উত্তরপ্রদেশের ‘রবিনহুড’ ছিলেন নিহত আতিক আহমেদ

দ্য রিপোর্ট ডেস্ক

এপ্রিল ১৭, ২০২৩, ০৯:৫৪ এএম

উত্তরপ্রদেশের ‘রবিনহুড’ ছিলেন নিহত আতিক আহমেদ

অসংখ্য মানুষ। অনেক মিডিয়ার ক্যামেরার চোখ। পুলিশি কড়া নিরাপত্তা। এরইমধ্যে এক মিনিটের কম সময়। সব শেষ! ভারতের উত্তর প্রদেশের এলাহাবাদে ঘটে গেল সেই ঘটনা। একেবারে থ্রিলার সিনেমার মতোই। রাজ্যের আলোচিত মাফিয়া ডন থেকে জনদরদী রাজনীতিক হয়ে উঠা সাবেক পার্লামেন্ট সদস্য আতিক আহমেদ ও তাঁর ভাই আশরাফ আহমেদকে ফটোগ্রাফারের ছদ্মবেশে থাকা আততায়ীরা ‍পয়েন্ট ব্ল্যাংক রেঞ্জ থেকে গুলি করে হত্যা করে। সাবেক পুলিশ কর্তারা বলছেন, আতিক আহমেদ ছিলেন জনদরদী ‘রবিনহুড’ চরিত্রের মতো একজন। দরিদ্র মানুষদের জন্য দেদার দান-সহযোগিতা করতেন। তবে তাঁর বিরুদ্ধে বহু অপরাধের মামলাও ছিল।

ঘটনার দিন শনিবার রাতের ফুটেজে দেখা গেছে, উত্তর প্রদেশের এলাহাবাদে (বর্তমান নাম প্রয়াগরাজ) পুলিশের গাড়ি থেকে নামিয়ে আনা হচ্ছে আতিক আহমেদকে। সাবেক পার্লামেন্ট সদস্য আতিক আহমেদ ফৌজদারি অপরাধে দণ্ডিত ছিলেন। ভারী শরীরের আতিককে গাড়ি থেকে নামতে সাহায্য করছিলেন একজন পুলিশ সদস্য ও তাঁর ভাই আশরাফ।

একদল পুলিশ কনস্টেবল পরিবেষ্টিত অবস্থায় যখন তাঁরা হাঁটতে শুরু করেন, তখন স্থানীয় টেলিভিশন সাংবাদিকেরা তাঁদের ঘিরে ধরেন। সাংবাদিক ছদ্মবেশে সেখানে ছিলেন আততায়ীরাও।

একটি বন্দুক তাঁর মাথার কাছে নেওয়া হয়। গুলিবর্ষণের পর তিনি মাটিয়ে লুটিয়ে পড়েন, তাঁর মাথা থেকে সাদা পাগড়ি বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। মুহূর্তকাল পরে তাঁর ভাইকেও গুলি করা হয়।

কারা এই ঘাতক? 

দুজন বন্দুকধারী ও আরেকজন ব্যক্তি সাথে সাথে উপস্থিত পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করেন। উত্তর প্রদেশ রাজ্য সরকার এ ঘটনা তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে। কিন্তু শনিবার সন্ধ্যার ওই হত্যাকাণ্ড নিয়ে সরব হয়েছেন স্থানীয় ও জাতীয় রাজনীতিকেরা। তাঁরা বলছেন, এতে প্রমাণিত হয়েছে যে এ রাজ্যে আইনশৃঙ্খলা বলে কিছু নেই। যা ছিল তা ভেঙে পড়েছে।

আইনজীবী ও রাজনীতিক কপিল সিবাল যেমনটা বলেছেন, উত্তর প্রদেশে দুটি হত্যাকাণ্ড ঘটেছে— একটি আতিক এবং দ্বিতীয়টি তাঁর ভাই আশরাফ। এই হলো এখানকার আইনের শাসন।

উত্তর প্রদেশ রাজ্য পুলিশের সাবেক মহাপরিচালক বিক্রম সিং বিবিসিকে বলেছেন, আতিক আহমেদের হত্যাকাণ্ড অগ্রহণযোগ্য। হেফাজতে মৃত্যু খুবই খারাপ বিষয়। সেখানে হত্যাকাণ্ড তো আরও বেশি খারাপ বিষয়। আতিক আহমেদ একজন বিতর্কিত মানুষ ছিলেন— এ কথা বলে এই হত্যাকাণ্ডকে জায়েজ করা যায় না।

আতিক আহমেদের বয়স হয়েছিল ৬০ বছর। তাঁর জন্ম এলাহাবাদের একটি দরিদ্র পরিবারে। স্কুলের গণ্ডি পার করতে পারেননি তিনি। তবে তিনি জীবনে অনেক ধন সম্পদের মালিক হয়েছিলেন। রাজনীতিতে পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েছেন। তাঁর ক্ষমতার প্রভাব নিজ শহরের বাইরেও বিস্তৃত হয়েছিল।

প্রভাব-প্রতিপত্তির শুরু

এলাহাবাদ শহর থেকে ১৯৮৯ সালে শুরু করে পাঁচ দফায় বিধানসভার সদস্য নির্বাচিত হন আতিক আহমেদ। ২০০৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে ফুলপুর আসন থেকে সদস্য নির্বাচিত হন তিনি।

রাজ্যের সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা বিক্রম সিং আতিক আহমেদকে বর্ণনা করেছেন অনেকটা ‘রবিন হুড’ চরিত্রের মতো করে। তাঁর ভাষ্যমতে, আতিক আহমেদ দরিদ্র মানুষের জন্য হাত খুলে খরচ করতেন। কারোর মেয়ের বিয়ে হবে, তার জন্য অর্থ দেওয়া, ঈদ বকশিশ এবং সন্তানদের স্কুল ইউনিফর্ম ও বই–খাতা কিনতে সহায়তা তিনি নিয়মিত করতেন।

তবে তাঁর বিরুদ্ধে অপহরণ, হত্যা, চাঁদাবাজি ও জমি দখলের অভিযোগ ছিল। আতিক আহমেদের বিরুদ্ধে শতাধিক মামলাও রয়েছে। তিনি এর চেয়ে বেশি অপরাধে জড়িত ছিলেন বলে ধারণা করা হয়। ভুক্তভোগীদের অনেকে তাঁর বিরুদ্ধে থানায় মামলা করতেও সাহস পেতেন না বলে জানান বিক্রম সিং।

দুই দশকের বেশি সময় কারাগারেও কাটিয়েছেন আতিক। সেখান থেকেই তিনি উত্তর প্রদেশের অপরাধজগৎ নিয়ন্ত্রণ করতেন। নিজের অনুসারীরা যেন ধরা না পড়ে, তারও বন্দোবস্ত করতেন তিনি।

পতনের শুরু

আতিক আহমেদের পরিস্থিতি পাল্টাতে শুরু করে সমাজবাদী পার্টি তাঁর সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করার পর। রাজ্যে ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) ক্ষমতায় আসে এবং তাঁর ক্ষমতা কমতে শুরু করে তখন থেকে।

হামলার একটি মামলায় ২০১৭ সালে আতিক আহমেদকে গ্রেপ্তার এবং পশ্চিমাঞ্চলীয় গুজরাট রাজ্যে তাঁকে কারাগারে পাঠানো হয়।

আতিক আহমেদের বিরুদ্ধে সর্বশেষ ব্যবস্থা নেওয়া হয় গত ফেব্রুয়ারিতে উমেশ পাল নামের একজনকে হত্যার ভিডিও প্রকাশের পর। উমেশ পাল ছিলেন ২০০৫ সালে বহুজন সমাজ পার্টির আইনপ্রণেতা রাজু পাল হত্যাকাণ্ডের গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষী। আতিক আহমেদ ও তাঁর ভাই ওই হত্যাকাণ্ডে যুক্ত ছিলেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

ফেব্রুয়ারিতে ওই ভিডিও প্রকাশের পর আতিক আহমেদ ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের ওপর খড়্গহস্ত নেমে আসে। তাঁর পরিবারের সদস্য ও অনুসারী মিলিয়ে বেশ কয়েকজন মারা যান। তাঁর স্ত্রীকে ধরিয়ে দিতে পারলে পুরস্কার ঘোষণা করা হয়, দুই ছেলে কারাবন্দী হন এবং অপর দুই ছেলে অপ্রাপ্তবয়স্ক হওয়ায় তাদের সরকারের কিশোর সংশোধনাগারে নেওয়া হয়।

ভারতের সুপ্রিম কোর্ট গত মাসে আতিক আহমেদের মামলা শুনতে অস্বীকৃতি জানান। এ ক্ষেত্রে আদালত বলেছিল, পুলিশের দিক থেকে আতিক আহমেদের জীবন হুমকিতে রয়েছে। সর্বোচ্চ আদালত শুনানিতে অস্বীকৃতি জানানোর পর আতিক আহমেদকে এলাহাবাদে আনা হয়। তাঁর ভাইকেও রাজ্যের অন্য একটি জেলার কারাগার থেকে সেখানে আনা হয়।

এরইমধ্যে বৃহস্পতিবার আতিক আহমেদের ১৯ বছর বয়সী ছেলে আসাদ এবং তাঁর এক সহযোগী পুলিশের কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন। অভিযোগ উঠে, পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী তাঁদেরকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে।

এদিকে আতিক হত্যাকাণ্ডের পরদিন রবিবার সকালে এলাহাবাদের অনেক এলাকায় ভুতুড়ে অবস্থা ছিল। প্রাচীন এই শহরের প্রধান বাজারটি রোজার এই সময়ে সাধারণত সরগরম থাকে। কিন্তু এদিন সেখানে নীরবতা দেখা যায়। প্রায় প্রতিটি সড়কে পুলিশ মোতায়েন করা হয়। অধিকাংশ এলাকায় ইন্টারনেট সেবা ব্যাহত হয়েছে। স্থানীয় লোকজন এসব হত্যাকাণ্ড নিয়ে সংবাদমাধ্যমসহ কারও সাথে কথা বলছেন না।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে ৪০ বছর বয়সী এক মুসলিম নাগরিক বিবিসিকে বলেন, লোকজন ব্যথিত। এভাবে পুলিশ ও গণমাধ্যমের সামনে কীভাবে একজনকে হত্যা করা সম্ভব? তিনি দণ্ডিত অপরাধী—সেটা আমি স্বীকার করছি। কিন্তু তাঁর অর্থ এই নয় যে তাঁকে এভাবে গুলি করে হত্যা করতে হবে। আইনের শাসন কোথায়?

বিবিসি

Link copied!