রাষ্ট্রদ্রোহ আইনে সব মামলার বিচার, আপিল ও বিচার কার্যক্রম স্থগিত রাখার নির্দেশ দিয়েছেন ভারতের সুপ্রিম কোর্ট। ভারতীয় দণ্ডবিধির ১২৪-এ (রাষ্ট্রদ্রোহ) ধারায় নতুন কোনো মামলা নিবন্ধিত হলে সংশ্লিষ্টরা আদালতের কাছে রেহাই চাইতে পারবেন।
বুধবার ভারতের প্রধান বিচারপতি এন ভি রামানার নেতৃত্বে সুপ্রিম কোর্টের তিন সদস্যের বেঞ্চ এ রায় দিয়েছেন।
বুধবার এ সংক্রান্ত শুনানি চলাকালে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার প্রথমে ঔপনিবেশিক আমলের আইনটির পক্ষে অবস্থান নেয়। পরে সরকারের পক্ষে সলিসিটর জেনারেল তুষার মেহতা আদালতকে জানান, রাষ্ট্রদ্রোহ আইন পুনর্বিবেচনা করা হচ্ছে। আদালত তখন এ আইনের ধারাগুলো পুনর্বিবেচনা ও পুনঃপরীক্ষা সম্পন্ন হওয়া পর্যন্ত এর আওতায় বিদ্যমান সব মামলার বিচার, আপিল ও প্রসিডিংসে স্থগিতাবস্থা বজায় রাখতে ভারতের কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারগুলোকে নির্দেশ দেয়।
মার্কিন গণমাধ্যম সিএনএন বলেছে, বাক স্বাধীনতা ও বিরোধী মত দমনে রাষ্ট্রদ্রোহ আইনের অপব্যবহারের অভিযোগ রয়েছে ভারত সরকারের বিরুদ্ধে। ২০১৪ সালে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও তার দল বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর থেকে রাষ্ট্রদ্রোহ আইনের প্রয়োগ বেড়েছে। মানবাধিকার কর্মী, সাংবাদিক ও সরকার বিরোধীদের মুখ বন্ধ করতে বিজেপি এ আইনটি ব্যবহার করছে।
প্রধান বিচারপতি এন ভি রামানা, বিচারপতি সূর্যকান্ত ও বিচারপতি হিমা কোহলিকে নিয়ে গঠিত সুপ্রিম কোর্ট বেঞ্চের এ রায় আপাতঃদৃষ্টিতে ভারত সরকারকে তিরস্কারের শামিল বলে মন্তব্য করেছে সিএনএন।
আদালতের রায়ের পর পিটিশনারদের আইনজীবী রেশমি সিং এক প্রশ্নের জবাবে জানান, বর্তমানে যারা কেবলমাত্র রাষ্ট্রদ্রোহ আইনের মামলায় কারাগারে রয়েছেন, তারা জামিনের আবেদন করতে পারবেন।
রাষ্ট্রদ্রোহ আইনে কতজন আটক?
সুপ্রিম কোর্টে আবেদনকারীদের পক্ষে দাঁড়িয়েছেন আইনজীবী কপিল সিবাল। তিনি শুনানির সময় বলেছেন, সারা দেশে ৮০০টি রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা করা হয়েছে। তার জেরে ১৩ হাজার মানুষকে জেলে আছেন।
ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরোর তথ্য উদ্ধৃত করে ইকনমিক টাইমসের রিপোর্ট জানাচ্ছে, ২০১৬-র তুলনায় ২০১৯ সালে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে মামলার সংখ্যা ১৬০ শতাংশ বেড়েছে। ২০১৯ সালে ৯৬ জনকে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল, তার মধ্যে মাত্র দুইজনের শাস্তি হয়েছে। গ্রেপ্তার করা ৯৬ জনের মধ্যে ৫৫ জনের বয়স ১৮ থেকে ৩০-এর মধ্যে। ওই বছর কর্ণাটকে সবচেয়ে বেশি মানুষকে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়। তালিকায় এর পরেই আছে আসাম, জম্মু ও কাশ্মীর এবং উত্তরপ্রদেশ।
আইন কী বলছে
ব্রিটিশ ভারতে ১৮৬২ সালে দণ্ডবিধি চালু হয়। তখন সেখানে রাষ্ট্রদ্রোহ নিয়ে কোনো সেকশন ছিল না। ১৮৭০ সালে ধারাটি যুক্ত হয়। বালগঙ্গাধর তিলককে প্রথম এই ধারা অনুসারে গ্রেপ্তার করা হয়। পরে মহত্মা গান্ধীকেও ইয়ং ইন্ডিয়ার লেখার জন্য রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল।
এই আইনে বিনা ওয়ারেন্টে কাউকে গ্রেপ্তার করা যায় এবং তাকে জেলে পাঠানো যায়। ১৯৬২ সালে কেদারনাথ মামলায় সুপ্রিম কোর্ট এই আইনকে সাংবিধানিক ঘোষণা করেও জানায়, সরকারের সমালোচনা করা হলে, তাকে কোনোভাবেই দেশদ্রোহ বলা যাবে না। সুপ্রিম কোর্ট গতবছর প্রশ্ন তোলে, স্বাধীনতার ৭৫ বছর পরেও কি এই আইনের প্রয়োজন আছে? তারা জানায়, সরকার পুরনো প্রচুর আইনকে বাতিল করেছে। তাহলে এই আইনের পর্যালোচনা কেন করা হবে না?
নরেন্দ্র মোদী সরকার ক্ষমতায় আসার পর দেশদ্রোহের অভিযোগে গ্রেপ্তার ও মামলার সংখ্যা ভয়ংকরভাবে বেড়ে গেছে বলে কংগ্রেস সহ বিরোধীদের অভিযোগ।
সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ
কেন্দ্রীয় সরকারের আবেদন ছিল, রাষ্ট্রদ্রোহের যে মামলা চলছে, সেগুলিকে থামিয়ে দেয়া উচিত হবে না। কারণ, এর সঙ্গে সন্ত্রাসবাদ, টাকা নয়ছয় ও অর্থ বিদেশে পাঠানোর ঘটনা জড়িত থাকতে পারে। এগুলি নিয়ে সংশ্লিষ্ট আদালতই সিদ্ধান্ত নিক। বিচারবিভাগকে ভরসা করা উচিত।
কিন্তু সরকারের আবেদন খারিজ করে দিয়েছে সর্বোচ্চ আদালত। তিন বিচারপতির বেঞ্চ জানিয়েছে, যতদিন সরকার বিষয়টি বিবেচনা করবে, আইন পর্যালোচনা করবে, ততদিন এই আইন প্রয়োগ করে কোনো নতুন করে মামলা হবে না। বিচারপতিরা জানিয়েছেন, কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের উপর তাদের ভরসা আছে যে, তারা নতুন করে এই আইন প্রয়োগ করবেন না। যদি কারো বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের কারণে এফআইআর হয়, তিনি সুপ্রিম কোর্টে আবেদন জানাতে পারবেন। আর এখন দেশদ্রোহের অভিযোগে করা সব মামলার বিচার বন্ধ থাকবে। সুপ্রিম কোর্ট যতদিন কোনো সিদ্ধান্ত না নেয়, ততদি্ন পর্যন্ত মামলাগুলি নিয়ে আর এগোনো যাবে না। যাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে, তারা জামিনের আবেদন জানাতে পারবেন।
সূত্র: আনন্দবাজার, সংবাদ প্রতিদিন, হিন্দুস্থান টাইমস