চেহারাটা তার ছিল নিপুণ শিল্পীর হাতে আঁকা ছবি মত। আর সে কারণেই ছোটবেলা থেকে সকলে তাকে ডাকত ছবি বলে। শেষ পর্যন্ত এই নামটি পাকাপাকি হয়ে যায় তার জন্য। বাংলা চলচ্চিত্রে যার জন্য বেশ কিছু সিনেমার পরিকল্পনা করে শেষ পর্যন্ত আর চলচ্চিত্র নির্মাণ করেননি সত্যজিৎ রায়, তার নাম 'ছবি বিশ্বাস'।
মাত্র বাষট্টি বছরের জীবন। ১৯০০ সালে জন্ম নেওয়া এই ব্যক্তিটির মৃত্যু হয় ১৯৬২ সালের ১১ জুন। আজ ১৩ জুলাই তার জন্মদিন উপলক্ষে আবারও আলোচনা বাংলা চলচ্চিত্রের আধুনিক এই পুরুষকে নিয়ে। চলচ্চিত্রে আঙ্গিনা ছাড়াও তার চরিত্র উপস্থাপনা এবং সংলাপে মঞ্চ নাটকেও একেবারেই ভিন্ন ছিলেন ছবি বিশ্বাস। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘দুই পুরুষ’, মনোজ বসুর কাহিনী-আধারিত ‘ডাকবাংলো’, দেবনারায়ণ গুপ্ত-র ‘শ্রেয়সী’, ‘ঝিন্দের বন্দী’ এমন অনেক ঐতিহাসিক নাটক মঞ্চায়নে তিনি ছিলেন প্রাণকেন্দ্র। শিশির ভাদুড়ীর ভাই ছিলেন ছবি বিশ্বাসের সহপাঠী, তাই ‘বড়দা’ বলতেন। তাঁর কাছ থেকে অভিনয় দেখেছেন, শিখেছেন, তারপর পালটেছেন সেই অভিনয়কে। চলচ্চিত্র চর্চা নিয়ে ব্যস্ততার জন্য একপর্যায়ে নয় বছর বাদ পড়েছিল মঞ্চাভিনয়, শরীরও ভাল যাচ্ছিল না। ডাক্তারের অনুমতি নিয়ে যে দিন স্টার থিয়েটারে ফিরলেন, বুকিং অফিস খুলতেই লম্বা লাইন, প্রতিটা শো হাউসফুল। সে সময় বাংলা চলচ্চিত্রে নায়ক-নায়িকাদের সঙ্গে পাল্লা দিয়েই বক্স অফিস নিজের দিকে টানতের এই ছবি বিশ্বাস।
অনেকেই জানেন না, বাংলা চলচ্চিত্রের অন্যতম জনপ্রিয় নির্মাতা ঋত্বিক ঘটক তার ‘কত অজানারে’ চলচ্চিত্রের কাজ শুরু করেছিলেন ছবি বিশ্বাসকে নিয়ে। ছবিবাবু ব্যারিস্টারের রোলে, যে পার্ট তাঁর তুড়ি-মারা কাজ। শ্যুটিংয়ে ঋত্বিক বারবার কাট করছেন, 'হচ্ছে না ছবিদা। উকিল হয়ে যাচ্ছে, ব্যারিস্টার হচ্ছে না।' হতভম্ব ছবি বিশ্বাস ঋত্বিককেই বললেন, ব্যারিস্টারের অভিনয় দেখিয়ে দিতে। ঋত্বিকও তা-ই করলেন। ফ্লোরে সবাই তখন তটস্থ! কেননা ছবি বিশ্বাসকে অভিনয় দেখিয়ে দেয়া হচ্ছে। নিশ্চয়ই এখন হুলুস্থুল কিছু করে বসবেন তিনি। কিন্তু ছবি বিশ্বাস ঋত্বিকের দেখিয়ে দেয়া শর্ট দিলেন। পরে বলেছিলেন, 'এ ঢ্যাঙাও (অন্য ‘ঢ্যাঙা’টি হলেন সত্যজিৎ রায়) অনেক দূর যাবে।'
ঐতিহ্যে, অর্থে, প্রতিপত্তিতে, দয়া-দাক্ষিণ্যে বনিয়াদি পরিবার হিসেবে কলকাতার বিডন স্ট্রিটের বিশ্বাস পরিবারের আলাদা পরিচিতি ছিল। শৈশবে আদর করে তার মা ডাকতেন ‘ছবি’ বলে। তবে মায়ের স্নেহ জোটেনি বেশি দিন, ‘ছবি’র ১০ মাস বয়সে মা কাত্যায়নী মারা যান। মেজ চাচির কাছে মানুষ হয়েছেন ছবি। নয়ানচাঁদ স্ট্রিটের একটি বেসরকারি স্কুলে ছবি বিশ্বাসের শিক্ষাজীবন শুরু। পরে সেন্ট্রাল কলেজিয়েট স্কুলে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ে হিন্দু স্কুলে ভর্তি হয়েছিলেন। একসময় বিদ্যাসাগর কলেজে ভর্তি হয়েছিলেন।
বাল্যবন্ধুর বড় ভাই শিশির ভাদুড়ীর মাধ্যমে অভিনয় জগতে হাতেখড়ি। এরপর মিনার্ভা থিয়েটারে নাট্য পরিচালক সতু সেনের সঙ্গে কাজ। বেশ অল্পদিনের মধ্যেই নাট্যনিকেতন মঞ্চে ‘সমাজ’ নাটকে পেশাদার শিল্পী হিসেবে কাজ শুরু করে ছবি বিশ্বাস। সে বছরের ডিসেম্বরে নাট্যকার মন্মথ রায়ের ‘মীরকাশেম’ করলেন। একে একে করেন ‘পথের দাবী’, ‘পরিণীতা’ ও ‘ভারতবর্ষ’। ১৯৩৬ খ্রিষ্টাব্দে অন্নপূর্ণার মন্দির চলচ্চিত্রে প্রথম চিত্রাভিনয় করেন। তার অভিনীত চলচ্চিত্রের মধ্যে সত্যজিৎ রায়ের পরিচালনায় জলসাঘর, দেবী, কাঞ্চনজঙ্ঘা, তপন সিংহের পরিচালনায় কাবুলিওয়ালা (চলচ্চিত্র) এছাড়া প্রতিশ্রুতি, শুভদা, হেড মাস্টার উল্লেখযোগ্য। এছাড়াও তিনি বহু বাণিজ্য সফল চলচ্চিত্রে পার্শ্বচরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। তিনি মূলত সাহেবী এবং রাশভারী ব্যক্তিত্বপূর্ণ চরিত্রে অভিনয়ের জন্য খ্যাতিলাভ করেন। ছবি বিশ্বাস প্রতিকার (১৯৪৪) এবং যার যেথা ঘর (১৯৪৯) ছবি দুটির পরিচালক ছিলেন।
ছবি বিশ্বাসের জনপ্রিয়তা বোঝাতে ফেডারেশন অব ফিল্ম সোসাইটিজ অফ ইন্ডিয়ার (পূর্বাঞ্চল) মনোজ মিত্র তার একটি লেখা প্রকাশ করেন। তার কিছু অংশ পাঠকের জন্য হুবহু তুলে ধরা হল- "১১ জুন, ১৯৬২। লোকে লোকারণ্য আর জি কর হাসপাতাল। এত ভিড়, ঢোকা-বেরোনোর পথ সব বন্ধ। থিয়েটার, সিনে-দুনিয়ার সবাই আসছেন, ঢুকতে পারছেন না। উদ্বিগ্ন, থমথমে মুখের সারি। প্রশ্নের গুঞ্জন। কী হয়েছিল? কী ভাবে হল অ্যাকসিডেন্ট? সাদা অ্যাম্বাসেডরটা নাকি তুবড়ে গিয়েছে? ড্রাইভার ছিল না? নিজে চালাচ্ছিলেন? মদ খেয়ে? ডাক্তার না করলেও, মানুষ কি আর ছাড়ে কাটাছেঁড়া? বাতাসে ভাসে আশ্চর্য, বহুবর্ণ এক অভিনেতার ব্যবচ্ছিন্ন শব। কথা-বলা চোখ। দুই ভুরুর একটা তুলে, অন্যটা নামিয়ে আশ্চর্য কৌশলে ডায়ালগ বলতেন, সেই ভুরু। সংলাপের মাঝে ‘পজ’-কে অতুল শিল্পবস্তু বানিয়ে ফেলার সেই কণ্ঠ। বিশু, হারান, মাস্টারমশাই, রহমত, দাদাঠাকুর, বিশ্বম্ভর রায়, কালীকিঙ্কর, ইন্দ্রনাথরা বুঝি আজ ঢুকতে চেয়েও ঢুকতে পারছে না ওই ছ’ফুট, ঋজু শরীরটায়। বাংলা ছবির উত্তম-সুচিত্রা-সুপ্রিয়া-সাবিত্রী-সন্ধ্যার অজস্র কাহিনীর আজ পিতৃবিয়োগ!"