নগর সভ্যতার উন্নয়নে উজাড় হচ্ছে বন। গাছ কেটে ফেলায় পাখিদের আশ্রয়স্থল কমে যাচ্ছে। আর এই আশ্রয়হারা পাখিদের ঘর ফিরিয়ে দিতে মরিয়া হয়ে কাজ করে চলেছেন তিনি। এ পর্যন্ত প্রায় আড়াই লাখ পাখির বাসা বানিয়ে নজির সৃষ্টি করেছেন। বিশ্ববাসীর কাছে পরিচিতি পেয়েছেন ‘নেস্ট ম্যান’ হিসেবে । রাকেশ ক্ষত্রী নামে এই পাখিপ্রেমিক ভারতের দিল্লির বাসিন্দা, পেশায় একজন আলোকচিত্র শিল্পী।
ভারতীয় বার্তা সংস্থা এএনআইকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে রাকেশ ক্ষত্রী বলেন, “আমি ছোট থেকেই পাখিদের মধ্যে বড় হয়েছি। তখন থেকেই আমি অবুঝ এই প্রাণীগুলোর জন্য বাসা বানানোর কাজ শুরু করি। এখন পর্যন্ত আমি আড়াই লাখের বেশি বাসা তৈরি করেছি। একই সঙ্গে পাখির বাসা তৈরিতে আগ্রহী এমন এক লাখের বেশি ছেলে মেয়েদের এ বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিয়েছি।”
প্রথম দিকে রাকেশকে নিয়ে লোকজন হাসাহাসি করতো
পাখির বাসা বানানোর প্রথম দিকের কথা মনে করে তিনি বলেন, “প্রথম দিকে লোকজন এ বিষয়টি নিয়ে খুবই হাসাহাসি করতো। তারা আমাকে ঠাট্টা করে বলতো আমার তৈরি বাসাগুলোতে কিভাবে পাখিগুলো বসাবাস করতে পারবে! কিন্তু যখন থেকে পাখি ওই ঘরগুলোতে প্রবেশ করতে শুরু করলো তখন তারা (পাখি) আমার তৈরি ওই ঘরগুলোতেই থাকতে বেশি পছন্দ করলো।”
কেন পাখির বাসা তৈরির পরিকল্পনা?
পাখির বাসা নিয়ে রাকেশের ভাবনা চিন্তা শুরু হয় হঠাৎ করেই। একদিন অফিস যাওয়ার পথে কয়েকজন শ্রমিককে পাখির বাসা ভাঙতে দেখেছিলেন তিনি। সেই ঘটনা তার মনে গভীরভাবে প্রভাব ফেলে। দিল্লির অশোক বিহারের বাড়ি থেকে কাজের জায়গায় যাওয়ার পথে নিয়মিত একটি পুরনো বাড়িতে প্রচুর পাখির বাসা দেখতেন তিনি। সেই বাসাই ভাঙা হচ্ছিল। কাজে যাওয়ার বদলে সেদিন ওই বাড়ির মালিকের কাছে চলে যান তিনি। তাকে বলেন, পাখিদের বাসা-ছাড়া করলে তিনি এ নিয়ে আদালতে যাবেন।
এর পরেই শহরে পাখিদের কমতে থাকা বাসস্থান নিয়ে ভাবতে শুরু করেন রাকেশ। তার মনে অনেক প্রশ্ন জেড়ে ওঠে। পাখিদের যদি ওদের যদি বাসা বানিয়ে দেওয়া হয়, তবে কি ওরা সেখানে থাকবে? প্রথমে ডাবের খোলায় কাগজ ভরে আর চট বেঁধে বাসা তৈরি করে ঝুলিয়েছিলেন। কিন্তু সেই বাসায় পাখি আসেনি। পরে অন্য পদ্ধতিতে বাসা তৈরি করা শুরু করেন। বেতের গোল কাঠামো তৈরি করে তাতে খড় আর চটের আস্তরণ দিয়ে বাসা বানান। এই বাসায় পাখি আসতে থাকে।
রাকেশ হয়ে ওঠেন 'নীড় মানব’
পাখিদের আশ্রয় দিতে পেরে উৎসাহিত রাকেশ ঠিক করেন, তিনি নিজে থেকে যা শিখলেন, তা ছড়িয়ে দেবেন। এই চিন্তা নিয়েই স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীদের পাখির বাসা বানানো শেখাতে শুরু করেন রাকেশ। এরপর একে একে ডাক আসতে থাকে। কর্পোরেট সংস্থাগুলো বাসা বানানোর প্রশিক্ষণ দিতে ডাকতে শুরু করে। বিভিন্ন আবাসনের আবাসিক কল্যাণ সমিতিগুলোও রাকেশকে ডেকে পাঠাতে শুরু করে পাখির বাসা বানানো প্রশিক্ষণের জন্য। পেশাদার ফোটোগ্রাফার রাকেশ হয়ে ওঠেন 'নীড় মানব”।
পাখির আবাসস্থল কিভাবে বানাতে হয় সে বিষয়ে এখন সবাইকে নানাভাবে পরামর্শ দিচ্ছেন রাকেশ ক্ষত্রী। এক লাখের বেশি মানুষ তার কাছ থেকে ইতোমধ্যে পাখির বাসা বানানো শিখেছে।
বিভিন্ন পুরষ্কার ও সম্মামনা
পাখিদের জন্য বাসা বানানোর কারণে রাকেশ ক্ষত্রী বিভিন্ন পুরস্কারেও ভূষিত হয়েছেন। গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে রাকেশের নাম উঠেছে। লিমকা বুক অফ রেকর্ডসেও তার কাজের ভূয়সী প্রশংসা করা হয়েছে। সম্প্রতি আন্তর্জাতিক প্রকাশনা সংস্থা ম্যাকমিলান তাদের প্রকাশিত একটি বইয়ে গোটা একখানি অধ্যায়ই লিখেছে রাকেশ এবং তার কাজ নিয়ে।
রাকেশ ক্ষত্রী বলেন, লিমকা বুকে তার কিছু রেকর্ড নথিভুক্ত করা হয়েছে। যার মধ্যে রয়েছে হাতে তৈরি পাখির বাসা এবং এ বিষয়ে বিভিন্ন কর্মশালায় অংশগ্রহণের মতো বিষয়গুলো। ২০১৯ সালে যুক্তরাজ্যের হাউজ অব কমন্স থেকে তাকে গ্রিন অ্যাপেল অ্যাওয়ার্ড দেওয়া হয়। এছাড়া পাখির সুরক্ষা ও বিভিন্নমুখী উদ্যোগ বিষয়ক পুরস্কার পেয়েছেন তিনি।
বর্তমানে রাকেশ ক্ষত্রী পাখির বাসা তৈরির প্রক্রিয়ায় ভিন্নতা এনেছেন। তার মধ্যে সবচেয়ে পরিবেশ বান্ধব বাসাটি হল ফলের রসের ফেলে দেওয়া টেট্রা প্যাক থেকে তৈরি পাখির বাসা। এতে পরিবেশ দূষণও কমানো যাবে বলে মনে করেন তিনি।