প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার। ভারত উপমহাদেশে ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা যুদ্ধের সশস্ত্র বিপ্লবী ও শহীদ হওয়া প্রথম নারী মুক্তিযোদ্ধা। পরিবারের চাইতে দায়িত্ব ছিল যার কাছে বড়। আর এই দায়িত্বরোধ থেকেই দেশের জন্য, দলের জন্য, ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের জন্য ২৪ সেপ্টেম্বর আত্মাহুতি দেন চট্টগ্রামের এই বীর অগ্নিকন্যা।
কলকাতায় প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের মূর্তি। ছবি: সংগৃহীত
শৈশব থেকেই পূর্ববঙ্গে ব্রিটিশদের আধিপত্যে বিক্ষুব্ধ প্রীতিলতা। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের গোপন দলিলপত্র পাঠ থেকে উদ্বুদ্ধ হন সশস্ত্র বিপ্লবে। যোগ দেন সূর্যসেনের বিপ্লবী দলে। ভারতীয়দের প্রতি ব্রিটিশদের বর্ণবৈষম্য দৃষ্টিভঙ্গির জবাব দিতে হামলা চালান ইংরেজদের একটি ক্লাবে। তবে হামলা ব্যর্থ হলে ধরা পড়ার ভয়ে সায়ানাইড খেয়ে আত্মাহুতি দেন মাস্টার দ্য সুর্যসেনের অন্যতম প্রধান এই নারী শিষ্য।
ভারতের কলকাতায় ইউরোপিয়ান ক্লাব নামটা সহ্য করতে পারতেন না বিপ্লবীরা। ওই নামটি মাথায় আগুন জ্বালিয়ে দিত বিপ্লবীদের। ইংরেজদের আমোদ প্রমোদের জন্য এই ক্লাবের গেটে লেখা ছিল “ডগ এন্ড ইন্ডিয়ান প্রহিবিটেড”। ভারতের বুকে দাঁড়িয়ে ভারতীয়দের এতো অপমান। প্রতিশোধ নিতে বেশ কয়েকবার ওই ক্লাবে হামলার পরিকল্পনা ভেস্তে যাচ্ছিলো। ১৯৩০ এর এপ্রিল থেকে বারবার ওই ক্লাব আক্রমনের পরিকল্পনা ভেস্তে যাচ্ছিলো। বিপ্লবী শৈলেশ্বর চক্রবর্তীর নেতৃত্বে একটি দল হামলাও ব্যর্থ হয়। বিপ্লবী কল্পনা দত্তও গোপন খবর আনতে গিয়ে ধরা পড়েন। পরে মাস্টারদা সূর্যসেনের নির্দেশে ক্লাবে হামলার দায়িত্ব পড়ে প্রীতিলতার ওপর।
চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের নির্মিত প্রীতিলতার ব্রোঞ্জমূর্তি: ছবি: সংগৃহীত
১৯৩২ এর ২৩ সেপ্টেম্বর। রাত ৯টার দিকে প্রীতিলতা নিজেকে সাজালেন পাঞ্জাবি পুরুষের বেশে। মালকোঁচা দেওয়া ধুতি, শার্ট, মাথায় পাগড়ি, হাতে লাঠি, কোমরে পিস্তল। সঙ্গে আরও ৮ জন পুরুষ বিপ্লবী। ঝাঁসির রানীর কাহিনী, ক্ষুদিরাম, বাঘা যতীনের আত্মত্যাগের কাহিনী মনে পেড়ে উত্তেজনায় বুক কাঁপছে। কিন্তু স্নায়ু তার অচঞ্চল। এতদিনের অ্যাকশনের স্বপ্ন পূরণ হবে আজ।
রাত ১০ টা ৪৫। ক্লাবে তখন ৪০ জন নারী পুরুষ গান বাজনা নেশায় মত্ত। পূর্বদিকের দরজা দিয়ে আক্রমন শুরু করলেন প্রীতি। আচমকা আক্রমনে দিশাহারা হয়ে গেলো ইংরেজরা। উত্তর ও দক্ষিণের দরজা দিয়ে গুলি বোমা নিয়ে আক্রমন করলো আরও দুটি দল। এবার পুলিশও জবাব দিলো। ক্লাব হয়ে উঠল রণক্ষেত্র। একটি গুলি লাগলো প্রীতির শরীরের বামদিকে। রক্তক্ষরণের মাঝেও হুইশেল বাজিয়ে নির্দেশ দেন দলকে। একজনকে নিহত ও ১১ জনকে আহত করে পালাতে চাইলেন তারা। কিন্তু প্রীতিকে ঘিরে ফেললো পুলিশ। পালাবার কোনই পথ নেই। সঙ্গীদের বললেন, ভারত মাকে স্বাধীন করার জন্য অনেক পুত্র প্রাণ দিয়েছে। কন্যাদের প্রাণ দেওয়ার দ্বারটা উন্মুক্ত করতে আজ আমার স্বেচ্ছায় মৃত্যুবরণ। চোখ বুজে মা বাবাকে স্মরণ করলেন প্রীতি, স্মরণ করলেন দলনেতা সূর্যসেনকে। তারপর পোশাকের মধ্যে থেকে পটাশিয়াম সায়নাইডের শিশি খুলে ঢেলে দিলেন গলায়। তীব্র বিষ জ্বালিয়ে দিলো ভেতরটা। কিন্তু মুখে তার স্বপ্নপুরনের হাসি। মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন আদরের রানী, ইতিহাসের প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার।
বিপ্লবীদের কাছেতো বটেই, সব শ্রেণির নারীর কাছে প্রীতিলতা এক উজ্জ্বল নাম, প্রোজ্জ্বল প্রেরণা। তারই প্রমাণ পাওয়া যায় মাস্টার দ্য সুর্যসেনের সতীর্থ প্রয়াত বামপন্থী নেতা বিপ্লবী নির্মল সেনের এক লেখায়। বিপ্লবের পথে আসার আগে প্রীতিলতার কাছে সূর্যসেনের জিজ্ঞাসা ছিল-পরিবার ও পৃথিবীর প্রতি তোমার টান কেমন? জবাবে চট্টগ্রামের এই অগ্নিকণ্যা বলেছিলেন, ‘টান আছে কিন্তু, ডিউটি টু ফ্যামিলিকে ডিউটি টু কান্ট্রির কাছে বলি দিতে পারবো।’
১৯১১ সালের ৫ মে। চট্টগ্রামের পটিয়ার ধলঘাট গ্রামে জন্ম এই ক্ষণজন্মা তরুনীর। মাত্র ২১ বছর, ৪ মাস ১৯ দিনের মাথায় আত্মাহুতি দিলেন। তবে ইতিহাসে অমরত্বের বিরাট ফলকে নিজের নামটি খোদাই করে গেলেন।