নিল আর্মস্ট্রং ছিলেন একাধারে মার্কিন মহাকাশচারী, বৈমানিক প্রকৌশলী এবং চন্দ্রপৃষ্ঠে অবতরণকারী প্রথম ব্যক্তি। তিনি একজন নৌ-বিমানচালক, পরীক্ষামূলক বৈমানিক, এবং একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ছিলেন। আজ ইতিহাস বিখ্যাত এই ব্যক্তির ৯১ তম জন্মবার্ষিকী।
জন্ম
নিল আলডেন আর্মস্ট্রং ওহাইওতে ১৯৩০ সালের ৫ অগাস্ট জন্ম নেন। বাবার সঙ্গে ছয় বছর বয়সে বিমানে ওড়া আর্মস্ট্রং মাত্র ১৬ বছর বয়সেই তা চালানো শিখে ফেলেন। গাড়ি চালানোর লাইসেন্স পাওয়ার আগেই রপ্ত হয়ে যায় আকাশে ওড়ার কায়দা।
বৈবাহিক জীবন :
১৯৫৬ সালে জেনেটকে বিয়ে করেন। ১৯৯৪ সালে তাদের বিবাহ বিচ্ছেদ হলে তিনি বিয়ে করেন ক্যারল নাইটকে।
প্রথম মহাকাশ অভিযান :
নিল আর্মস্ট্রং চাঁদে অবতরণকারী প্রথম মানুষ হিসাবে পৃথিবীর ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে আছেন। আর্মস্টংয়ের মহাকাশ অভিযানের শুরু ৩৫ বছর বয়সে। ১৯৬৬ সালের ১৬ মার্চ মহাশূন্যযান জেমিনি-৮ এ সেই অভিযানে তার সঙ্গী ছিলেন ডেভিড স্কট এবং তিনি ওই নভোযানের চালক হিসাবে ছিলেন। উক্ত অভিযানে তিনি ও ডেভিড স্কট মিলে সর্ব প্রথম দুইটি ভিন্ন নভোযানকে মহাকাশে একত্রে যুক্ত করেন।
দ্বিতীয় মহাকাশ অভিযান :
আর্মস্ট্রং-এর দ্বিতীয় মহাকাশ মিশন ছিল এপোলো-১১ এর মিশন কমান্ডার হিসাবে। ১৯৬৯ সালের জুলাইয়ের ২০ তারিখ চাঁদে অবতরণ করে অ্যাপোলো-১১ যার কমান্ডার ছিলেন নীল আর্মস্ট্রং। চাঁদের ভূমিতে অবতরণের ৬ ঘণ্টা পর গ্রীনউইচ মান সময় ১২:৩৬ পিএম-এ নিল আর্মস্ট্রং সিঁড়ি বেয়ে নেমে চাঁদের বুকে পা রাখেন। এই বিরল ঘটনার মধ্য দিয়ে পৃথিবীর ইতিহাসে চাঁদে পা রাখা প্রথম নভোচারী হয়ে ওঠেন তিনি। সেদিন বিশ্বের ৫০ কোটিরও বেশি মানুষ টেলিভিশনে দেখেছিল সেই দৃশ্য। আর্মস্ট্রং ছিলেন মিশন কমান্ডার এবং ধূলিময় চন্দ্র পৃষ্ঠতলের চন্দ্র মডিউল পাইলট এডুইন বাজ অল্ড্রীন যোগ দিয়েছিলেন ২০ মিনিট পরে। মাইকেল কলিন্স, কমান্ড মডিউল পাইলট, চাঁদ এর চারপাশের কক্ষপথে প্রদক্ষিণ করতে ছিলেন। প্রথম মানুষ হিসাবে চাঁদে পা রাখার সময় তিনি মন্তব্য করেন: এটি একজন মানুষের জন্য ক্ষুদ্র একটি পদক্ষেপ, কিন্তু মানবজাতির জন্য এক বিশাল অগ্রযাত্রা। চাঁদে আর্মস্ট্রং ও এডুইন অল্ড্রিন জুনিয়র অবতরণ করেন ও ২.৫ ঘণ্টা কাটান।
কর্ম জীবন :
বৈমানিক হিসেবেই তার বেশি পদচারণা। তাছাড়া আরো কিছু কর্মে তার সম্পৃক্ততা ছিল। নীল আর্মস্ট্রং নভোচারী হওয়ার আগে মার্কিন নৌবাহিনীর বৈমানিক ছিলেন। ১৯৫০ এর দশকের শুরুতে কোরীয় যুদ্ধের সময় নৌবাহিনীর ফাইটার জেট চালিয়েছেন তিনি। নেভিতে দুই বছর চাকরিকালে তিনি কোরিয়ান যুদ্ধে অংশ নিয়ে তিনটি পদক পান। এর পর তিনি ড্রাইডেন ফ্লাইট রিসার্চ সেন্টারের পরীক্ষামূলক বিমান চালক হিসাবে যোগ দেন। বিভিন্ন পরীক্ষামূলক বিমান নিয়ে তিনি ৯০০ এরও অধিক বার উড্ডয়ন করেন। ১৯৫২ সালে সামরিক বাহিনী ছেড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের লেখাপড়ায় মন দেন এবং ১৯৬২ সালে যোগ দেন মার্কিন মহাশূন্য কর্মসূচিতে। ১৯৫৫ সালে তিনি নাসায় যোগদান করেন। তিনি ১৯৬২ সালে মার্কিন মহাকাশ কর্মসূচিতে যোগ দেন। অ্যাপোলো-১১ ছিল আর্মস্ট্রংয়ের শেষ মহাকাশ অভিযান। ১৯৭১ সালে তিনি মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা (নাসা) ছেড়ে যান। নীল আর্মস্ট্রং যখন চন্দ্র বিজয় অভিযানে যান, তখন তার বয়স ছিল ৩৮ বছর। আর্মস্ট্রং যে স্পেস স্যুট পরে চাঁদের মাটিতে নেমেছিলেন, তা আজও নাসায় সংরক্ষিত রয়েছে। অবশ্য সফল চন্দ্র অভিযানের এক বছরের মাথায় নীল আমস্ট্রংকে নাসার অ্যারোনটিকস বিভাগের ডেপুটি অ্যাসোসিয়েট অ্যাডমিনিস্ট্রেটর নিয়োগ দেওয়া হয়। ২০১২ থেকে প্রায় ৪১ বছর আগে আর্মস্ট্রং নাসা থেকে অব্যাহতি নেন। যদিও নাসা এর সাথে তার সম্পর্ক ছিন্ন ছিল, তারপরও একজন সাবেক মহাকাশচারী হিসেবে তিনি নাসা ও তার ভবিষ্যৎ সম্পর্কে একজন সমালোচক ছিলেন। তিনি চাঁদে ফিরতি মিশন এবং মঙ্গলে মনুস্য মিশনের সমর্থন করেন। লোএল মানমন্দিরে নতুন ডিস্কভারি চ্যানেল টেলিস্কোপ উন্মোচনই ছিল তার সর্বশেষ পাবলিক এপিয়ারেন্স। এরপর তিনি অ্যারোস্পেস ইঞ্জিনিয়ারিং-এর প্রফেসর হন এবং বিভিন্ন কোম্পানির বোর্ডে দায়িত্ব পালন করেন। অ্যাপোলো-১১ এর পরে আর্মস্ট্রং আর কোন মহাকাশ অভিযানে অংশগ্রহণ করেননি। পরবর্তী সময়ে তিনি শিক্ষকতা পেশায় যুক্ত হন। ভবিষ্যতের নভোচারীদের তিনি এরোস্পেস ইঞ্জিনিয়ারিং (বিমান ও নভোযান প্রকৌশল) বিষয়ে পড়াতেন। তিনি ১৯৭৯ খ্রীস্টাব্দ পর্যন্ত ইউনিভার্সিটি অফ সিনসিনাটির ঊড্ডয়ন প্রকৌশলের অধ্যাপক হিসাবে কাজ করেন। স্ত্রী ক্যারলের সঙ্গে সিনসিনাটিতেই বসবাস করতেন তিনি।
সম্মাননা :
একজন নভোচারী হিসেবে আর্মস্ট্রং সব সময়ই নিভৃতে থাকতে পছন্দ করতেন। তবে মার্কিন সরকার তাঁকে যোগ্য সম্মান দিতে কার্পণ্য করেনি। ২০১১ সালের নভেম্বরে আরো তিন নভোচারীর সঙ্গে নিল আর্মস্ট্রংকে যুক্তরাষ্ট্রের সর্বোচ্চ বেসামরিক পদক কংগ্রেসনাল গোল্ড মেডেল প্রদান করেন। মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা তাকে হোয়াইট হাউসে সম্মান জানিয়েছিলেন। তাছাড়া আমেরিকার প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের সময়ে “প্রেসিডেন্সিয়াল মেডেল অব ফ্রিডম” পদকে ভূষিত হোন এবং ১৯৫০ এর দশকের শুরুতে কোরীয় যুদ্ধের সময় নৌবাহিনীর ফাইটার জেট চালিয়েছেন তিনি। নেভিতে দুই বছর চাকরিকালে তিনি কোরিয়ান যুদ্ধে অংশ নিয়ে তিনটি পদক পান।
১৯৬৯ সালের ২০ জুলাই চাঁদে অবতরণের মাধ্যমে ‘মানুষের পক্ষে সবই সম্ভব’ এই বিশ্বাসকে সার্থক করতে সক্ষম হয়েছিল মার্কিন মহাকাশ সংস্থা নাসা। প্রযুক্তিগতভাবে এটিই ছিল শতাব্দীর সেরা অর্জন।
মৃত্যু
ইতিহাসের এই মহানায়ক ৮২ বছরে বাইপাস সার্জারির কিছুদিন পর ২০১২ সালেন ২৫ আগস্ট ওহাইও-এর সিনসিনাটিতে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন।