চার্লি চ্যাপলিন: নির্বাক কথকতায় জীবন ফুটিয়ে তোলা বিপ্লবী

দ্য রিপোর্ট ডেস্ক

ডিসেম্বর ২৫, ২০২১, ০৯:৫২ পিএম

চার্লি চ্যাপলিন: নির্বাক কথকতায় জীবন ফুটিয়ে তোলা বিপ্লবী

অনেক কথা যাও যে বলে কোনো কথা না বলি’ রবি ঠাকুরের এই কবিতার লাইনের মতোই তিনি তার অতিশয় সুনিপণ কথাহীন অভিনয়ে বহু কথাই ফুটিয়ে তুলতেন। পরনে নোংরা ঢিলেঢালা প্যান্ট, শরীরে জীর্ণ কালো কোর্ট, পায়ে মাপহীন জুতা, মাথায় কালো হ্যাট আর হাতে লাঠি। সাথে যে ব্যাপারটি কারো চোখ এড়ায় না তা হলো লোকটির গোঁফ। সব মিলিয়ে তামাশার সর্বশেষ। কিন্তু সেই তামাশার অতল গভীরে লুকিয়ে থাকে মানুষের জীবনে হাহাকার, রুঢ় বাস্তবতার বিরুন্ধে অবিরাম যুদ্ধ। ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য, নিপীড়িতের ক্ষোভ, বঞ্চিতের কথকতা— সব উঠে আসে তার নির্বাক চলমান চিত্রে। চ্যাপলিন, চার্লস স্পেনসার চ্যাপলিন; দর্শকরা যাকে ভালবেসে নাম দিয়েছেন চার্লি চ্যাপলিন। নির্বাক কথাকতার এক অবিরাম বিপ্লবী। 

‘I always like walking in the rain, so no one can see me crying’- আমি সবসময়ই বৃষ্টিতে একা হাঁটতে পছন্দ করি, যেন আমার চোখের পানি কেউ দেখতে না পায়। মানুষটি কখনোই তার চোখের পানি কাউকে দেখাতে চাননি।

যে মানুষটি এই জীবনদর্শন ধারন করতেন, বুঝাই যাচ্ছে তার কাছে শব্দের চেয়ে নীরবতাই বেশি প্রাধান্য পেত। নিজের চোখের পানি লুকিয়ে বিশ্বের কোটি মানুষকে যুগের পর যুগ ধরে হাসিয়ে চলছেন। কোন কথা নয়, স্রেফ অভিনয় শৈলীর মাধ্যমে।

মাত্র ৫ বছর বয়েসে অভিনয়ে এসেছিলেন। তারপর বাকী জীবন অভিনয় করেছেন প্রায় বিরামহীনভাবে। সাদাকালো নির্বাক চলচ্চিত্রের যুগে তিনি কিভাবে দর্শকদের আকৃষ্ট করে রাখতেন তা বোধহয় না বলে দিলেও চলে। সেটা যে তার অসাধারণ অভিনয়, তা সবাই একবাক্যে স্বীকার করবে। শৈশব-কৈশোরের মাঝামাঝি একটা সময়ে তাকে কিছুদিন থাকতে হয়েছে এক বোর্ডিং স্কুল কাম অনাথাশ্রমে। ১৮৯৬ সালে প্রায় ১৮ মাস তাকে সেখানে থাকতে হয়েছিল।

সোনার চামচ নয়, দূর্দান্ত প্রতিভা এবং অসাধারণ মেধা নিয়ে জন্ম নেওয়া এই মানুষটির নাম চার্লস স্পেন্সার চার্লি চ্যাপলিন। দারিদ্রের কারণে অনাথাশ্রমে থাকা, অল্প বয়েসে বাবাকে হারানো, ১৯ বছর বয়েসে নিজের প্রেমিকা হেটিকেলিকে সড়ক দুর্ঘটনায় মরতে দেখে চার্লি কখনোই আর পার্ককে ভালোবাসতে পারেননি। জীবনে একাধিকবার অপমানের শিকার হয়েছেন। তাই হয়তো নিজের ডায়েরিতে লিখেছিলেন, “I have known humiliation, And humiliation is a thing you cannot forget’. পেটের দায় মেটাতে বাবা-মা হারা বাস্তুভিটাহীন চার্লি নেমেছিলেন মুকাভিনয়ে। অভিনয়ের খাতিরে, কুকুর, বেড়াল, শুয়োর কি সাজেননি? কাজ করেছেন নাপিতের দোকানেও। জীবনের চাড়াই উৎরাই এত কাছে থেকে দেখে হয়তো ভেতরে বৈতরে হাসতে ভুলে গিয়েছিলেন চার্লি। তাই আজীবন বৃষ্টিতে কান্না লুকিয়ে হাসিয়ে চলেছেন সবাইকে।

চার্লি চ্যাপলিন এবং তার স্ল্যাপস্টিক সমার্থক। এই দুই যেন এক হরিহর আত্মা। চার্লির এই স্ল্যাপস্টিককে আমরা বলবো তার জাদুর কাঠি। নিজের দুর্দান্ত অভিনয় এবং তার সেই জাদুর কাঠির নিপুন ব্যবহারে দিনে দিনে অনন্য হয়ে উঠেছিলেন চার্লি। ১৯১৩ সালের ডিসেম্বর মাসে চার্লি চুক্তিবদ্ধ হন ম্যাক সেনেটের কার্নো কোম্পানির সঙ্গে। তাকে বেশ চড়া দামেই নিয়েছিলেন প্রতিষ্ঠানে মালিক। সেই আস্থার জবাব দিতে ভুল করেননি চার্লি। কার্নোর হয়ে প্রথম সিনেমাতেই বাজিমাৎ করে দিয়েছিলেন চার্লি। ‘মেকিং আ লিভিং’ সিনেমায় অভিনয় করে সবার মনেই দাগ কেঁটেছিলেন তিনি।

সেসময়ে, সিনেমায় প্যান্টোমাইম মানে কিম্ভুতকিমাকার সাজ, রঙচঙ এবং বিটকেল সব অঙ্গভঙ্গি। চার্লি চ্যাপলিন সেই ধারাকে চিরদিনের জন্য বদলে দিয়েছিলেন। ‘মেকিং আ লিভিং’-এ তার অভিনয় প্রসঙ্গে এক পরিচালক লিখেছিলেন, “The clever player who takes the part of the sharper is a comedian of first water’. এভাবেই চার্লি তার কাজে স্বীকৃতি পেয়েছিলেন।

তারপর আর পেছনে তাকাকে হয়নি। ‘Kid Auto Races at Venice’-এ চার্লি চ্যাপলিন যেভাবে হাজির হয়েছিলেন, সেই সাজ পোশাক অল্প দিনের মধ্যেই বিশ্বজোড়া পরিচিত এবং সমাদৃত হয়েছিল। ১৯৪০ সাল পর্যন্ত চ্যাপলিন তার এই সাজটি ধারাবহিকভাবে অনুসরণ করেছেন। কিন্তু তারপর ক্রমশ সেটি বিবর্তিত হয়েছে। ১৯৪৭ সালে এসে তার বিখ্যাত পোশাকটি পুরোপুরি বাতিল হয়ে যায়।  

৩০ টির বেশি নির্বাক চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছিলেন চার্লি চ্যাপলিন। এসব চলচ্চিত্র এমনি এমনি দর্শকপ্রিয়তা লাভ করেনি। তার শরীরী কসরৎ, তার সেই বিখ্যাত গোঁফ এবং তার স্ল্যাপস্টিক বা তার জাদুর কাঠির সমন্বয় তাকে করে তুলেছিল অসাধারণ। সমাজ এবং রাজনীতিকে নির্বাকভাবেও বিদ্রুপ করার এক অসাধারণ দক্ষতা নিয়ে জন্মেছিলেন চ্যাপলিন।

সমাজ ব্যবস্থার প্রতি বীতশ্রদ্ধ যুবকের ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা, প্রতিকূল পরিস্থিতি উত্তরণ, লাঞ্ছিত-অপমানিত হয়েও ফের ঘুরে দাঁড়ানো এবং জীবনের সকল ব্যর্থতা-গ্লানিকে কাটিয়ে আবারও জীবনে ফেরার যে চেষ্টা নির্বাক শরীরী গল্পের মাধ্যমে চ্যাপলিন করেছেন তা এককথায় অনবদ্য। বেয়াড়া পরিস্থিতিকে বেয়াড়াভাবে সামলানোর যে হাস্যকর প্রচেষ্টা তা প্রচলিত সামাজিক মূল্যবোধকে চপেটাঘাত করে প্রবলভাবে। এবং এখানেই চ্যাপলিনের স্বার্থকতা। ব্যর্থতায়, বিপর্যয়ে, লাঞ্ছনায় সৃষ্ট হাস্যকর অবস্থা দিয়ে জীবন বুঝানোর যে অদম্য স্পৃহা চ্যাপলিনের ছিল তা তো কেবল তাকে দেখেই মূল্যায়ন করতে হবে।

স্ল্যাপস্টিক বা চ্যাপলিনের জাদুর কাঠি এবং ভদ্র সমাজের স্যুট-টাই-প্যান্ট পরিহিত হয়ে সেসবের দূর্দান্ত উপস্থাপন সেগুলোর অন্তঃসারশূন্যতা, ইতর মানসিকতাকে তীব্র ভাবে চিনিয়ে দিয়েছিলেন চ্যাপলিন। কৃত্রিম এবং পোশাকি সভ্যতার ইতরামি, ভণ্ডামিকে উন্মোচন করেছেন হাস্যকর কিন্তু অসাধারণ কার্যকর উপায়ে। তার এই হাস্যকর কিন্তু প্রতিবাদী চরিত্রের ক্যারিকেচার দেখে হাসেনি এমন মানুষের সংখ্যা কম। আজকের বিশ্বেও কোটি মানুষ চ্যাপলিনকে দেখেই হেসে উঠেন, এমন সংখ্যাও কম নয়।

মানুষের মুখে হাসি ফোঁটানো এই মানুষের হাসি কেড়ে নিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মার্কিন-রাশিয়া দ্বন্দ্ব তথা গণতন্ত্র-কমিউনিজমের মধ্যকার দ্বন্দ্বের বলি হয়েছিলেন চ্যাপলিন। তার আত্মজীবনীমূলক চলচ্চিত্র ‘লাইমলাইট’-এর কারণে তাকে আমেরিকা থেকে বহিষ্কার করা হয়। চ্যাপলিনের রাজনৈতিক মতাদর্শ এবং নৈতিক আচরণের কারণ দেখিয়ে তাকে আমেরিকায় ঢুকতে বাঁধা দেওয়া হয়। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল তিনি কমিউনিস্টদের প্রতি সহানুভূতিশীল।

নিজের জীবনের চড়াই-উৎরাইই তিনি সিনেমার রিলে প্রস্ফুটিত করেছিলেন নিপুনভাবে। যেন, বৃষ্টির মাঝে কান্নার মতো করে। দুঃখ আছে ঠিকই কিন্তু সেটা কারও চোখের আড়ালে। হাসির আড়ালেও তেমনি লুকিয়ে ছিল সুতীব্র শ্লেষ, ধিক্কার, ক্লেদ এবং হতাশা। সেসবেরই শৈল্পিক রূপায়ন করেছিলেন চার্লি চ্যাপলিন তার নির্বাক কথকতায়।

Link copied!