আগস্ট ৩০, ২০২২, ০৬:৪৮ পিএম
ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের ছয় মাস পেরিয়ে গেছে। এ যুদ্ধে প্রতিদিনই নানা ঘটনা ঘটছে। দুই পক্ষেরই বহু লোক হতাহত হচ্ছে। সাধারন জনগণ যেমন মারা যাচ্ছে, তেমনি বড় বড় সামরিক কর্মকর্তাদেরও মৃত্যু হচ্ছে। রুশ প্রেসিডেন্ট এসব ঘটনায় সেভাবে প্রতিক্রিয়া দেখান না। কিন্তু গত ২০ আগস্ট দারিয়া দুগিনা নামের এক নারী সাংবাদিক গাড়িবোমা হামলায় নিহত হবার ঘটনায় ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন প্রেসিডেন্ট পুতিন। তিনি ওই হামলার সমূচিত জবাব দিতে উঠেপড়ে লেগেছেন। শুধু তাই নয়, দারিয়াকে মরণোত্তর অর্ডার অব কারেজ পুরষ্কারেও ভূষিত করেছেন তিনি।
প্রেসিডেন্ট পুতিনের এমন তৎপরতার কারণে বিশ্বের তাবৎ গোয়েন্দা সংস্থাসহ সাধারন মানুষজনও কৌতূহলী হয়ে উঠেছেন দারিয়া দুগিনা নামের ওই সাংবাদিকের ব্যাপারে। তারা বলছেন, কে এই দারিয়া? কেনইবা প্রেসিডেন্ট পুতিন তাঁর হত্যাকাণ্ডে এতটা ক্ষেপেছেন?
দারিয়ার পুরো নাম দারিয়া আলেক্সান্দ্রোনোভা দুগিনা। তাঁর ডাক নাম দারিয়া প্লাতোনোভা। পেশায় সাংবাদিক দারিয়া ভ্লাদিমির পুতিনের পরামর্শক এবং প্রধান কৌশলবিদ আলেকজান্ডার দুগিন এবং তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রী রুশ দার্শনিক নাতালিয়া মেলেতাইভার কন্যা। আলেক্সাজান্ডার দুগিনকে ‘পুতিনের মস্তিষ্কও’ বলা হয়। কেউ কেউ তাকে ডাকেন ‘পুতিনের রাসপুতিন’ হিসেবেও।
কেবল দুগিনের কন্যা বলেই যে দারিয়ার মৃত্যু নিয়ে এমন চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে, বিষয়টি এমনও না। দারিয়া হত্যাকাণ্ডটি রুশ সরকারের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ও। দারিয়াকে হত্যা পুতিনকেই মনস্তাত্বিকভাবে আঘাত করার শামিল।
রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণকে রাজনৈতিকভাবে যে ক'জন বুদ্ধিজীবী তাদের লেখনির মাধ্যমে একটি ইতিবাচক অভিযান হিসেবে জোরালোভাবে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন, দারিয়া দুগিনা তাঁদের মধ্যে অন্যতম। তিনি নিয়মিতভাবে রাজনৈতিক ধারাভাষ্যকার হিসেবে এই যুদ্ধ শুরুর পক্ষে রাশিয়ার যুক্তিযুক্ত কারণগুলো ব্যাখ্যা করে যাচ্ছিলেন। তিনি পর্দা ফাঁস করছিলেন এই বলে যে, যুদ্ধের যে ভয়াবহতা ইউক্রেন বিশ্ববাসীকে দেখাচ্ছে, তাঁর বেশিরভাগই সাজানো।
দারিয়ার ওই সাহসী ভূমিকা ভালভাবে নেয়নি যুক্তরাষ্ট্র ও তাঁর মিত্ররা। এ কারণে গত জুনেই যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাজ্য দারিয়ার উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। এতে দারিয়ার প্রভাব আরও বাড়ে। দারিয়া পুতিন প্রশাসনের বুদ্ধিজীবীদের অন্যতম এবং জনপ্রিয় হিসেবে বিবেচিত হতে থাকেন। বাবার পরিচয়ে নয়, দারিয়া নিজেই রুশ প্রশাসনে নিজের অবস্থান তৈরি করে নিতে সক্ষম হয়েছিলেন।
পেশাগত অবস্থানের কথা বিবেচনা করলেও দারিয়া দুগিনার ভূমিকা রাশিয়ার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। রুশ রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম আরটির এবং ক্রেমলিনপন্থী কনজার্ভেটিভ চ্যানেল সারগ্রাদের জন্য নিবেদিত হয়ে কাজ করতেন দারিয়া দুগিনা। তিনি চিফ এডিটর হিসেবেও দায়িত্ব পালন করছিলেন ইউনাইটেড ওয়ার্ল্ড ইন্টারন্যাশনাল নামের রুশ গণমাধ্যমে।
যুদ্ধে অস্ত্রের পাশাপাশি যে কলমের লড়াই চলে, সেই যুদ্ধে দারিয়া ছিলেন দারুনভাবে সফল। তাঁর জনপ্রিয়তার জন্য রাশিয়া এমনকি ইউক্রেনের কিছু অংশেও রাশিয়ার পক্ষে জোরালো সমর্থন গড়ে উঠছিল।
১৯৯২ সালে দার্শনিক বাবা মা’র ঘরে জন্ম নেওয়া দারিয়া পড়েছেনও দর্শন এবং রাজনীতি নিয়ে।
এমন একজন উদীয়মান বুদ্ধিজীবীকে যে টার্গেট করবে যুক্তরাষ্ট্র আর তার মিত্ররা, সেটি জানতো সবাই। কিন্তু সতর্ক থাকার পরও নিজেকে রক্ষা করতে পারেননি দারিয়া।
তাঁর অসময়ে এই চিরপ্রস্থান রুশ সরকারের জন্য বড় এক ধাক্কা। যে কারণে প্রেসিডেন্ট পুতিন বারবার ওই হত্যাকাণ্ডের বদলা নেওয়ার অঙ্গীকার করছেন। এরইমধ্যে তার গোয়েন্দা সংস্থা ঘাতক ও তার কুশীলবদের খোঁজ বের করে ফেলেছে। দারিয়া হত্যার জন্য ইউক্রেনকে দায়ী করে রাশিয়ার গোয়েন্দা সংস্থা এফএসবি বলেছে, ইউক্রেনের গোয়েন্দা সংস্থা এ হত্যাকাণ্ডে জড়িত। সন্দেহভাজনের নাম ৪৩ বছর বয়েসি নাতালিয়া ভভক নামের এক ইউক্রেনের নাগরিক। হত্যাকাণ্ডের ছক কষে দিয়ে আগের দিনই সে এস্তোনিয়ায় পালিয়ে যায়।
এফএসবি আরও জানায়, ভভক রাশিয়ায় অবাধে চলাফেরার জন্য তাঁর কিশোরী মেয়েকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে। ২৯ বছর বয়সী সাংবাদিক দারিয়া যে ভবনে থাকতেন, সেই ভবনে একটি অ্যাপার্টমেন্ট ভাড়া নিয়ে অবস্থান নিয়েছিল ভভক। ঘাতক চক্রকে এখন হণ্যে হয়ে খুঁজছে রুশ গোয়েন্দারা।