ট্রাম্প-জেলেনস্কি বাক-বিতণ্ডা কি পরিকল্পিত, যুক্তরাষ্ট্র আসলে কি চায়

দ্য রিপোর্ট ডেস্ক

মার্চ ৪, ২০২৫, ০১:৫৮ পিএম

ট্রাম্প-জেলেনস্কি বাক-বিতণ্ডা কি পরিকল্পিত, যুক্তরাষ্ট্র আসলে কি চায়

ছবি: সংগৃহীত

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির গত ২৮ ফেব্রুয়ারির বাক-বিতণ্ডাকে অনেক ঝানু কূটনৈতিক পর্যবেক্ষক পরিকল্পিত বলে মনে করেন। তাদের মতে, এটা একধরনের রাজনৈতিক ছিনতাই। জেলেনস্কিকে ব্যর্থ প্রমাণ করতে এবং তাকে সরিয়ে দিতে ট্রাম্প প্রশাসনের কর্মকর্তারাই ওভাল অফিসের ওই বিতণ্ডার পরিকল্পনা করেছিলেন। পরবর্তী আলাপ-আলোচনা নির্বিঘ্নে সারতেই এটা করা হয়েছিল।

ট্রাম্প-জেলেনস্কির ওই বিতণ্ডা পরিকল্পিতভাবে করা হোক বা না হোক, তবে এতে যে মস্কো সবচেয়ে বেশি উল্লসিত হয়েছে, তা আর গোপন নেই। এখন যুক্তরাষ্ট্র-রাশিয়ার সম্পর্ক ধারণার চেয়ে দ্রুতগতিতে স্বাভাবিক হতে শুরু করবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

ওই নাটকীয় ঘটনার পর ওয়াশিংটন-মস্কোর সম্পর্ক পুনরায় শুরুর বিষয় নিয়ে এখনো প্রকাশ্যে কেউ কিছু বলেনি। তবে পর্দার অন্তরালে ট্রাম্প-পুতিনের বৈঠক নিয়ে আলোচনা চলছে। এখন দুই প্রেসিডেন্টের বৈঠকই সর্বাধিক গুরুত্ব পাচ্ছে।

তবে প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কির সঙ্গে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ও তার দলের সদস্যদের বিরোধ হওয়ায় নতুন করে আশাবাদী হয়ে উঠেছে মস্কো। লক্ষণীয় বিষয় হলো, উদ্ভূত পরিস্থিতিতে ইউক্রেন যুদ্ধ শেষ করার আলাপটা গুরুত্ব হারাতে বসেছে। কারণ, যুদ্ধটা শেষ করা বেশ কঠিন। কিন্তু এখন যুক্তরাষ্ট্র-রাশিয়ার অর্থনীতিবিষয়ক আলাপ গুরুত্ব পাবে, যা এরই মধ্যে তলে তলে শুরু হয়ে গেছে।

ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর গত মাসে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার শীর্ষ কর্মকর্তারা সৌদি আরবের রাজধানী রিয়াদে প্রথমবারের মতো বৈঠক করেন। এতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধিদলের নেতৃত্বে ছিলেন দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও আর রাশিয়ার প্রতিনিধিদলের নেতৃত্বে ছিলেন দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভ। বৈঠকে দুই দেশের সম্পর্ক আবার স্বাভাবিক করার আলোচনার পাশাপাশি ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়েও আলাপ হয়। কিন্তু বৈঠকে ইউক্রেনকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি।

সিএনএন জানতে পেরেছে, যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার কর্মকর্তারা দ্বিতীয় দফা বৈঠকের প্রস্তুতি শুরু করেছেন। খুব শিগগির উপসাগরীয় অঞ্চলের কোনো একটি দেশে এই বৈঠক হতে যাচ্ছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

আসন্ন এই বৈঠক নিয়ে ক্রেমলিনের অর্থনীতিবিষয়ক প্রধান দূত কিরিল দিমিত্রিভ এরই মধ্যে কথা বলেছেন। তিনি সিএনএনকে বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে হতে যাওয়া এই আলোচনায় ‘জ্বালানি’ বিষয়ক কিছু চুক্তি নিয়েও কথা হবে। তবে এসব চুক্তি নিয়ে তিনি বিস্তারিত কিছু বলেননি।

ফিন্যান্সিয়াল টাইমসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইউরোপে গ্যাস সরবরাহ করার জন্য রাশিয়ার ‘নর্ড স্ট্রিম ২’ পাইপলাইন নিয়ে আলাপ নতুন করে শুরু হয়েছে। এতে যুক্তরাষ্ট্রের বিনিয়োগকারীদেরও যুক্ত করার চেষ্টা চলছে। ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলা শুরুর পরপরই নতুন এই পাইপলাইনের কার্যক্রম বন্ধ করে দিয়েছিল জার্মানি।

‘মানব জাতির জন্য ভালো ভবিষ্যৎ নির্মাণ’ করতে ট্রাম্প প্রশাসন ও রাশিয়াকে একসঙ্গে কাজ করার আহ্বান জানিয়েছেন কিরিল দিমিত্রিভ। তিনি মনে করেন, ওয়াশিংটন ও মস্কোকে ‘বিনিয়োগ, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তায় (এআই) নতুন দিগন্ত উন্মোচনের’ দিকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দিতে হবে। ‘মঙ্গল গ্রহে অনুসন্ধান পরিচালনার’ মতো বিজ্ঞানবিষয়ক প্রকল্পে দীর্ঘমেয়াদে কাজ করতে দুই দেশকে যৌথ প্রকল্প হাতে নিতে হবে।

রাশিয়ার অর্থনীতিবিষয়ক এই দূত ইলন মাস্কের মালিকানাধীন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে কম্পিউটারে তৈরি একটি গ্রাফিকস পোস্ট করেছেন। এতে যুক্তরাষ্ট্র-রাশিয়া-সৌদি আরবকে যৌথভাবে মঙ্গল গ্রহে অভিযান চালাতে দেখা যায়। এই গ্রাফিকসের রকেটটি ইলন মাস্কের কোম্পানি স্পেসএক্সের তৈরি করা বলে মনে হয়েছে।

এক্সে কিরিল দিমিত্রিভ মন্তব্য করেন, ‘ট্রাম্পের ব্যবসায়িক সূক্ষ্মদৃষ্টি বাইডেনের বয়ান চুরমার করে দিয়েছে। রাশিয়াকে পরাস্ত করার চেষ্টা খান খান হয়ে গেছে।’

ট্রাম্পকে অনেকে অর্থের জন্য মরিয়া বলে মনে করেন। কিন্তু গত জানুয়ারিতে ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে ট্রাম্পের কাজে অর্থের চেয়ে যুক্তরাষ্ট্র-রাশিয়ার সম্পর্ককে মৌলিকভাবে বদলে দেওয়ার চেষ্টা প্রাধান্য পেয়েছে।

পশ্চিমা মিত্রদের পৃষ্ঠ প্রদর্শন করে ট্রাম্প প্রশাসন নজিরবিহীনভাবে ক্রেমলিনের দিকে ঝুঁকে পড়েছে। এতে বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে ওয়াশিংটনের ইউরোপীয় মিত্ররা নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েছে।

ওয়াশিংটন যে গতিতে নিজেদের পররাষ্ট্রনীতি বদলাচ্ছে, তা নিয়ে ক্রেমলিন জনসম্মুখে যে মন্তব্য করেছে, তা গুরুত্বপূর্ণ। গত রোববার রাশিয়ার রাষ্ট্রায়ত্ত টেলিভিশনে ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্র পেসকভ বলেন, ‘(যুক্তরাষ্ট্রের) নতুন প্রশাসন নিজেদের পররাষ্ট্রনীতির বৈশিষ্ট্যগুলো দ্রুত বদলাচ্ছে। এটা আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে অনেকাংশে মিলে যাচ্ছে।’  

তবে পুরোনো মিত্রদের বাদ দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট কেন ক্রেমলিনকে বেছে নিচ্ছেন, তা নিয়ে ব্যাপক জল্পনা চলছে। অনেক বিশেষজ্ঞকে প্রায় সময় ট্রাম্পকে ক্রেমলিনের ‘এজেন্ট বা পুতিনের প্রতি ‘কৃতজ্ঞ ব্যক্তি’ বলে মন্তব্য করতে শোনা যায়। কিন্তু এসব দাবির পক্ষে কোনো প্রমাণ নেই।

তবে বিশেষজ্ঞদের কেউ কেউ মনে করেন, রাশিয়াকে নিজেদের সহজাত (ন্যাচারাল) মিত্র মনে করে যুক্তরাষ্ট্র। বিশেষ করে, ভবিষ্যতে চীনের সঙ্গে সংঘাত হলে রাশিয়াকে নিজেদের পাশে পাবে বলে বিশ্বাস করছেন ট্রাম্প প্রশাসনের কর্মকর্তারা। এই কারণেই ভূরাজনৈতিক নীতি এতটা বদলে ফেলেছে ওয়াশিংটন। কিন্তু এটা সম্ভবত যুক্তরাষ্ট্রের ডানপন্থীদের আদর্শিক খাম-খেয়ালের ছাড়া কিছু নয়।

যাই হোক, প্রকাশ্যে শত্রুতামূলক না হলেও সাধারণভাবে টানাপোড়েনে থাকা যুক্তরাষ্ট্র-রাশিয়ার সম্পর্ক যে একটি নতুন ধাপে প্রবেশ করছে, তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই।

Link copied!