আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম, গাড়ি চলে না, বন্দে মায়া লাগাইছেসহ অসংখ্য কালজয়ী গানের স্রষ্টা বাউল শাহ আব্দুল করিমের ১২তম মৃত্যুবার্ষিকী আজ। ২০০৯ সালের ১২ সেপ্টেম্বর ৯৩ বছর বয়সে পরলোকগমন করেন এই কিংবদন্তী শিল্পী।
‘বন্ধুর বাড়ি এ আত্মায়। গাড়িতে চড়ে আত্মশুদ্ধির সন্ধানে ছুটি। কিন্তু পাই না। রিপু থামিয়ে দেয়। একদিন হয়তো এই গাড়ি পুরোদমে থেমে যাবে। প্রকৃত মালিকের কাছে ধরা দেবে। এই করিমকে তখন মানুষ খুঁজে পাবে শুধুই গানে আর সুরে।’ মৃত্যুর কয়েক বছর আগে এক সাক্ষাৎকারে নিজের লেখা ‘গাড়ি চলে না, চলে না’ গানটি প্রসঙ্গে বাউলসাধক শাহ আবদুল করিম এসব কথা বলেছিলেন।
ঠিক যে-রকম ভবিষ্যদ্বাণী করে গিয়েছিলেন করিম, তাই যেন এখন কাকতালীয়ভাবে হুবহু মিলে যাচ্ছে! মানুষ ঠিকই এখন করিমকে খুঁজে ফেরে তার গান আর সুরে। ১০০ বছর পেরিয়ে এখনো কত প্রাসঙ্গিক আর সমকালীন তার গান ও দর্শন। প্রতিদিন দেশ-বিদেশে টিভি কিংবা এফএম চ্যানেলে বেজে চলে করিমের গান। নাগরিক ‘ভদ্রজনের’ বাসার ড্রয়িংরুম কিংবা ফুটপাতে চায়ের টংয়ে—সর্বত্র সমানভাবে উপস্থিত করিমের গান। তার জীবন ও কর্মভিত্তিক বইও লেখা হয়েছে বিস্তর। বাংলাদেশ-কলকাতার কয়েক শ প্রতিষ্ঠিত শিল্পী গেয়েছেন তার গান। ইংরেজিতে অনুবাদ করে তার গান কণ্ঠে তুলে নিয়েছেন ভিনদেশি শিল্পীরাও। এর চেয়ে বড় সমকালীনতা আর কী-ই বা হতে পারে!
১৯১৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলার উজানধল গ্রামে জন্মগ্রহণ করেছিলেন এই বাউল সম্রাট। তার বাবা ইব্রাহিম আলী ও মা নাইওরজান। কঠোর দারিদ্রের মাঝে বড় হওয়া আব্দুল করিমের সংগীত সাধনার শুরু ছোট বেলা থেকেই। তিনি খুব ছোটবেলায় তার গুরু বাউল শাহ ইব্রাহিম মাস্তান বকশ থেকে সঙ্গীতের প্রাথমিক শিক্ষা নেন। কমর উদ্দিন, সাধক রসিদ উদ্দিন, শাহ ইব্রাহিম মোস্তান বকসের কাছ থেকে নেনে বাউল ও আধ্যাত্মিক গানের তালিম।
তিনি আফতাব-উন-নেসা কে বিয়ে করেন, যাকে তিনি সরলা নামে ডাকতেন।
ভাটি অঞ্চলের সুখ-দুঃখ তুলে এনেছেন গানে। নারী-পুরুষের মনের কথা তিনি প্রকাশ করেছেন আকর্ষণীয় সুরে। ভাটি অঞ্চলের মানুষের জীবনের সুখ প্রেম-ভালোবাসার পাশাপাশি তার গান কথা বলে সব অন্যায়, অবিচার, কুসংস্কার আর সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে। তিনি তার গানের অনুপ্রেরণা পেয়েছেন প্রখ্যাত বাউল সম্রাট ফকির লালন শাহ, পুঞ্জু শাহ এবং দুদ্দু শাহর দর্শন থেকে।
গানে-গানে অর্ধ শতাব্দীরও বেশি লড়াই করেছেন ধর্মান্ধদের বিরুদ্ধে। এজন্য মৌলবাদীদের দ্বারা নানা লাঞ্ছনারও শিকার হয়েছিলেন তিনি।
ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন, কাগমারী সম্মেলন, ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ, স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে মানুষকে প্রেরণা যোগায় শাহ আব্দুল করিমের গান। গানের জন্য মাওলানা ভাসানী, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সহচর্যও পেয়েছেন তিনি।
২০০৯ সালের ১২ সেপ্টেম্বর বাউল সম্রাট শাহ আবদুল করিম মৃত্যু বরণ করেন। সেদিন শনিবার সকাল ৭টা ৫৮ মিনিটে সিলেটের একটি ক্লিনিকে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। সিলেটের নুরজাহান পলি ক্লিনিকে চিকিৎসাধীন আব্দুল করিমকে ১১ সেপ্টেম্বর শুক্রবার দুপুর থেকেই লাইফসাপোর্ট দিয়ে বাঁচিয়ে রাখা হয়ে ছিল।
শাহ আব্দুল করিম লিখেছেন ও সুর দিয়েছেন ১৬০০ এরও বেশি গান। সাতটি বইয়ে গ্রন্থিত আছে এসব গান। বাংলা একাডেমির উদ্যোগে তার ১০টি গান ইংরেজিতে অনুদিত হয়েছে।
মৃত্যুর কয়েকবছর আগে বেশ কয়েকজন শিল্পী বাউল শাহ আব্দুল করিমের গানগুলো গেয়ে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করলে তিনি দেশব্যাপী পরিচিতি লাভ করেন। পেয়েছেন একুশে পদক। শাকুর মজিদ তাকে নিয়ে নির্মাণ করেছেন ‘ভাটির পুরুষ’ নামে একটি প্রামাণ্য চিত্র। এখনো সুবচন নাট্য সংসদ করিমকে নিয়ে শাকুর মজিদের লেখা মহাজনের নাও নাটকের প্রদর্শনী করে জনপ্রিয়তা লাভ করেন।
এছাড়া ২০১৭ শাহ আব্দুল করিমের জীবনভিত্তিক প্রথম উপন্যাস লিখেন সাইমন জাকারিয়া। নাম ‘কুলহারা কলঙ্কিনী’। বাউল সম্রাট শাহ আব্দুল করিমের গানের মধ্যে দিয়ে তাকে খুঁজতে প্রতিদিন ভক্ত ও স্বজনরা গানের আসর বসান। গানের মধ্যে তাকে বাঁচিয়ে রাখতে চান ভক্ত অনুরাগীরা।