ব্রিটিশ শাসনের আগে ১৯৪৬ সালের অক্টোবর-নভেম্বরে নোয়াখালীতে হিন্দু-মুসলিম ভয়াবহ দাঙ্গা হয়। ওই সময় ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতা মোহন দাস করমচাঁদ গান্ধী নোয়াখালী যান শান্তি মিশনে। পুরো অঞ্চলের প্রায় ১১৬ মাইল এলাকা তিনি কয়েক মাসে হেঁটে ঘুরে দেখেন। তার ওই সফরের উদ্দেশ্য ছিল হিন্দু-মুসলমানদের
সাথে কথা বলে হানাহানি বন্ধ করা। কিন্তু এই শান্তি সফরে এসে গান্ধী নিজের দুধ দেওয়া ছাগলও হারিয়ে ফেলেন। তার ছাগলটি চুরি যায় এবং সেটি রীতিমত জবাই করে রান্না করে তার সামনেই পরিবেশন করে কিছু উগ্রবাদী!
ব্রিটিশ শাসন অবসানের এক বছর আগে থেকেই হিন্দু ও মুসলমান সমাজের পারষ্পরিক সন্দেহ, অবিশ্বাস আর ঘৃণা চরমে পৌঁছায়। যার ফলে ১৯৪৬ সালের ১৬ই আগস্ট পূর্ব ভারতের ইতিহাসের কুখ্যাত সাম্প্রদায়িক হত্যাযজ্ঞ ‘দ্য গ্রেট ক্যালকাটা কিলিংস’ বা কলকাতা দাঙ্গা সংঘটিত হয়। দাঙ্গায় প্রথম ৭২ ঘণ্টার মধ্যে হিন্দু-মুসলিমসহ চার হাজার মানুষ প্রাণ হারান। গৃহহীন হন লক্ষাধিক মানুষ। ওই দাঙ্গার ঢেউ তৎকালীন নোয়াখালীতেও এসে লাগে। শুরু হয় আরেকটি হত্যাযজ্ঞ।
১৯৪৬ সালের অক্টোবরের ১০ তারিখ ছিলো কোজাগরি লক্ষ্মীপূজার দিন। উত্তপ্ত সাম্প্রদায়িক আবহাওয়ার মধ্যেই মুসলিম সমাজে একটি গুজব ছড়ায়। লক্ষ্মীপুরের রামগঞ্জ থানার করপাড়ার জমিদার রাজেন্দ্রলাল চৌধুরীর বাড়িতে ভারত সেবাশ্রম সংঘের এক সন্ন্যাসী এসে উঠেছেন। তার নাম ছিলো সাধু ত্রিয়াম্বাকানন্দ। গুজব রটে, সাধু নাকি ঘোষণা করেছেন, পূজার জন্য ছাগবলির বদলে এবার তিনি মুসলমানের রক্ত দিয়ে দেবীকে প্রসন্ন করবেন।
গুজবটি মুহুর্তে ছড়িয়ে পড়ে। তখন করপাড়া থেকে সামান্য দূরে ছিলো শ্যামপুর দায়রা শরীফ। আর গোলাম সারোয়ার হুসেইনী ছিলেন এই পীর বংশের উত্তর পুরুষ। তিনি চৌকিদারের মারফৎ রাজেন্দ্রলাল চৌধুরীর কাছে একটি চিঠি পাঠান এবং বিষয়টি নিয়ে আলোচনার প্রস্তাব দেন।
কিন্তু রাজেন্দ্রলাল চৌধুরী এতে সাড়া দেননি। যার ফলে গোলাম সারোয়ার হুসেইনী সকালে শাহ্পুর বাজারে তার অনুগত ভক্ত এবং মুসলমানদের এক সমাবেশ ডাকেন এবং সেখানে মুসলমানদের অবস্থান তুলে ধরে হিন্দু জমিদারকে উৎখাত করার ডাক দেন।
ওই সমাবেশ থেকে তিনি জমিদার ও সাধুর কল্লা কেটে আনার নির্দেশ দেন। এরপরই সহিংসতার আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে।
বিশাল এলাকাজুড়ে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি চলে যায় নিয়ন্ত্রণের বাইরে। প্রায় চার সপ্তাহ ধরে চলা এই দাঙ্গায় প্রায় পাঁচ হাজারের বেশি হিন্দু প্রাণ হারান।
নোয়াখালীতে চার সপ্তাহ ধরে চলা এই দাঙ্গার মধ্যে হাজার হাজার হিন্দু ঘরবাড়ি হারিয়ে কুমিল্লা, চাঁদপুর, আগরতলা ও অন্যান্য জায়গার অস্থায়ী আশ্রয় শিবিরে আশ্রয় নিতে শুরু করেন। এক পর্যায়ে নোয়াখালীতে আসার সিদ্ধান্ত নেন মহাত্মা গান্ধী।
৬ই নভেম্বর খালি পায়ে মোট ১১৬ মাইল হেঁটে প্রায় ৪৭টি দাঙ্গায় ক্ষতিগ্রস্ত গ্রাম পরিদর্শন করেন গান্ধী। এ সময় তিনি প্রতিদিনই নিয়মিত প্রার্থনা সভা পরিচালনা করেন ও স্থানীয় মুসলমানদের সাথে বৈঠক করে হিন্দুদের আস্থা অর্জন করেন।
গান্ধীর সাথে নোয়াখালী সফরকালে বহু ঘটনা ঘটে। এরমধ্যে একটি ঘটনা ছিল তার ছাগল চুরির ঘটনা। গান্ধী ছাগলের দুধ অনেক পছন্দ করতেন। তাই সাথে করে ছাগল এনেছিলেন তিনি। কিন্তু নোয়াখালীতে আসার পরই তার একটি ছাগল চুরি হয়ে যায়। জানা যায়, চাটখিলের বৈঠকের আগে কাশেম ফৌজের লোকজন ছাগলটি চুরি করে এবং ওই বৈঠকে সেই ছাগলের রান্না মাংস নিরামিষাশী গান্ধীর সামনে পরিবেশন করে!
মূলতঃ নোয়াখালীতে দাঙ্গার দেয়াল ভেঙে ফেলতে ব্যর্থ হন গান্ধী। নোয়াখালীর ঘটনার জেরে পরে বিহারে শুরু হয় দাঙ্গা। এতে অসংখ্য মুসলমান প্রাণ হারান। এ অবস্থায় মুসলিম লীগ নেতাদের অনুরোধে ১৯৪৭ সালের ২রা মার্চ গান্ধী ছোটেন বিহারের দিকে। পেছনে পড়ে থাকে উত্তপ্ত নোয়াখালীর শান্তি মিশন।