১৯১২ সালে আটলান্টিক মহাসাগরের নিচে হারিয়ে গিয়েছিল সেই সময়ের বিস্ময়কর সৃষ্টিকারী জাহাজ টাইটানিক। সেই টাইটানিককে আজও কেউ ভুলতে পারেনি। টাইটানিকের ধ্বংসাবশেষ দেখতে গিয়ে এবার একই পরিণতি হলো সাবমেরিন টাইটানের। পাঁচ যাত্রী নিয়ে হারিয়ে গেল আটলান্টিকের গহ্বরে।
দুঃখজনক হলেও সত্যি বিস্ফোরণে ছিন্নভিন্ন হওয়া সাবমার্সিবল টাইটানের টুকরো পাওয়া গেলেও পাঁচ অভিযাত্রীর কোনো চিহ্ন খুঁজে পাওয়া যায়নি।
স্থানীয় সময় রোববার (১৮ জুন) সকাল ৬টায় (বাংলাদেশ সময় বিকেল ৬টা) টাইটানিকের ধ্বংসাবশেষের দিকে যাত্রা করে সাবমার্সিবল টাইটান। এর প্রায় দুই ঘণ্টা পর ৩৮০০ মিটার গভীরে যাওয়ার পর ওপরের জাহাজ থেকে সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।
প্রায় সাড়ে চার দিন তল্লাশির পর বৃহস্পতিবার (২২ জুন) স্থানীয় সময় দুপুরে (বাংলাদেশ সময় রাত ১০টা) টাইটানিকের অদূরে ধ্বংসাবশেষ পাওয়ার কথা জানায় মার্কিন কোস্টগার্ড।
সাবমার্সিবল টাইটান
বিশ্বের একমাত্র বেসরকারি মালিকানাধীন সাবমার্সিবল টাইটান সমুদ্রের তলদেশে চার হাজার মিটার গভীরে পর্যন্ত যেতে পারত। এটি সেই অর্থে সাবমেরিন নয়। ২০১৫ সাল থেকে সাইক্লোপস নামক একটি সিস্টার সাবমার্সিবল পরিচালনা করে আসছে ওশানগেট। পাশাপাশি পর্যটকদের টাইটানিকের ধ্বংসাবশেষ দেখার সুযোগ করে দেওয়ার জন্য তৈরি করেছিল টাইটান।
কোম্পানির দেওয়া তথ্যানুযায়ী, টাইটানের ওজন প্রায় ২৩ হাজার পাউন্ড (১০৪৩২ কেজি) এবং একটি অ্যারোস্পেস-স্ট্যান্ডার্ডের পাঁচ ইঞ্চি পুরু কার্বন ফাইবার কাঠামো ছিল, যা দুটি গম্বুজসদৃশ টাইটানিয়াম অ্যান্ড ক্যাপ দিয়ে আরও শক্তিশালী করা হয়।
সাগরের সবচেয়ে গভীরে যেতে সক্ষম মার্কিন সাবমেরিন ইউএসএস ডলফিনের চাইতেও অনেক বেশি গভীরতায় যেতে সক্ষম টাইটান। ইউএসএস ডলফিন একবার সাগরের তলদেশে ৯০০ মিটার পর্যন্ত গিয়েছিল।
ইউএস ন্যাশনাল ওশানিক অ্যান্ড অ্যাটমোসফেরিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশন জানায়, সাবমেরিনের চাইতে সাবমার্সিবলের শক্তির মজুত সীমিত থাকে। সাবমার্সিবল লঞ্চ করা ও অভিযান শেষে ফিরিয়ে আনার জন্য সহায়তাকারী জাহাজের দরকার হয়।
২০১৮ সালে টাইটানের সমুদ্রে ট্রায়াল দেওয়া শুরু হয়। ২০২১ সালে এটি প্রথম যাত্রা করে। গত বছর এটি ১০ বার সাগরের তলদেশে যায় তবে প্রতিবারই গন্তব্য টাইটানিকের ধ্বংসাবশেষে ছিল না।
লঞ্চিং ও রিকভারি প্ল্যাটফর্ম থেকে আলাদা হয়ে যাওয়ার পর সাবমার্সিবলে থাকা চারটি ইলেকট্রিক থ্রাস্টার (ইঞ্জিন) এটিকে ঘণ্টায় ৩.৪৫ মাইল বেগে চলতে সাহায্য করে।
টাইটানের অভ্যন্তরীণ কাঠামো
টাইটান সাবমার্সিবলের ভেতরের আকৃতি ২২ ফুট X ৯.২ ফুট X ৮.৩ ফুট। এটি মাত্র পাঁচজনকে বহন করতে পারত। এর মধ্যে একজন পাইলট এবং বাকি চারজন যাত্রী।
এটির ভেতরে অবস্থানকালে যাত্রীদের মেঝেতে বসে থাকতে হতো। নড়াচড়া করতে চাইলেও খুব বেশি জায়গা ছিল না।
ডুবোযানের সামনে একটি বড় গম্বুজাকৃতির পোর্টহোলে ভিউয়িং পয়েন্ট ছিল, যা কোম্পানির দাবি— গভীর সমুদ্রে যাত্রীবাহী সাবমার্সিবলগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড় ভিউ পয়েন্ট।
সমুদ্রের এতটা গভীর তলদেশে প্রচণ্ড ঠাণ্ডা থাকে তাই ডুবোযানটির দেয়ালও উষ্ণ তাপমাত্রায় রাখা হয়েছিল। দেয়ালে লাগানো ল্যাম্পই ছিল ভেতরে আলোর একমাত্র উৎস।
ডুবোযানটির সামনের দিকে যাত্রীদের জন্য একটি ব্যক্তিগত টয়লেট ছিল। ব্যবহারের সময় একটি পর্দার মতো উঠে যায় এবং পাইলট কিছু মিউজিক ছেড়ে দিতে পারতেন।
তবে অভিযানে আসার আগে থেকেই নিজের ডায়েট সীমাবদ্ধ করতে এবং পানির নিচে থাকার সময় যেন টয়লেট ব্যবহারের প্রয়োজন কম পড়ে সেদিকে সচেতন থাকতে আগে থেকেই ওয়েবসাইটে জানিয়ে দিয়েছে কোম্পানিটি।
ডুবোযানটির বাইরের অংশে শক্তিশালী আলোর ব্যবস্থা ছিল, যার মাধ্যমে টাইটানিকের ধ্বংসাবশেষ দেখা যেত। বহির্সজ্জায় একাধিক ফোর কে ক্যামেরা এবং জাহাজের ম্যাপিং করতে বাইরের দিকে ছিল লেজার স্ক্যানার ও সোনার। সেই সঙ্গে ভেতরে বিশাল ডিজিটাল স্ক্রিনেও টাইটানিকের ধ্বংসাবশেষ দেখার ব্যবস্থা ছিল।
টাইটান নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি
টাইটান সাগরের যতটা গভীরে যাবে, ওই পর্যায়ে জিপিএস কাজ করবে না। তার বদলে একটি বিশেষ টেক্সট মেসেজ সিস্টেমের মাধ্যমে ক্রুরা পানির ওপরে থাকা সাপোর্ট জাহাজ থেকে নির্দেশাবলি পেয়ে থাকেন। আর এই নির্দেশাবলির ওপর ভিত্তি করে এবং একটি মডিফায়েড ভিডিও গেম কন্ট্রোলারের সাহায্যে বাহনটি পরিচালনা করতেন পাইলট।
গত বছর সিবিএস নিউজকে ওশানগেটের প্রতিষ্ঠাতা স্টকটন রাশ বলেছিলেন, এই ডুবোযানটি পরিচালনা করতে খুব বেশি দক্ষতার দরকার হয় না। এই যাত্রায় প্রাণ হারিয়েছেন রাশও।
টাইটানে যাত্রার যোগ্যতা ও প্রশিক্ষণ
ওশানগেটের ওয়েবসাইটের পরিষ্কার বলা হয়েছে যে, টাকা দিয়ে যারা `টাইটান`-এ ভ্রমণ করবেন, তাদের আগে থেকে কোনো ডাইভিং অভিজ্ঞতা না থাকলেও চলবে। আর যদি কোনো প্রশিক্ষণ দরকার হয়, তা হলে ভ্রমণ শুরুর আগে অনলাইনে তা দেওয়া হবে।
ভ্রমণেচ্ছু গ্রাহকদের বয়স অবশ্যই কমপক্ষে ১৮ বছর হতে হবে। লম্বা সময় আবদ্ধ একটা জায়গায় বসে থাকতে এবং মই বেয়ে উঠতে সক্ষম হতে হবে।
ওশানগেট জানিয়েছে, সব যাত্রীকে এই ভ্রমণ বিষয়ে ওরিয়েন্টেশন সেশন নেওয়া হয় এবং নিরাপত্তা বিষয়ে ব্রিফিং করা হয়।
টাইটানে নিরাপত্তা ব্যবস্থা
সমুদ্রের এত গভীরে অনেক ধরনের চাপ মোকাবিলা করতে হয়েছে টাইটানকে। ওশানগেটের ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, ‘রিয়েল টাইমে’ ডুবোযানটিকে পর্যবেক্ষণের জন্য তাদের একটি প্রক্রিয়া রয়েছে। সাবমার্সিবলের কাঠামোয় কোনো সমস্যা হয়েছে কিনা তা মূল্যায়ন করার জন্য এটি ডুব দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সাবের ওপর যে চাপ পড়ে, তার প্রভাব বিশ্লেষণের জন্য সেন্সর ছিল।
পানির নিচে যাওয়ার আগে একটি সহায়তাকারী দল যাত্রীদের সাবমার্সিবলের ভেতরে ঢুকিয়ে বাইরে থেকে দরজা টেনে ১৭টি বোল্ট দিয়ে আটকে দিতেন। অর্থাৎ ভেতরে থাকা যাত্রীদের বাইরে বের হওয়ার কোনোরকম সুযোগ ছিল না।
তবে ওশানগেট বলছে, এটি একটি এক্সপেরিমেন্টাল ডুবোযান। যখন সিবিএসের সাংবাদিক টাইটানে করে ভ্রমণ করেছিলেন, তখনো তাকে একটি চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর করতে হয়েছিল যে, এই ডুবোযানটি কোনো নিয়ন্ত্রক সংস্থা দ্বারা অনুমোদিত নয় এবং এটিতে ভ্রমণের ফলে যে কোনো ইনজুরি, মানসিক আঘাত থেকে শুরু করে মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে।
একটি প্রমোশনাল ভিডিওতে ওশানগেটের সফটওয়্যার সিকিউরিটি বিশেষজ্ঞ অ্যারন নিউম্যান সম্ভাব্য গ্রাহকদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, এই সাবমার্সিবলে চড়া কোনো ডিজনি রাইড নয়, তা আপনি জানেন। এর সঙ্গে অনেক ঝুঁকি ও চ্যালেঞ্জ জড়িয়ে আছে।
টাইটান ধ্বংস হলো যেভাবে
মার্কিন কোস্টগার্ড কর্মকর্তা রিয়ার অ্যাডভোকেট জন মাগার সংবাদ সম্মেলনে বলেন, মহাসাগরের তলদেশে পানির চাপ নিতে না পেরে বিস্ফোরিত হয়েছে টাইটান। এতে থাকা পাঁচ যাত্রীর কেউ-ই বেঁচে নেই।
টাইটানিকের ধ্বংসাবশেষ থেকে ১৬০০ ফুট (প্রায় ৫০০ মিটার) দূরে টাইটানের ধ্বংসাবশেষ পাওয়া যায় বলে জানিয়েছে মার্কিন কোস্টগার্ড। ধ্বংসাবশেষের কয়েকটি টুকরা শনাক্ত করা গেছে।
টাইটানের শেষ যাত্রী তালিকায় যাদের নাম
টাইটানের ক্যাপসুলে ছিলেন পাঁচ পর্যটক। এর মধ্যে ছিলেন ওশানগেটের প্রতিষ্ঠাতা এবং প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা স্টকটন রাশ (৬১)।
এ ছাড়া ছিলেন ব্রিটিশ ধনকুবের, বিমান সংস্থা অ্যাকশন এভিয়েশনের চেয়ারম্যান হামিশ হার্ডিং (৫৮), পাকিস্তানের এংরো করপোরেশনের ভাইস চেয়ারম্যান শাহজাদা দাউদ (৪৮) ও তার ছেলে সুলেমান দাউদ (১৯), ফরাসি পর্যটক পল অঁরি নারজিলে (৭৭)।