মিয়ানমারের সেনাবাহিনী যে কারণে এত নৃশংস

দ্য রিপোর্ট ডেস্ক

ফেব্রুয়ারি ৩, ২০২২, ০৩:১৩ এএম

মিয়ানমারের সেনাবাহিনী যে কারণে এত নৃশংস

মিয়ানমারে এক বছর আগে অং সান সু চির গণতান্ত্রিক সরকারকে উৎখাত করে দেশের ক্ষমতায় আসে দেশটির সেনাবাহিনী; যারা ‘তাতমাদো’ নামে পরিচিত। অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখলের বিরুদ্ধে উঠে দাঁড়ানো সাধারণ মানুষের বিক্ষোভ দমন করতে গিয়ে শত শত ‍মানুষকে হত্যা করে এই তাতমাদো বিশ্বকে হতবাক করে দিয়েছে।

Myanmar-coup-4
বিক্ষোভ দমনে স্নাইপারও ব্যবহার করে সেনাবাহিনী! ছবি: সংগৃহীত

নিহতদের মধ্যে শিশু-কিশোররাও রয়েছে। বিক্ষোভ দমনের সময় এরা স্নাইপার দিয়েও নিরীহ মানুষ হত্যা করে! কেন মিয়ানমার সেনাবাহিনী এত নৃশংস? কীভাবেই বা তারা এতটা প্রভাবশালী হয়ে উঠেছে তার উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছে ‍বিবিসি।

বিবিসি-র অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, অভ্যুত্থানের পর এই এক বছরে তাতমাদো শহরের সড়কগুলোতে যেমন মানুষ মেরেছে, তেমন গ্রামের পর গ্রামে রক্তক্ষয়ী অভিযান চালিয়েছে। বিরোধী মতের দমনে তারা নৃশংস নিপীড়ন, গণহত্যা চালিয়েছে।

২০২১ সালের ১ ফেব্রুয়ারি অভ্যুত্থানের পর এখন পর্যন্ত মিয়ানমার সেনাবাহিনী দেড়হাজারের বেশি মানুষকে হত্যা করেছে বলে জানিয়েছে অ্যাসিসটেন্স অ্যাসোসিয়েশন ফর পলিটিক্যাল প্রিজোনার্স (বার্মা)।

Myanmar-coup-01
সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরা বহির্বিশ্বের মনোভাব বোঝে না, বা বোঝার চেষ্টাও নেই। ছবি: দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস

তাতমাদো কারা?

বার্মিজ ভাষায় তাতমাদো শব্দের অর্থ ‘সশস্ত্র বাহিনী’। খুব সাধারণ এই শব্দটিই বর্তমান সেনাশাসকদের সামর্থক শব্দে পরিণত হয়েছে। দেশের ভেতরে যারা অসীম ক্ষমতার মালিক এবং বিশ্বজুড়ে যারা কুখ্যাত।

তাতমাদোর শেকড় বার্মা ইন্ডিপেন্ডেন্স আর্মি (বিআইএ) পর্যন্ত বিস্তৃত। ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে এক দল বিপ্লবী ১৯৪১ সালে বিআইএ গঠন করে। ওই বিপ্লবীদের মধ্যে অং সান সু চির বাবা অং সানও ছিলেন। যাকে মিয়ানমারের অনেক নাগরিক ‘জাতির পিতা’ হিসেবে সম্মান করেন।

১৯৪৮ সালে স্বাধীনতা লাভের কিছুদিনের মধ্যেই গুপ্তহত্যার শিকার হন অং সান। যদিও তার মৃত্যুর আগে থেকেই বিআইএ অন্যান্য মিলিশিয়াদের সঙ্গে সমন্বয় করে জাতীয় সশস্ত্রবাহিনী গঠনের কাজ শুরু করে। স্বাধীনতার পর যা একটি সুসংগঠিত সশস্ত্রবাহিনীর রূপ নেয়, যেটি এখন তাতমাদো নামে পরিচিত।

Myanmar-coup-03
সামরিক বাহিনীতে অনেক তরুন সেনার এখন মোহভঙ্গ ঘটছে। ছবি: Reuters

স্বাধীনতার পর এই বাহিনীর দ্রুত ক্ষমতাধর হয়ে উঠে এবং প্রভাব বিস্তার শরু করে। ১৯৬২ সালে অভ্যুত্থানের মাধ্যমে দেশটির ক্ষমতা দখল করে। তারপর প্রায় ৫০ বছর তারা কার্যত বিরোধিতাহীন ভাবে দেশ শাসন করে। ১৯৮৯ সালে সামরিক সরকারই দেশটির নাম পরিবর্তন করে বার্মা থেকে মিয়ানমার রাখে।

সেনাবাহিনী নিয়ে মিয়ানমারের তরুণদের মধ্যে এক ধরনের উচ্চ ধারণা রয়েছে। সেনাবিহিনীতে যোগ দিতে পারলে হঠাৎ করেই প্রভাবশালী হয়ে উঠা যায়। তাই অনেক উচ্চাকাঙ্ক্ষী তরুণের একমাত্র লক্ষ্য সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়া। যদিও এবারের অভ্যুত্থানের পর কিছু তরুণের মোহভঙ্গ হয়েছে এবং তারা দল ত্যাগ করেছেন।

Myanmar-coup-1
ভোটে জিতেও সামরিক বাহিনীর বিশ্বাসঘাতকতায় ক্ষমতা পাননি গণতন্ত্রপন্থী নেত্রী অং সান সু চি। ছবি: সংগৃহীত

এমন একজন লিন হতেত অং (ছদ্মনাম)। সেনাবাহিনীর সাবেক এই ক্যাপ্টেন বিবিসি-কে বলেন, ‘‘আমি সেনাবাহিনীতে যোগ দেই, কারণ আমি একটি বন্দুক উঁচিয়ে ধরে যুদ্ধক্ষেত্রে যেতে চেয়েছিলাম, যুদ্ধ করতে। আমি অভিযান পছন্দ করি। দেশের জন্য প্রাণ দেওয়ার ইচ্ছাই আমার আছে।”

‘‘কিন্তু এখন আমার অনেক লজ্জা হয়। সামরিক বাহিনীর বিষয়ে আমি ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। শন্তিপূর্ণ বিক্ষোভে নৃশংসভাবে হামলা করা হয়েছে। কোথাও কোথাও বোমা, আগ্নেয়াস্ত্র এবং স্নাইপার দিয়েও নিরীহ মানুষ হত্যা করা হয়েছে। আমরা যেটা আশা করেছিলাম এটা সেই তাতমাদো নয়। তাই আমি সিডিএম এ যোগ দিয়েছি।”

১ ফেব্রুয়ারির অভ্যুত্থানের পর মিয়ানমারজুড়ে নানা মিলিশিয়াগোষ্ঠী সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করছে। সব বাহিনীর সমন্বয়ে গঠন করা হয়েছে সিভিল ডিসঅবিডিয়েন্স মুভমেন্ট (সিডিএম)। সেনাসদস্য ছাড়াও, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, নার্স, ট্রেড ইউনিয়ন কর্মী, শ্রমিক, কৃষকসহ সমাজের সব স্তরের মানুষ সিডিএম- এ যোগ দিয়েছেন।

Myanmar-coup-02
সেনাপ্রধান বরাবরই সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। কিন্তু তারপরও কথা আছে...

মিয়ানমারের প্রতিমূর্তি

বৌদ্ধ অধ্যুষিত মিয়ানমারে ১৩০টির বেশি আলাদা জাতিগোষ্ঠী বাস। সেখানকার বামার জাতিগোষ্ঠী নিজেদের সবথেকে অভিজাত শ্রেণী বলে মনে করে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশটির সেনাবাহিনী এখন এই অভিজাতদের মধ্যেও নিজেদের বেশি কুলীন বলে ভাবে।

তারা নিজেদের আধুনিক মিয়ানমারের ইতিহাসে জাতির প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে তুলে ধরছে। প্রায়ই তারা নিজেদের দেশের প্রতিমূর্তি বলে। যার অর্থ, তারাই প্রকৃত বার্মিজ।

ব্যাংককে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে মিয়ানমার বিষয়ক বিশেষজ্ঞ উইন রবিনসন বলেন, ‘‘এটি একেবারে উগ্র জাতীয়তাবাদী আদর্শ। তারা সব সময় সংখ্যালঘু জাতিগোষ্ঠীগুলোকে হুমকি হিসেবে দেখে।

Myanmar-coup-04
সেনাবিরোধী বিক্ষোভ এখন গৃহযুদ্ধে রূপ নিচ্ছে। ছবি: সংগৃহীত

তারা মনে করে, সংখ্যালঘু জাতিগোষ্ঠীর মিয়ানমারের মাটিতে থাকার অধিকার নেই, তারা সবসময় দেশের ঐক্য ও স্থিতিশীলতাকে বিনষ্ট করতে চায়। তাদের অবশ্যই মুছে ফেলতে হবে বা দমন করতে হবে।”

কয়েক দশক ধরেই মিয়ানমারের সমাজ ব্যবস্থায় এই মত চালু আছে। ফলে দেশেটিতে অনেক খণ্ড খণ্ড গৃহযুদ্ধ সব সময়ই লেগে আছে। সেনাবাহিনী বিভিন্ন জাতির মিলিশিয়াদের বিরুদ্ধে টানা লড়াই করে চলেছে।

অনেক বিশ্লেষকের কাছে এটি বিশ্বের দীর্ঘতম চলমান গৃহযুদ্ধ। মিয়ানমার বিশেষজ্ঞ উইন রবিনসন বলেন, এটিই তাতমাদোকে একটি নৃশংস লড়াইয়ের মেশিনে পরিণত করেছে। যারা রোবটের মতো শুধু নির্দেশ পালন করে।

একের পর এক অভিযানে অংশ নেওয়ার ফলে সেনারা যুদ্ধবাজ এবং উল্লেখযোগ্যভাবে দেশের ভেতরে হত্যায় অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে।

রোহিঙ্গা মুসলমানদের মতো কিছু সংখ্যালঘু জাতিগোষ্ঠী তাতমাদোর সবচেয়ে নৃশংসতার শিকার হয়েছে। এখন বৌদ্ধসহ সব ধর্ম এবং জাতির বিক্ষোভকারীরা নিজেদের সেনাবাহিনীর হাতে নিহত হচ্ছে।

Myanmar-coup-2
সাধারন জনগণের ওপর সেনাবাহিনীর নিষ্ঠুরতা বিশ্বকে ভাবিয়ে তুলেছে। 

যেন আলাদা এক ধর্মীয় সংস্কৃতি

উইন রবিনসন বলেন, তাতমাদোর কাছে সবাই একজন সম্ভাব্য বিদ্রোহী। ‘‘তারা বিক্ষোভকারীদের এক একজন বিশ্বাসঘাতক বলে মনে করে।”

লম্বা সময় ধরে দায়িত্ব পালন করা এবং সমাজের বাকি অংশ থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ার কারণে সেনাদের মধ্যে এ ধরনের মত গড়ে উঠে।

কেউ কেউ সুরক্ষিত কম্পাউন্ডের মধ্যেই বেড়ে উঠেছে। যেখানে তার এবং তার পরিবারের উপর কড়া নজর রাখা হয়েছে, তাদের মাথায় সবসময় সেনাবাহিনী নিয়ে ইতিবাচক কথা ঢোকানো হয়।

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, যার ফলে সেনাসদস্যদের নিজেদের মধ্যে একটি এক পরিবারের অনুভূতি তৈরি হয়। তারা নিজেদের মধ্যে সন্তানদের বিয়ে দেয়।

রবিনসন বলেন, সেনাবাহিনী একটি ধর্মীয় বিশ্বাসের মতো। বাইরের সঙ্গে তাদের খুব বেশি যোগাযোগ নেই। সিডিএম- এ যোগ দেওয়া একজন সেনাও বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই সেনাসদস্য বলেন, ‘‘এই সেনারা দীর্ঘদিন ধরে বাহিনীতে থাকে। যে কারণে তারা শুধু আর্মির ভাষা চেনে। তারা জানেও না সেনাবাহিনীর বাইরের জগতে কি হচ্ছে।”

রাষ্ট্রের ভেতর আরেক রাষ্ট্র

তাতমাদোর বেশিরভাগ চিন্তা-ভাবনা এখনও রহস্যময়। ২০২০ সাল পর্যন্ত মিয়ানমারে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পালন করা স্কট মারসিয়েল বলেন, ‘‘এটা আসেল রাষ্ট্রের ভেতর আলাদা একটি রাষ্ট্র। সমাজের অন্যদের সঙ্গে তাদের যোগাযোগ বেশি নেই। তারা একটি ব্যবস্থা তৈরি করেছে, যেখানে তারা একে অপরকে নিজেরা কত গুরুত্বপূর্ণ তা শিক্ষা দেয়। তারা শেখায় তারাই দেশকে ঐক্যবদ্ধ রাখতে পারে, তাদের ক্ষমতা ছাড়া দেশ ভেঙে পড়বে।’’

Myanmar-coup-00
সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে বিশ্বে প্রবল জনমত তৈরি হলেও সেনাবাহিনীর তা নিয়ে মোটেও ভাবনা নেই। ছবি: সংগৃহীত

জান্তা প্রধান জেনারেল মিন অং হ্লাইংয়ের নির্দেশে কাজ করে সেনাবাহিনী। তবে বিশ্লেষকরা তাকেই সব সমস্যার শেকড় হিসেবে মানতে রাজি নন। মারসিয়েল বলেন, ‘‘আমার মতে এটি একটি প্রতিষ্ঠান এবং প্রতিষ্ঠানটির সংস্কৃতিই মূল সমস্যা। জান্তা প্রধান এই প্রতিষ্ঠানের তৈরি।”

মিয়ানমারে সেনাবাহিনী এবং সেনাপ্রধান বরাবরই সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। কিন্তু অতীতের সব সময়কে ছাপিয়ে বর্তমানে তাতমাদো যেভাবে চলছে তাতে মনে হচ্ছে, তারা নিজেরা নিজেদের ছায়ার সঙ্গে খেলছে। একটি সশস্ত্র বাহিনী যারা গোপনীয়, সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর এবং শুধু নিজেদের কাছেই দায়বদ্ধ।

মারসিয়েল বলেন, ‘‘অথবা শেষ কথা হিসেবে বলতে পারি..আমার মনে হয় না বিশ্ব তাদের সম্পর্কে কি ভাবছে সেটা নিয়ে তাদের কোনও মাথাব্যাথা আছে।”

Link copied!