ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলার জয়নুল আর্ট গ্যালারি গেইট সংলগ্ন মাধবীলতা গাছ শাখা প্রশাখা বিছিয়ে রেখেছে পাশের বাউন্ডারির দেয়ালটায়। সেখানটায় সকাল সন্ধ্যায় পাখিদের কিচিরমিচির আর কাঠবিড়ালীদের দৌড়-ঝাঁপ। কোনো ক্লান্ত পথিক নীরব মনে সেখানে একটু দাঁড়ালে তার ভেতর হয়তো কবি সত্তা জেগে উঠবে; অথচ পথিক কিছুক্ষণ পর মধ্যাহ্নে লক্ষ্য করবেন মাধবীলতার শাখা-প্রশাখা ভীড় ঠেলে পাখিদের কিচিরমিচিরের শব্দ যেন বেড়ে গেল। তারা যেন কিছুর জন্য অপেক্ষা করছে। শব্দ বেড়ে গেছে অপেক্ষার বাঁধ ভেঙে যাচ্ছে তাই। বাদুড়গুলোর তেমনই অপেক্ষা। বেলা বারোটায় তাদের খাবার দেওয়ার কথা। কেউ একজন দেয়। নিয়মিতই দেয়। শুধু তাদেরই যে দেয় এমন না। তারা অনেকবার লক্ষ্য করেছে পাশের রাস্তার গর্ত থেকে কয়েকটি ইঁদুরও বের হয়ে আসে উনার ‘আয় আয়’ বললে। তারাও তাই ‘আয় আয়’ শব্দেরই প্রতীক্ষায় থাকে। কিন্তু যেই লোকটার ‘আয় আয়’ শব্দের জন্য তাদের এত প্রতীক্ষা, তাঁর সাথে তাদের পরিচয় বেশ কিছুদিনের। প্রায় দুই বছর হলো। অথচ তারা কি জানে তিনি সম্পর্কে?
“খালি কইবেন চারুকলার সেন্টু ভাই। এইখানকার সবাই আমারে চিনে। পুঁথি মালার দোকান দেই। এইখানে বসি বারো বছর ধইরা সৎ ব্যবসা করি, সৎ ভাবে চলি। আর এই পাখি, কাঠবিড়ালী, ইদুরগুলারে খাবার দেই। আমিও খাই, ওরাও খায়। ওরাও আমাদের মতো প্রাণী, ওদের খাবার দেই নিজেরও শান্তি লাগে। ওরাও সবাই এখন আমারে চিনে। খাবার দিতে একটু দেরি হইলেই কেমন চিৎকার চেঁচামেচি শুরু কইরা দেয়, দেখলেন তো!”
তিনি বললেন, দাঁড়ান আপনারে দেখাই। বলে দুইটা পরোটা ছোট ছোট করে ছিঁড়লেন। তারপর দেয়ালটার উপরে কিছু ছিটিয়ে দিলেন। অপেক্ষারত পাখি আর কাঠবিড়ালীগুলো মাধবীলতার শাখা প্রশাখার আড়াল থেকে মুহুর্তে বের হয়ে এলো। যেন এতক্ষণ রবীন্দ্রনাথের ‘প্রতীক্ষা’ কবিতার শেষ দুটি লাইনই তারা বারবার ভাবছিল মনে,
“বসে আছি শয়ন পাতি ভূমে-
তোমার এবার সময় হবে কবে।”
সময় হয়েছে। কখনো ঠিক সময়ে, কখনো সময়ের একটু আগে অথবা পরে এভাবেই চারুকলার কামাল উদ্দিন সেন্টু মামা তাদের প্রতীক্ষা ভাঙান। অথচ তিনি বলেন, জীবনের অনেক প্রতীক্ষায় আজ অপ্রাপ্তির। যেমন জীবন চেয়েছিলাম, যা স্বপ্ন আমরা দেখি তা তো পাই না। তবুও তো জীবনে বাঁচতে হবে।
কিন্তু তার সেসব স্বপ্ন আর জীবনের কথা জানতে চাইলে তিনি বলতে রাজি হননি। বলেন, সেসব এক করুণ ইতিহাস। নিজের ইতিহাসের কথা বলতে চান না বলে প্রসঙ্গ পাল্টে আবার ইঁদুর-পাখি-কাঠবিড়ালীদের নিয়ে কথা বলতে হলো। ওদের নিয়ে কথা বলতেই যেন তাঁর বেশি স্বাচ্ছন্দ্য।
ওদের খাবার দিতে কেমন লাগে জিজ্ঞাসায় পশু-পাখিপ্রেমী সেন্টু মামার উত্তর সাবলীল, ভালো লাগে | আনন্দ পাই। আমার আরও টাকা পয়সা হইলে এগুলো নিয়াই থাকতাম, আরও বেশি বেশি খাবার দিতাম। তারপর তিনি মানুষ ও ওদের সুখের তুলনামূলক ব্যাখ্যা দাঁড় করান।
বলেন, “একটা জিনিস জানেন, পাখির একটা জীবন, আমাদেরও একটা জীবন। আমরা ভরপুর খাই, পরিপূর্ণ বাঁচি তারপরও আমাদের সুখ নাই। অনেক সুখের পরও আমরা সুখ খুঁজি। কিন্তু অল্পতেই ওদের কত সুখ! ওদের সুখ দেখে আমার ভালো লাগে। মানুষের যেমন হানাহানি, হিংসা, বিদ্বেষ অথচ ওরা এসবে নেই। যখন ইচ্ছে উড়ে যায়।”
তিনি আবার ফিরে আসেন তার ছেলেবেলার কথায়। বলেন পড়াশোনা করতে চেয়েছিলেন। মা ষষ্ঠ- সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত পড়িয়েছেন। সংসারে অভাব অনটন। একবেলা খাবার পেলে আরেকবেলা নেই। পেটে ক্ষুধা। ক্ষুধা নিয়ে কি আর পড়াশোনা হয়! সেই থেকেই তো ঢাকার হাজারীবাগ ট্যানারীতে কাজ শুরু। চামড়ার কাজ। ভারী বোঝা টানা। কিন্তু বয়স যত এই কাজের জন্য তা যথেষ্ট নয়। কাজের কষ্ট শরীরে সহ্য হয় না। তবুও করতে হবে। শরীর না চললেও সংসারের দায়িত্ব এড়াতে পারেননি। এভাবে দশ-বারো বছর যেন কিভাবে কেটে গেলো! চাকরি পারমানেন্ট হলে সেলারি পঁয়ত্রিশ হাজার হয়। তখন চাইলেন নিজের একটা দোকান দিতে।
আব্দুল আজিজ খান লেনে আমি একটা দোকান নিলাম। খেলনার দোকান | কিন্তু লস খেলাম। পরে জায়গায় জায়গায় আরও অন্যান্য ব্যবসায়ও করি। লাইটারে গ্যাস ভরি রাস্তায় রাস্তায়। তারপরে চাবি রিং ও বেচি কিছুদিন। নীলক্ষেতে খেলনাও বিক্রি করসি। কিছুদিন সাইন্সল্যাবের ঐখানে টুকিটাকি জিনিস নিয়াও বসছি। ফার্মগেট- গুলিস্তানে পায়ের ঘুঙুর নিজে বানায়াও বিক্রি করসি। শেষমেশ এখানে আসি। এখানে আছি দশ বারো বছর। এখন মোটামুটি কোনোভাবে খেয়ে পড়ে বেঁচে আছি।”
চারুকলার গেইটের সামনে কামাল উদ্দিন সেন্টু মূলত পুঁতি মালা, ব্রেসলেট, টিপের খোলা দোকান নিয়ে বসেন। বস্তায় করে এগুলো নিয়ে আসেন। আবার বস্তায় করে নিয়ে যান। তার গ্রামের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগরে। নিজের পড়াশোনার স্বপ্ন পূরণ না হলেও বড় মেয়েকে বিয়ে দিয়ে ছোট ছেলেকে পড়াশোনা করাচ্ছেন। ছোট ছেলে ধানমন্ডির ডক্টর মালিকা কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে সম্মান দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী। শিখিয়েন কম্পিউটারের কাজও। ভালো কিছু করবে, ভালো মানুষ হবে- ছেলেকে নিয়ে এই স্বপ্ন।
সেন্টু মামার পাশে কিছুক্ষণ দাঁড়ালে দেখা যাবে বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা আশেপাশের কত পরিচিত ক্রেতা তাঁর। সবাই কেমন আছেন এসে জিজ্ঞেস করে। অনেকে গল্প জুড়ে দেয়। চারুকলার অসংখ্য শিক্ষার্থীদের সাথে তার সম্পর্ক যেন নিজের পরিবারের মতো। এমনি পুঁথি মালা কিনতে এসেছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলারই এক শিক্ষার্থী।
তিনি তাঁর অনুভূতি ব্যক্ত করে বলেন, মামাকে অনেকদিন থেকে দেখছি। খুবই ভালো মানুষ। তবে তার যে কাজটি বেশি ভালো লাগে তা হলো তিনি ইঁদুর-পাখি-কাঠবিড়ালী এদের খাবার দেন। এটি আমার অনেক ভালো লাগে। মাঝে মাঝে ছবি তুলে নিয়েও যাই। আমাদের কাছে মনে হতে পারে, এটি এমন আর বিশাল কি কাজ। কিন্তু আমরা সবাই যদি এমন ছোট ছোট ভালো কাজও করি তাহলেই কিন্তু আমাদের পৃথিবীটা আরও সুন্দর হতো।
এমন ছোট ভালো কাজগুলো সেন্টু মামা সারাজীবনই করে যেতে চান। জীবন দুঃখময়, অনেক স্বপ্ন আশাও পূরণ হবার নয়। তার ভাষ্য পশু প্রাণীদের খাবার দিতে তিনি কখনো ভুলবেন না।
“জীবনে যেই কষ্ট ছিলো এহনো আছে কষ্ট শেষ হয় নাই। যেই বস্তা আগে কান্দে নিয়া ঘুরতাম, এহনো বস্তা কান্দে নেওয়া লাগে। আমাদের স্বপ্ন আশা অনেকই থাহে। কিন্তু সব আশা আর পূরণ হয় না। কিন্তু আমার একটা আশা আছে। যেখানেই যাই, এই পাখি, এই প্রাণীদের খাবার দিমু আমি, সারাজীবন দিয়াই যামু।”
খোলা আকাশের নিচে তাঁর এই দোকান একদিন হয়তো থাকবে না | মাধবীলতার শাখা প্রশাখার আড়াল থেকে পাখিগুলো হয়তো তখনও কিচিরমিচির করবে। কাঠবিড়ালীগুলো অপেক্ষায় থাকবে কেউ খাবার নিয়ে এলো কিনা! ইঁদুরগুলোও গর্ত থেকে বের হবে, উপরে তাকিয়ে দেখবে কেউ “আয় আয়” বলে ডাকে কিনা। তখনও মাধবীলতার পাতাগুলো হয়তো দুল খেতে থাকবে বাতাসের ধাক্কায়। তখন হয়তো অন্য কেউ ডাকবে। হয়তো ডাকবে না।
তাহমিদ সাকিব
গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ,
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়