কূটনৈতিক তৎপরতায় উল্টো দূরত্ব বেড়েছে বিএনপির

অরিন সুলতানা

সেপ্টেম্বর ২০, ২০২৩, ১১:৫৩ পিএম

কূটনৈতিক তৎপরতায় উল্টো দূরত্ব বেড়েছে বিএনপির

ছবি: বিএনপি মিডিয়া সেল

নির্বাচনের আগে বিএনপির কূটনৈতিক তৎপরতায় অনেকটাই ভাটা পড়েছে। যেসব প্রভাবশালী দেশগুলোর সাথে দূরত্ব ছিল সেগুলোর উন্নতি করতে পারেনি বরং নতুন করে জার্মানি ও জাপানের সাথে সম্পর্কের অবনতি ঘটেছে। যার ফলে কূটনৈতিক তৎপরতায় অনেকটা বিকল্প খুঁজছে দলটি। বিএনপির আন্তর্জাতিক সম্পর্ক কমিটি সক্রিয় না হওয়ার পাশাপাশি কোন সাবেক কূটনৈতিক এই কমিটিতে না থাকায় এখন বিপাকে পড়েছে দলটি।

আসন্ন  নির্বাচন সামনে রেখে বড় আন্দোলন গড়ে তোলার পাশাপাশি কূটনৈতিক তৎপরতা জোরদার করার চেষ্টায় রয়েছে বিএনপি। দীর্ঘদিন ধরে ক্ষমতার বাইরে থাকা দলটি নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন করতে চায়। এই দাবি আদায়ে আন্দোলনের পাশাপাশি বিদেশি বন্ধুরাষ্ট্রের সহায়তা প্রয়োজন বলে মনে করছে বিএনপির হাইকমান্ড।  তবে কূটনৈতিক তৎপরতায় পিছিয়েছে বিএনপি।

আন্তর্জাতিক সম্পর্ক কমিটির নিষ্ক্রিয়তা

বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীসহ কয়েকজন সিনিয়র নেতা এবং আরও কয়েকজন জাতীয়তাবাদী বুদ্ধিজীবী এ তৎপরতায় সক্রিয় রয়েছেন। তারা ঢাকায় কর্মরত বিদেশি কূটনৈতিকদের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রাখছেন। এ ছাড়া দলের ভারপাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানও বিভিন্ন মাধ্যমে কূটনৈতিক তৎপরতা জোরদার করতে সচেষ্ট রয়েছেন। কিন্তু বৈদেশিক সম্পর্ক নিয়ে যতই আলোচনা বাড়ছে ততই চাপে পড়ছে বিএনপির আন্তর্জাতিক সম্পর্ক কমিটি। 

এই কমিটির সদস্যসংখ্যা ২১ ছিল। তবে বর্তমানে সক্রিয় দেখা যায় তিনজনকে। কমিটির চেয়ারম্যান ও বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, সাংগঠনিক সম্পাদক শামা ওবায়েদ এবং দলের মানবাধিকার সম্পাদক আসাদুজ্জামান শুধু সক্রিয়। দলের পক্ষে সব সময় মুখর রুমিন ফারহানা এই কমিটির সদস্য হলেও কমিটিতে তিনি সক্রিয় নন। একই অবস্থা রিয়াজ রহমান, এনামুল হক চৌধুরী, আসাদুজ্জামান রিপন, জেবা খান, নওশাদ জমির, ফাহিমা মুন্নি, অনিন্দ্য ইসলাম অমিত, তাবিথ আউয়াল, মীর হেলাল উদ্দিন, ইশরাক হোসেনেরও।

এর কারণ হিসেবে এই কমিটিতে নিষ্ক্রিয় এক নেতা জানায়, গঠনের পর থেকে গত সাড়ে চার বছরে কমিটির একটি মাত্র আনুষ্ঠানিক বৈঠক হয়েছে। অবহিতকরণ সভা হয়েছে কয়েকটি। ফলে সদস্যরা কমিটির কাজে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন।

তবে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী দ্য রিপোর্টকে বলেন, এটা সঠিক নয়। সারা বিশ্বের প্রতিনিধি বাংলাদেশে আসছে মূলত এই নির্বাচনকে কেন্দ্র করেই। তারা বিনা কারণে দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশে তো যাচ্ছে না। তারা জানতে চায়, কী হচ্ছে বাংলাদেশে। আমরা জানাতে চাই, নির্বাচনকে সামনে রেখে বাংলাদেশ যে পথে চলছে, ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচন আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়। সেই প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেছে বিচার বিভাগকে ব্যবহার করা, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে ব্যবহার করা, সরকারি কর্মকর্তাদের ব্যবহার করা প্রতিনিয়ত হচ্ছে।

কূটনীতিকরা আসছে না বিএনপির কর্মসূচিতে

গত ৩ সেপ্টেম্বরে ‘রোহিঙ্গা সংকট’ নিয়ে একটি সেমিনার আয়োজন করেছিল বিএনপি। কিন্তু সেখানে বেশ কিছু কূটনীতিক উপস্থিত থাকলেও কোন দেশের রাষ্ট্রদূত উপস্থিত ছিল না। ঘুরে ফিরে এই সব কূটনীতিকরাই উপস্থিত থাকছে বিএনপির অনুষ্ঠানে। 

গত ২৯ জুলাই বিএনপির অবস্থান কর্মসূচিতে বাধা ও হামলার ঘটনায় ২ আগস্ট কূটনীতিকদের ব্রিফ করে দলের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ক কমিটি। অনুষ্ঠানে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ স্থায়ী কমিটির ছয়জন সদস্য উপস্থিত ছিলেন। ওই দিন বিএনপি থেকে জানানো হয়েছিল, ২৫টি দেশের কূটনীতিক উপস্থিত ছিলেন। কিন্তু বৈঠক সূত্র জানিয়েছে, ঢাকায় নিযুক্ত মাত্র ৯টি দেশের প্রতিনিধি ওই ব্রিফিংয়ে উপস্থিত ছিলেন। এর মধ্যে সবাই কূটনীতিকও ছিলেন না।

গত ১৪ আগস্ট বিএনপির একটি সেমিনারে আমন্ত্রিত কূটনীতিকদের মধ্যে মাত্র চারটি দেশের প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন। দলীয় সূত্রগুলো জানায়, এই দুটি অনুষ্ঠানের বিষয় নিয়ে দলের জ্যেষ্ঠ নেতারা মনঃক্ষুণ্ন হয়েছেন। ২ আগস্টের কূটনীতিকদের ব্রিফিংকে বিএনপি অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়েছিল। এ জন্য দলের স্থায়ী কমিটির ছয়জন সদস্য উপস্থিত ছিলেন। কিন্তু সেই বিবেচনায় কূটনীতিকদের উপস্থিতি ছিল হতাশাজনক। 

জার্মানি  ও জাপানের সাথে নতুন দূরত্ব

গত বছরের ১৭ মার্চ জার্মান রাষ্ট্রদূত আখিম ট্র্যোস্টারের সাথে বৈঠক করে বিএনপি। ওই বৈঠকের পর স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী সাংবাদিকদের ব্রিফ করেন। কিন্তু বিএনপির পক্ষ থেকে গণমাধ্যমে দেওয়া বক্তব্যের সাথে দ্বিমত পোষণ করে অসন্তোষ জানান রাষ্ট্রদূত।

ওই বছরের ২০ এপ্রিল জাতীয় প্রেস ক্লাবে এক অনুষ্ঠানে জার্মান রাষ্ট্রদূত বিএনপির বক্তব্যে অসন্তোষের কথা বলে উল্লেখ করেন তিনি। বিএনপির সংশ্লিষ্ট নেতারা জানান, এর পর থেকে ঢাকার জার্মান দূতাবাস বিএনপির কোনো অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের ব্যাপারে খুব বেশি আগ্রহ দেখায় না।

গত ৪ জুন জাপান রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে বিএনপির বৈঠকের পর আমীর খসরু মাহমুদ সাংবাদিকদের বলেন, বিএনপির সময় জাপান থেকে প্রচুর বিনিয়োগ এসেছিল। প্রচুর অবকাঠামোগত বিনিয়োগ বাংলাদেশে হয়েছে। তারা দেখতে চায় সরকার বদল হলেও যাতে এটা অব্যাহত থাকে।

বিএনপি সূত্র জানায়, সরকার বদল হলেও সম্পর্ক অব্যাহত রাখতে চায় জাপান— আমীর খসরুর এ বক্তব্যে জাপান বেশ নাখোশ হয়। বৈঠকে সরকার বদলের বিষয়ে জাপান কোনো মন্তব্য করেনি বলে বিভিন্ন মাধ্যমে বিএনপিকে জানিয়েছে তারা।

কূটনৈতিকদের জানিয়ে বিএনপির কোন সুবিধা হচ্ছে কিনা জানতে চাইলে আমীর খসরু বলেন, নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন না হলে সুষ্ঠু নির্বাচন হবে না। এই আলোচনা এখন সব জয়গায় চলছে। আলোচনায় এগুলো উঠে এসেছে, বর্তমান প্রেক্ষাপটটা যদি ব্যাখ্যা করি, কত মানুষের মৃত্যু, কতজন আহত-গ্রেফতার, কত মামলা, ডিসি পোস্টিং হচ্ছে, পুলিশ অফিসার পোস্টিং হচ্ছে, টিএনও পোস্টিং হচ্ছে। কূটনৈতিক তৎপরতায় আমরা এগুলো জানানোর চেষ্টা করছি।

দেশে সফররত প্রতিনিধিদের পাচ্ছে না বিএনপি

সম্প্রতি ঢাকা সফরে আসা মার্কিন দুই কংগ্রেসম্যানের সাথে শেষ মুহূর্তে বৈঠক করতে চেয়েছিল বিএনপি। কিন্তু তাতে সাড়া মেলেনি। তবে রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে এক টেবিলে বৈঠকের আমন্ত্রণ পেয়ে বিএনপির প্রচার সম্পাদক শহীদ উদ্দীন চৌধুরী এ্যানি তাতে অংশ নেন। 

এর কয়েক দিন আগে ইন্টারন্যাশনাল রিপাবলিকান ইনস্টিটিউটের (আইআরআই) শীর্ষ কর্মকর্তার ঢাকা সফরের সময় বিএনপির আন্তর্জাতিক সম্পর্ক কমিটি বৈঠক করার আগ্রহ প্রকাশ করে। কিন্তু তেমন কোনো বৈঠক হয়নি। তবে বিএনপির দুজন নেতার সাথে ব্যক্তিগত পর্যায়ে ওই কর্মকর্তার কথা হয়।

বিএনপি নেতাদের অভিযোগ, আইআরআই সম্প্রতি বাংলাদেশের বিষয়ে যে জরিপ প্রতিবেদন দিয়েছে (৭০ শতাংশ মানুষ মনে করে, শেখ হাসিনা ভালো কাজ করেছেন), তা আগে থেকেই বিএনপির আন্তর্জাতিক বিষয়ক কমিটি জানত। প্রতিবেদনটি পেয়েও কমিটির দায়িত্বপ্রাপ্তরা এ নিয়ে দলের ভেতরে কারো সাথে কোনো আলোচনা করেননি। ফলে দল হিসেবে বিএনপি আইআরআইয়ের প্রতিবেদনের বিষয়ে যে প্রতিক্রিয়া দিয়েছিল, তা ছিল কিছুটা দুর্বল।

এদিকে রাশিয়ান পররাষ্ট্রমন্ত্রী কিংবা ফ্রান্সের রাষ্ট্রপতি কারও সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টাও করা হয়নি বিএনপির পক্ষ থেকে। তবে বিএনপি সঠিক পথেই আছেন উল্লেখ করে দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, বিদেশিরা কৌশলগত কারণেই বিশেষ কোনো দলের সাথে সরাসরি সম্পর্ক দেখায় না। আমরা বহির্বিশ্ব বাংলাদেশের গণতন্ত্র ও মানবাধিকার নিয়ে কথা বলছে। আগামী নির্বাচন সুষ্ঠু ও অবাধ করতে নানা সুপারিশ করছি। সেগুলো বিবেচনা করবে বলেও আশ্বাস দেয়া হয়।

Link copied!