মিয়ানমারের সশস্ত্র বাহিনীকে অস্ত্র সরবরাহ করার জন্য চীন-পাকিস্তানের মধ্যকার বহু পুরনো মৈত্রীর সম্পর্কটি ব্যবহার করছে চীন। পাকিস্তানকে বিপুল পরিমাণ অর্থনৈতিক ও সামরিক সহায়তা দেয়ার মাধ্যমে চীন যে সুসম্পর্ক তৈরি করেছে সেটি কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশের প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমারে অস্ত্র পাঠাচ্ছে। এমনটাই বলা হয়েছে থাইল্যান্ডভিত্তিক মিয়ানমারের সংবাদমাধ্যম ইরাবতীর এক নিবন্ধে।
চীন–মিয়ানমার বিষয়ক এক রাজনৈতিক বিশ্লেষক ‘ইয়ান নাইঙ’ ছদ্মনামে ইরাবতীতে প্রকাশিত ওই নিবন্ধে বলেছেন, ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে মিয়ানমারে সেনা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে নির্বাচিত সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করার পর থেকেই দেশটিতে ব্যাপক চীনবিরোধী বিক্ষোভ-মিছিল সংঘটিত হয়। দেশটির বিরাট একটি অংশ মনে করে, জান্তা সরকারকে সমর্থন দিচ্ছে বেইজিং। এই মনোভাব বুঝতে পেরে চীন দেশটির সাধারণ মানুষের মধ্যে ইতিবাচক মনোভাব ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছে। সেই সঙ্গে তলে তলে জান্তার সঙ্গেও যোগাযোগ রাখছে।
ইসলামাবাদ-নেপিডো উভয়ের সঙ্গেই বেইজিংয়ের বোঝাপড়া রয়েছে। এর একটি উদাহরণ হলো দেশটিতে নিযুক্ত চীনা রাষ্ট্রদূত চেন হাইয়ের সঙ্গে মিয়ানমারের ধর্ম ও সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রী ইউ কো কোর সাম্প্রতিক সাক্ষাৎ। তাঁরা একটি প্যাগোডায় চীনা অর্থায়নে নির্মিত নিরাপত্তা দরজার উদ্বোধন করেন। সেই অনুষ্ঠানে চেন হাই বলেন, চীন ও মিয়ানমারের বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের মধ্যে এই বন্ধুত্বপূর্ণ ভাববিনিময়ে তিনি আনন্দিত।
একই সঙ্গে মিয়ানমারে সামরিক অভ্যুত্থানের পর চীন জান্তা সরকার ও জান্তাবিরোধী জাতীয় ঐক্যের সরকারের (এনইউজি) সঙ্গে যোগাযোগ এবং অনানুষ্ঠানিক সংলাপের বিষয়ে সতর্ক পদক্ষেপ নিচ্ছে।
তবে বিশ্লেষক ইয়ান নাইঙের মতে, প্রতিবেশী হিসেবে চীন খুব একটা বিশ্বস্ত নয়। চীন রাশিয়ার মতো খোলাখুলি মিয়ানমারের জান্তা বাহিনীকে সমর্থন কিংবা অস্ত্রসহায়তাও দিতে পারে না। এমনকি জান্তা বাহিনীকে দেওয়া চীনা সহায়তা পশ্চিমাদের গোয়েন্দা নজরদারিতে রয়েছে। সে ক্ষেত্রে গোয়েন্দা সূত্রগুলো বলছে, মিয়ানমারে জান্তা বাহিনীর কাছে অস্ত্র বিক্রি করতে পাকিস্তানের সহায়তা নিতে পারে বেইজিং।
সম্প্রতি মিয়ানমারের জান্তাপ্রধান মিন অং হ্লাইং বেশ কয়েক দফা রাশিয়া সফর করেছেন। দেশটির কাছ থেকে যুদ্ধবিমান, হেলিকপ্টার ও ক্ষেপণাস্ত্র কিনেছেন। বেইজিং বিষয়টিকে মিয়ানমারে নিজেদের অস্ত্রের বাজার হারানোর ঝুঁকি হিসেবে দেখছে। চীনের এই উদ্বেগের মধ্যে জান্তা সরকারকে নিরাপত্তা ইস্যুতে সামরিক সহযোগিতা দিতে বেইজিংয়ের প্রক্সি দিচ্ছে পাকিস্তান।
এ দিকে পাকিস্তান মিয়ানমারের বিমানবাহিনীকে জেএফ-১৭ থান্ডার ব্লক-২ যুদ্ধবিমান সরবরাহ করছে বলে খবর বেরিয়েছে। ২০১৮ সালে মিয়ানমারের সশস্ত্র বাহিনী পাকিস্তানের কাছ থেকে জেএফ-১৭ থান্ডার মাল্টিরোল যুদ্ধবিমান কিনেছিল ৫৬ কোটি ডলারে।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, এই যুদ্ধবিমানগুলোর যৌথ নির্মাতা পাকিস্তান অ্যারোনটিক্যাল কমপ্লেক্স এবং চীনের চেংদু অ্যারোস্পেস করপোরেশন। বিষয়টি এখানেই সীমাবদ্ধ নেই। মিয়ানমার পাকিস্তানের কাছ থেকে ৬০ এবং ৮১ মিলিমিটার মর্টার, এম-৭৯ গ্রেনেড এবং ভারী মেশিনগানও কেনার পরিকল্পনা করছে।
ইসলামাবাদ মিয়ানমারের জান্তা সরকারের কড়া সমালোচক ছিল একসময়। বিশেষ করে রাখাইন রাজ্যে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রোহিঙ্গা নৃগোষ্ঠীর ওপর নিপীড়ন ও মানবতাবিরোধী অপরাধের বিষয়ে পাকিস্তান বেশ সরব ছিল। বিপরীতে মিয়ানমারও পাকিস্তানের বিরুদ্ধে রাখাইনে রোহিঙ্গা বিদ্রোহীদের প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র দিয়ে সহযোগিতা করার অভিযোগ তুলেছিল। তবে এখন দুই দেশের মধ্যকার দূরত্ব ঘুচে যাচ্ছে, এর মূল কারিগর চীন। বেইজিংই পাকিস্তান ও মিয়ানমারের মধ্যে অস্ত্র চুক্তিতে মধ্যস্থতা করেছে। নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞদের দাবি, চীন গোপনে মিয়ানমারের জান্তার সঙ্গে সহযোগিতা বাড়িয়েছে। সেই গোপন সহযোগিতার অংশ হিসেবে বেইজিং জান্তা সরকারকে অস্ত্র সরবরাহ করতে ইসলামাবাদকে মাধ্যম হিসেবে বেছে নিয়েছে। কারণ, বেইজিং মিয়ানমারে গভীর চীনবিরোধী মনোভাব এবং জান্তাকে অস্ত্র সরবরাহের বিষয়টি ফাঁস হলে সম্ভাব্য প্রতিক্রিয়া কী হতে পারে সে বিষয়ে সতর্ক।
অভ্যুত্থানের পরপরই মিয়ানমারে চীনবিরোধী মনোভাব বৃদ্ধি পায়। মিয়ানমারের অনেকেই বিশ্বাস করেন, অভ্যুত্থানে বেইজিংয়ের হাত ছিল এবং অভ্যুত্থানের পরপরই বেইজিং জান্তা বাহিনীর নিন্দা করা থেকে বিরত থাকলে সেই সন্দেহ আরও ঘনীভূত হয়। ফলে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে চীনের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ইউনান প্রদেশ পর্যন্ত তেল-গ্যাসের পাইপলাইন উড়িয়ে দেওয়াসহ সব চীনা পণ্য বয়কটের আহ্বান জানায় জান্তাবিরোধী জনতা।
চলতি বছরের শুরুর দিকে জান্তাবিরোধী যোদ্ধারা সাগাইন অঞ্চলে চীনের অর্থায়নে নির্মিত একটি নিকেল প্রক্রিয়াকরণ কারখানায় আক্রমণ করেছিল। সে সময় বেইজিং জাতীয় ঐক্যের সরকারকে অনুরোধ করেছিল, যাতে প্রতিরোধ যোদ্ধারা চীনা বিনিয়োগকে আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু না করে। যদিও জনসমক্ষে বেইজিং মিয়ানমারের জান্তা সরকারকে গণতন্ত্রে ফিরে আসার আহ্বান জানিয়েছে। তবে অনেকে বিশ্বাস করেন, চীন গোপনে জান্তা বাহিনীকে অস্ত্র সরবরাহ করে চলেছে। যার মধ্যে রয়েছে সিএইচ–৩ ড্রোনসহ ছোট ছোট অস্ত্র। গত বছর যুক্তরাজ্যভিত্তিক জেনস ইন্টারন্যাশনাল ডিফেন্স রিভিউ এবং ওয়াশিংটনভিত্তিক সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজ উভয় প্রতিষ্ঠানই মিয়ানমারে চীনের নির্মিত সিএইচ–৩এ ড্রোনের ব্যবহার চিহ্নিত করতে সক্ষম হয়েছে।
যাই হোক, বেইজিং-ইসলামাবাদের এই পরিকল্পনায় বাদ সাধছে জাতীয় ঐক্যের সরকারের সশস্ত্র শাখা পিপলস ডিফেন্স ফোর্সেসের (পিডিএফ) ক্রমবর্ধমান প্রতিরোধ। জাতিগত সশস্ত্র সংগঠনগুলোর সঙ্গে একজোট হয়ে পিডিএফ প্রায় প্রতিদিনই জান্তা বাহিনীর ওপর আক্রমণ চালিয়ে সফল হচ্ছে। জাতীয় ঐক্যের সরকারের দাবি, তারা মিয়ানমারের অন্তত ৫৩ শতাংশ এলাকার নিয়ন্ত্রণ নিতে সক্ষম হয়েছে। বিপরীতে জান্তা বাহিনীর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে রয়েছে মাত্র ৫-৬ শতাংশ এলাকা। তাই মিয়ানমারে প্রতিরোধ যোদ্ধাদের শক্তি ও অগ্রগতি যত বাড়বে, জান্তা বাহিনী তার বৈদেশিক মিত্রদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতাও তত বাড়াবে।
নির্দিষ্ট কোনো গোষ্ঠী নয়, জনগণের মধ্যে নিজেদের ব্যাপারে ইতিবাচক মনোভাব তৈরি করাই হতে পারে সবচেয়ে কার্যকর কৌশল। বেইজিং সে ব্যাপারে যে সজাগ নয় তা বলা যায় না। হয়তো সে কারণেই, সাংস্কৃতিক এবং অন্যান্য জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট খাতে মনোযোগ দিচ্ছে চীন। উদাহরণ হিসেবে, গত মাসে চীনা রাষ্ট্রদূতের প্যাগোডা সফরকে উল্লেখ করা যেতে পারে। কিন্তু জান্তাকে সামরিক সরঞ্জাম দেওয়ার তথ্য জান্তাবিরোধী সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের কাছে বেইজিংয়ের গ্রহণযোগ্যতা চ্যালেঞ্জের মুখেই ফেলবে।