নিজেদের বদলে যাওয়ার কথা বলল তালেবান

দ্য রিপোর্ট ডেস্ক

আগস্ট ১৮, ২০২১, ০৩:৩৭ এএম

নিজেদের বদলে যাওয়ার কথা বলল তালেবান

বিনা রক্তপাতে আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুলের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পর প্রথমবার সংবাদ সম্মেলন করল দেশটির কট্টর ধর্মীয় গোষ্ঠী তালেবান। সংবাদ সম্মেলনটি লাইভও সম্প্রচারের ব্যবস্থা করে তারা। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে তারা নিজেদের বদলে যাওয়ারও বার্তা দিয়েছে। কট্টর ইসলামী এই গোষ্ঠীটি বলেছে, তাদের শাসনে নারীরা স্বাধীনতা পাবে ‘শরিয়া আইন অনুযায়ী’, তাদের ‘নিয়ম মেনে’ সংবাদমাধ্যমও মুক্তভাবে কাজ করতে পারবে। বোরকা নয়, হিজাবই যথেষ্ট। এরকম নানাবিধ তথ্য তারা তুলে ধরেছে সংবাদ সম্মেলনে। 

বিশ্বকে চমকে দিয়ে অতি দ্রুত কাবুল দখল করে ফেলার দুদিন পর মঙ্গলবার সন্ধ্যায় রাজধানী কাবুলে এই সংবাদ সম্মেলনে আসেন তালেবান নেতারা। একইদিন তালেবানের মুখপাত্র সুহাইল শাহিন বলেছেন, ‘তালেবান আমলে আফগানিস্তানে নারীদের জন্য বোরকা পরা আর বাধ্যতামূলক নয়। বাইরে বের হওয়ার সময় তাদের হিজাব পরলেই চলবে।’

সুহাইল কাতারের রাজধানী দোহায় তালেবান দপ্তরের মুখপাত্র হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম স্কাই নিউজকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি এমন মন্তব্য করেন।

আফগানিস্তানে ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সালে তালেবান শাসনামলে আফগান নারীদের জন্য বোরকা পরা বাধ্যতামূলক ছিল। ওই সময় দেশটির নারীদের চাকরি করা নিষিদ্ধ ছিল। এমনকি পুরুষ অভিভাবক ছাড়া নারীরা ভ্রমণে যেতে পারতেন না। ১২ বছরের বেশি বয়সী মেয়েদের পড়াশোনার অনুমতি ছিল না।

Youth Are an Important Factor for a Peaceful Afghanistan of the Future
আফগান নারীদের স্বাধীনতার ব্যাপারেও সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য তুলে ধরে তালেবান। ছবি: ইউএনএমএ 

নারীদের সরকারে যোগ দেওয়ার আহ্বান

নারী শিক্ষার বিষয়ে সুহাইল শাহিন বলেছেন, ‘তালেবান শাসনামলে এবার মেয়েরা প্রাথমিক থেকে উচ্চস্তর পর্যন্ত শিক্ষা গ্রহণ করতে পারবে। এর অর্থ, নারীদের বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত পড়াশোনা করার সুযোগ থাকবে।’

শাহিন আরও বলেন, ‘নারী শিক্ষার বিষয়ে আমাদের এমন নীতির কথা আমরা আফগানিস্তান নিয়ে মস্কো ও দোহা সম্মেলনেও বলেছি। আফগানিস্তানে তালেবানের নিয়ন্ত্রণে থাকা এলাকাগুলোয় হাজারো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম চালু আছে। সেখানে মেয়েরাও পড়াশোনার সুযোগ পাচ্ছে।’

সরকারেও থাকবে নারীরা

তালেবান তাদের সরকারে নারীদের যোগ দিতে আহ্বান জানিয়েছে। বাহিনীটির সাংস্কৃতিক কমিশনের সদস্য ইনামুল্লাহ সামানগানি এ আহ্বান জানান। সামানগানি বলেন, ‘ইসলামিক আমিরাতে নারীরা ক্ষতির শিকার হোক, তা চায় না। শরিয়াহ আইন অনুযায়ী সরকারে তাদের উপস্থিতি থাকা উচিত। এখনো সরকারের কাঠামো পুরোপুরি পরিষ্কার নয়, কিন্তু অভিজ্ঞতার আলোকে মনে হচ্ছে, এখানে পুরোপুরি ইসলামিক নেতৃত্ব থাকবে। এতে সব পক্ষেরই যোগ দেওয়া উচিত।’

মুখপাত্র জাবিউল্লাহ মুজাহিদ যেমনটা বললেন, ‘আমরা এটা স্পষ্ট করতে চাই, আফগানিস্তান আর কোনো যুদ্ধক্ষেত্র নয়। যারাই এতদিন আমাদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছে, সবাইকে আমরা ক্ষমা করে দিয়েছি। শত্রুতার দিন শেষ হয়েছে। দেশের ভেতরে বা বাইরে- কোথাও কোনো শত্রু আমরা চাই না।’

দেশি-বিদেশি বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের কর্মী আর ক্যামেরার সামনে তিনি বলেন, ২০ বছর সংগ্রামের পর দেশকে আমরা মুক্ত করতে পেরেছি, বিদেশিদের খেদিয়েছি। পুরো জাতির জন্য আজ একটি গৌরবের মুহূর্ত।

সন্দেহ আর সংশয় নিয়ে আফগানিস্তানের দিকে তাকিয়ে থাকা বিশ্বনেতাদের উদ্দেশে তালেবান মুখপাত্র বলেন, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে তারা আশ্বস্ত করতে চান যে, কারও কোনো ‘ক্ষতি করা হবে না’। আমরা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে কোনো ঝামেলায় যেতে চাই না।

পাশাপাশি তিনি এও বলেন, আমাদের ধর্মীয় নিয়ম মেনে চলার অধিকার আমাদের আছে। অন্য দেশের দৃষ্টিভঙ্গি, নিয়ম আর আইন অন্যরকম হতে পারে, কিন্তু নিজেদের মূল্যবোধের ভিত্তিতে নিজেদের নিয়মকানুন তৈরি করে নেওয়ার অধিকার আফগানিস্তানের আছে।

প্রসঙ্গত, গত ২০ বছর ধরে নেপথ্যে থেকে তালেবানের মুখপাত্রের দায়িত্ব পালন করে আসা জাবিউল্লাহ মুজাহিদ এ সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমেই প্রথমবার ক্যামেরার সামনে এলেন।

রয়টার্স লিখেছে, সংবাদ সম্মেলনে যে বার্তা তালেবান দিল, তাতে ভবিষ্যতের রূপরেখার বিস্তারিত খুব বেশি না থাকলেও দুই দশক আগের তালেবান শাসনের সঙ্গে তুলনা করলে এবার তাদের সুর অনেকটা নরম বুঝা যায়। আর এমন এক সময়ে তালেবান এই সংবাদ সম্মেলন করল, যখন পশ্চিমা দেশগুলো তাদের কূটনীতিকদের কাবুল থেকে তড়িঘড়ি করে সরিয়ে নিয়ে বোঝার চেষ্টা করছে, পরিবর্তিত এই পরিস্থিতিতে তারা কীভাবে সাড়া দেবে। 

বিশেষ করে উদ্বেগ রয়েছে আফগান সমাজে নারীর অবস্থান নিয়ে, কেন না ১৯৯৬ থেকে ২০০১ পর্যন্ত তালেবান শাসনামলে মেয়েদের শিক্ষা বা চাকরির ওপর নিষেধাজ্ঞা ছিল। পুরুষের লিখিত অনুমতি নিয়ে সর্বাঙ্গ ঢাকা বোরখা পরে, তবেই নারীরা ঘরের বাইরে যেতে পারত।

শরিয়া আইনের নামে দোররা বা চাবুক মারা, হাত-পা কেটে নেওয়া এবং প্রকাশ্যে ফাঁসিতে ঝোলানো বা পাথর ছুড়ে হত্যার মত শাস্তি ছিল সেসব দিনের নিত্য ঘটনা। 

নারীদের শিক্ষা ও স্বাধীনতা

নারীদের শিক্ষা আর কাজের স্বাধীনতা নিয়ে পরে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে জাবিউল্লাহ মুজাহিদ বলেন, আমাদের কাঠামোর মধ্যে থেকেই নারীদের শিক্ষা আর কাজ করার সুযোগ আমরা দেব। আমাদের সমাজে নারীরা হবে খুবই সক্রিয়, সেটা আমাদের নিয়মের মধ্যে থেকেই হবে।

তালেবানের এই সংবাদ সম্মেলনের পর জাতিসংঘের মুখপাত্র স্তেফান দুজারিক নিউইয়র্কে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া দিয়েছেন। তিনি সাংবাদিকদের বলেছেন, বাস্তবে কী ঘটে, সেটাই দেখার জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। প্রতিশ্রুতি রক্ষায় তারা কী করছে, সেটা আমাদের আগে দেখতে হবে।

সংবাদ সম্মেলনের পর এক সাংবাদিকের সাথে হাত মেলান তালেবান মুখপাত্র জাবিউল্লাহ মুজাহিদ 

গণমাধ্যম বিষয়ে ঘোষণা

মঙ্গলবারের সংবাদ সম্মেলনে গণমাধ্যমের কাজ নিয়েও আশ্বস্ত করার চেষ্টা করেছেন জাবিউল্লাহ মুজাহিদ। তিনি বলেন, বেসরকারি গণমাধ্যম আফগানিস্তানে ‘মুক্ত ও স্বাধীনভাবে’ তাদের কাজ চালিয়ে যেতে পারবে। তবে সবাইকেই তালেবানের ‘সাংস্কৃতিক কাঠামো’ মেনে চলতে হবে। গণমাধ্যমের কাজের কথা যখন আসবে, কোনো কিছুই ইসলামী মূল্যাবোধের বিরুদ্ধে যাওয়া চলবে না।

‘আপনারা যারা সংবাদমাধ্যমে আছেন, আমাদের সীমাবদ্ধতা আপনারা ধরিয়ে দেবেন, যাতে আমরা জাতির সেবা করতে পারি। কিন্তু আমাদের বিরুদ্ধে কাজ করা গণমাধ্যমের উচিত হবে না। দেশের ঐক্যের জন্যই তাদের কাজ করা উচিত।’

তালেবান মুখপাত্র তার বিভিন্ন কথায় এটা বেশ খোলাসা করেই বলেছেন, তারা যা-ই করবেন, সেটা ‘ইসলামী আইনেই’ হবে। তবে তার ভাষায়, দুই দশক আগের তালেবান আর এখনকার তালেবান এক নয়।

‘আমাদের দেশ একটি মুসলিম দেশ। সেটা ২০ বছর আগেও ছিল, এখনও তাই আছে। কিন্তু যদি অভিজ্ঞতা, পরিপক্কতা আর আগামীর দর্শনের কথা বলেন, তাহলে অবশ্যই ২০ বছর আগের আমাদের সঙ্গে এখনকার আমাদের অনেক পার্থক্য আছে। আমরা যা করতে যাচ্ছি, সেখানেও এই পার্থক্যটা থাকবে।’

নিউইয়র্ক ও ওয়াশিংটনে নাইন-ইলেভেনের হামলার পর আল কায়েদা জঙ্গিদের নির্মূল করতে যুক্তরাষ্ট্রসহ বহুজাতিক বাহিনী ২০০১ সালে আফগানিস্তানে যে অভিযান চালিয়েছিল, তাতেই তালেবান শাসনের পতন ঘটে। তালেবানের প্রত্যাবর্তনে আফগানিস্তান আবারও সন্ত্রাসবাদের আখড়া হয়ে উঠবে কি না- সেই প্রশ্নও সংবাদ সম্মেলনে এসেছে।

জবাবে তালেবান মুখপাত্র বলেছেন, আফগানিস্তানের মাটি অন্যের ওপর হামলার জন্য কাউকে ব্যবহার করতে দেওয়া হবে না। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে আমরা এ বিষয়ে আশ্বস্ত করতে পারি।

চলতি বছরের এপ্রিল মাসে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ঘোষণা দেন, দীর্ঘ দুই দশকের যুদ্ধের অবসান ঘটিয়ে তার দেশের সৈন্যরা ৯ সেপ্টেম্বরের মধ্যে আফগানিস্তান ছেড়ে যাবে। এরপরই আর দেরি করেনি তালেবান, মে মাসেই সরকারি বাহিনীর বিরুদ্ধে তাদের যুদ্ধ শুরু হয়ে যায় এবং অতি দ্রুত দেশের অধিকাংশ এলাকা দখল করে নেয়। গত ১৫ অগাস্ট তারা রাজধানী কাবুলে প্রবেশ করে। আফগান প্রেসিডেন্ট আশরাফ গনি পালিয়ে যান। দেশের অনেকে পালাতে শুরু করেন। এ অবস্থায় তালেবান দেশবাসীকে আশ্বস্ত করতে মঙ্গলবারই সব সরকারি কর্মচারীর জন্য ‘সাধারণ ক্ষমা’ ঘোষণা করে। কারো প্রতিই প্রতিশোধ নেওয়া হবে না বলে তারা জানায়।

সরকারের ধরন কেমন হবে

অবশ্য তালেবান সরকারের ধরন কেমন হবে, সে বিষয়ে বিশদ কিছু সংবাদ সম্মেলনে তুলে ধরেননি তালেবান মুখপাত্র। সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, সরকার যখন গঠন করা হয়ে যাবে, তখন আমরা ঠিক করব, কোন কোন আইন আমরা জাতিকে উপহার দেব।

আমি শুধু বলে রাখতে চাই, সরকার গঠনের জন্য আমরা জোরেসোরে কাজ করছি। সেটা হয়ে গেলেই আপনারা ঘোষণা পাবেন। সব সীমান্ত এখন আমাদের নিয়ন্ত্রণে। যারা এখনও দেশ ছেড়ে যাওয়ার চেষ্টা করছেন, তাদের ভয় না পেয়ে বাড়ি ফেরার পরামর্শ দিয়ে জাবিউল্লাহ মুজাহিদ বলেন, তাদের খারাপ কিছু ঘটবে না।

তিনি দাবি করেন, কাবুলে কোনো বিশৃঙ্খলা হোক, তালেবান তা চায়নি। প্রাথমিকভাবে তাদের পরিকল্পনা ছিল, তাদের যোদ্ধারা শহরের  প্রবেশ পথগুলোতেই অপেক্ষা করবে, যাতে ক্ষমতা হস্তান্তর প্রক্রিয়া মসৃণভাবে হতে পারে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে, আগের সরকার এতটাই অযোগ্য ছিল যে তাদের নিরাপত্তা বাহিনী শহরের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কিছুই করতে পারেনি। ফলে আমাদেরই তা করতে হয়েছে। বাসিন্দাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতেই আমাদের শহরে প্রবেশ করতে হয়েছে।

তালেবানের সুর যত নরমই হোক, বিরোধীদের মন তা বদলাতে পারেনি। নিজেকে আফগানিস্তানের ‘বৈধ অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রধান’ ঘোষণা করা ভাইস প্রেসিডেন্ট আমরুল্লাহ সালেহ এরমধ্যেই বলেছেন, তালেবানের কাছে তিনি মাথা নত করবেন না। তবে সালেহ বেশ জোর গলায় কথা বললেও তার পেছনে কতটা সমর্থন আছে, সেটা এখনও স্পষ্ট নয়।

নেটোর মহাসচিব ইয়েন্স স্টোলটেনবার্গ বলেছেন, তালেবানের উচিত, যারা দেশ ছাড়তে চায়, তাদের সেই সুযোগ দেওয়া। তার ভাষায়, আফগানিস্তানে একটি টেকসই রাষ্ট্র গড়ে উঠুক, সেটাই নেটো চায়।

Link copied!