে প্রচুর পরিমাণে পানি এবং তরল পানীয় খেতে হবে। যাতে প্রস্রাবে অসুবিধা না হয়।
৫. এই গরমে ঢিলাঢালা পোশাক ও সুতি কাপড় পরে থাকা শ্রেয়।
৬.  একান্তই যদি বাইরে যেতে হয়, তবে ফুল স্লিভ কাপড় পরে নিন। এছাড়া বাইরে গেলে তরল পানীয় এবং ছাতা সঙ্গে রাখুন।
৭. গরমের এই সময়ে প্রচুর সবুজ শাকসব্জি ও মৌসুমী ফল খেতে হবে।
৮. প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবার যত কম খাওয়া যায়, ততই ভালো।
৯. তেল-মসলা যুক্ত কিংবা ভাজাপোড়া খাবার পুরোপুরি বর্জন করুন।
১০. গরমে বড় কোনো সমস্যা দেখা দিলে দ্রুত হাসপাতালে আসুন।

গরমে শিশুদের ডায়রিয়াসহ বেশ কিছু রোগ থেকে সুরক্ষার জন্য বেশ কিছু পরামর্শ দিয়েছেন ডা. মো. ফজলে রাব্বি চৌধুরী। সেগুলো হলো-
১. কিছুক্ষণ পর পর আপনার সন্তানের শরীর মুছে দিন।
২. দিনে দুইবার গোসল করান।
৩. আপনার সন্তানকে প্রচুর পরিমাণে পানি কিংবা তরল পানীয় খেতে দিন।
৪. শাকসব্জি-ফলমূল খাওয়ায় উৎসাহ দিতে হবে।
৫. ছয় মাসের কম বয়সের শিশুদের বারবার সময় নিয়ে শালদুধ খাওয়াতে হবে। দিনে ১০-১২ বারেরও বেশি শালদুধ খাওয়ানো শ্রেয়। এতে গরমে শিশুর প্রস্রাব-পায়খানায় কোনো সমস্যা হবে না।
৬. খেয়াল রাখতে হবে প্রতিদিন যেন শিশু ১-২ বার পায়খানা ও অন্তত দিনে ছয়বার প্রস্রাব করে থাকে।
৭. শিশুদের অপেক্ষাকৃত সুতি ও ঢিলেঢালা কাপড়চোপড় পরাতে হবে।
৮. আপনার সন্তানকে পর্যাপ্ত আলো-বাতাসে পরিপূর্ণ পরিবেশে রাখুন।
৯. গরমে আপনার সন্তান বেশি অস্থির হয়ে উঠলে কিংবা রোগাক্রান্ত হলে নিকটস্থ কোনো হাসপাতালের হটলাইনে ফোন করুন অথবা হাসপাতালে এসে বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিন।

Link copied!