১৯৪০ সালে লাহোর প্রস্তাবে শেরে বাংলা একে ফজলুল হক একাধিক স্বাধীন মুসলিম রাষ্ট্রের কথা বলেছিলেন। সেই প্রস্তাবের পর ২২ বছর পর মারা যান তিনি। অথচ, পাকিস্তান গড়ার মূল প্রস্তাবকের ভারত-পাকিস্তানের স্বাধীনতা আন্দোলনের রাজনীতিতে কোন অবস্থান নেই।
কোলকাতার প্রথম মুসলিম মেয়র, ব্রিটিশ বাংলার প্রথম প্রধানমন্ত্রী, সৃষ্টির পর পূর্ব পাকিস্তানের মূখ্যমন্ত্রী ও গভর্নর নির্বাচিত হওয়া প্রকৃত অসাম্প্রদায়িক এবং প্রজা হিতৈষী নেতা, পাকিস্তান প্রস্তাবের মূল কারিগরই নেই পাকিস্তানের স্বাধীনতা আন্দোলনে?
কিন্তু কেন?
`When the tiger is here, the lamb must take leave’ বা ‘যেখানে বাঘ হাজির আছে ভেড়াদের উচিৎ সেই স্থান ত্যাগ করা’-শেরে বাংলা সম্পর্কে এই মন্তব্য করেছিলেন মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ। ১৯৪০ সালে নিখিল ভারত মুসলিম লীগের লাহোর সম্মেলনে একাধিক মুসলিম রাষ্ট্রের প্রস্তাব উত্থাপন করার পর জিন্নাহ এই মন্তব্য করেছিলেন। যা ইতিহাসে ‘লাহোর প্রস্তাব’ এবং পরে ‘পাকিস্তান প্রস্তাব’ নামে পরিচিত হয়। শেরে বাংলার প্রস্তাবে একাধিক স্বাধীন মুসলিম দেশের কথা উল্লেখ থাকায় জিন্নাহর বিষয়টি মোটেও পছন্দ হয়নি না। তারই পরিপ্রেক্ষিতে জিন্নাহ উক্ত মন্তব্য করেন।
ব্যাপারটা কেবল জিন্নাহর অপছন্দেই থেমে থাকেনি। তিনি তার স্বভাবসুলভ চাতুর্যে শেরে বাংলার প্রস্তাবকে মুদ্রণ প্রমাদ বলে উল্লেখ করেন (দেখুন জয়া চ্যাটার্জির বাংলা ভাগ হল)। শেরে বাংলার প্রস্তাবকে জিন্নাহ নতুন করে ব্যাখ্যা করে বলেন, ‘শেরে বাংলার প্রস্তাবে রাষ্ট্রসমূহ বা states এর s ভুলবশত লেখা হয়েছে’। যদিও তার আগে থেকেই জিন্নাহ ভারতে হিন্দু-মুসলিম বিভাজনের কথা বলে আসছিলেন। ১৯৩৬ সালে এক ভাষণে জিন্নাহ বলেন, ‘ভারতে হিন্দু-মুসলিম আলাদা জাতি। তাদের ধর্ম, সংস্কৃতি এবং অন্যান্য সবকিছুই আলাদা’। ১৯৪০ এর এক বক্তব্যে জিন্নাহ তার এই মনোভাবের পুনরাবৃত্তি করেন।
অথচ, অসাম্প্রদায়িক এবং বাঙালির অধিকার আদায়ে সচেতন হক সাহেব ১৯১৮ সালে নিখিল ভারত মুসলিম লীগের সভায় সভাপতির ভাষণে বলেন, ‘হিন্দু প্রকৃতিগতভাবে মুসলমানের শত্রু- হিন্দু-মুসলমান সম্পর্কে এমন ধারণা নিন্দনীয় ভুল’। কিন্তু তার এই অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে কোন মূল্যই দেওয়া হয়নি। একটি মজার বিষয় উল্লেখ্য, শেরে বাংলা একে ফজলুল হকই একমাত্র নেতা যিনি একইসঙ্গে ভারতীয় কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক এবং নিখিল ভারত মুসলিম লীগের সভাপতি ছিলেন।
সারাজীবন ঐক্য ও সাধারণ মানুষের রাজনীতি করা হক সাহেবের রাজনীতিতে চাতুর্য ও ছলচাতুরি ছিল না। তবে সর্বভারতীয় রাজনৈতিক ফিগার হওয়ার উচ্চাভিলাষ ছিল তার। এই উচ্চাভিলাষ, অতিরিক্ত সারল্যই সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্প ছড়িয়ে বিভাজিত হওয়া ভারতের রাজনীতিতে তাকে ব্রাত্য করে তোলে।
হক সাহেবের রাজনৈতিক জীবনের ঘটনাগুলো যদি ক্রমান্বয়ে সাজানো যায় তাহলে দেখা যাবে তিনি ১৯১২ সালে মুসলিম লীগে যোগ দেন। কিন্তু নবাব নাইটদের দল হওয়ায় সেখানে তিনি তাল মেলাতে পারলেন না। ফলে মতপার্থক্য হয়। তারপরও ১৯১৯ সালে তিনি নিখিল ভারত মুসলিম লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। এর এক বছর আগে অর্থ্যাৎ, ১৯১৮ সালে শেরে বাংলা নিখিল ভারত জাতীয় কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পান।
এরপর, ১৯২৯ সালে বঙ্গীয় প্রজা সমিতি গঠন করেন তিনি। পরে কৃষক-প্রজা পার্টিতে পরিণত হওয়া এই সমিতিই শেরে বাংলার জন্য পয়মন্ত এবং তার ব্রাত্য হওয়ার কারণ ছিল। এই পার্টি দিয়েই শেরে বাংলা ১৯৩৭ সালে অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়েছিলেন। এই পার্টিই তাকে বাংলার অবিসংবাদী নেতা হিসেবে পরিচিতি দিয়েছিল। এর মাধ্যমেই তিনি বাংলার মুসলিম এবং হিন্দু সবার জন্য অর্থ্যাৎ বাঙালির অধিকার রক্ষার আন্দোলনে নেমেছিলেন।
জিন্নাহ শেরে বাংলার একাধিক স্বাধীন মুসলিম রাষ্ট্রের ধারণা সম্বলিত লাহোর প্রস্তাব পছন্দ করেননি। সেই অপছন্দের জের ধরে জিন্নাহ বাংলার সরকার থেকে মুসলিম লীগের সদস্যদের পদত্যাগ করতে বলেন। ফলে হক সাহেবের সরকার সংখ্যা গরিষ্ঠতা হারায়। কিন্তু এমনটা হতে পারে ভেবে হক সাহেব আগেই ফরোয়ার্ড ব্লকের নেতা শরৎ বসু এবং হিন্দু মহাসভার নেতা শ্যামা প্রাসাদের সঙ্গে আগেই আলোচনা করে রেখেছিলেন। মুসলিম লীগ সমর্থন তুলে নেওয়ার মাত্র একদিন পরই ফরোয়ার্ড ব্লকের নেতা শরৎ বসুকে সরকার গ্রেপ্তার করে। এর কয়েকদিন পরেই বাংলার ব্রিটিশ রাজের প্রতিনিধি গভর্নর জন গর্ডন অনেকটা জোর করে অন্যায়ভাবে হক সাহেবের পদত্যাগ পত্রে সাক্ষর করিয়ে নেন। এটা যে, সরকার এবং মুসলিম লীগের সাজানো ছিল তা নিয়ে ইতিহাসবেত্তাদের কোন দ্বিমত নেই। এবং এর উদ্দেশ্য ছিল, বাংলায় লীগ এবং ব্রিটিশ রাজের অনুগত একটি পুতুল সরকার গঠন করা। বিশেষ করে বাংলার আরেক নেতা খাজা নাজিমুদ্দিনকে দিয়ে নিজেদের অনুগত সরকার গঠন করা। মুসলিম লীগ কেবল হক সাহেবের সরকার থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করেই ক্ষান্ত হয়নি। ১৯৪১ সালের ডিসেম্বরে হক সাহেবকে মুসলিম লীগ থেকে বহিস্কার করে। হক সাহেবের সরকারকে হঠানোর আরো একটি বড় কারণ ছিল, সাম্প্রদায়িক বিভাজনের যে প্রক্রিয়া দেশজুড়ে চলছিল তা আরো এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। কিন্তু হক সাহেব বাংলায় থাকলে সেটা করা সম্ভব হচ্ছিল না। তাই তাকে হঠানোর জন্য এই সব চক্রান্ত চালানো হয়। ঐতিহাসিক লিওনার্ড গর্ডন তার বই ‘ডিভাইডেড বেঙ্গল’ বইতে বলছেন, ‘ব্রিটিশ রাজ, জাতীয় কংগ্রেস, মুসলিম লীগের মতো সংগঠনগুলো ১৯৩৭ থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত সময়ে বঙ্গীয় সম্প্রদায়গুলোর মধ্যে সহযোগিতার প্রতিটি প্রচেষ্টা ব্যর্থ করে দেয়’। ফলে, নিজেদের স্বার্থেই হক সাহেব হঠানোর দরকার ছিল এই তিন শক্তির।
মুসলিম লীগের এমন হঠকারী সিদ্ধান্ত এবং হক সাহেবকে কংগ্রেসের সেসময় সমর্থন না দেওয়ায় হক সাহেবকে হিন্দু মহাসভার মতো সাম্প্রদায়িক দলের সঙ্গেও জোট বাঁধতে হয়। এবং এটাই তার ব্রাত্য হয়ে পড়ার আরেকটি বড় কারণ। এই সূত্র ধরেই ১৯৪৬ এর নির্বাচনে জিন্নাহর নির্দেশে বাংলার মুসলিম লীগ নেতারা সরব্শক্তি নিয়ে হক সাহেবর বিরুদ্ধে নেমে পড়েন। তাকে মীর জাফর এবং বেইমান তকমা দিতেও কসুর করে না।
হক সাহেব সর্বভারতীয় ফিগার হয়ে উঠতে নিজের কৃষক প্রজা পার্টি বিলুপ্ত করে মুসলিম লীগে যোগ দেওয়াও তার ব্রাত্য হয়ে পড়ার আরেকটি বড় কারণ। কেননা মুসলিম লীগ প্রকৃতপক্ষে কোন গণতান্ত্রিক দল ছিল না। তা কেবলই গুজরাটি মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর একক হুকুমত মতো চলতো। ফলে সেখানে হক সাহেবের মতো স্বাধীনচেতা বাঙালির অধিকার সচেতন নেতা কখনোই জিন্নাহর আচঁল তলে আশ্রয নিতে পারনেন না। আহমেদ রফিক তার বই দেশবিভাগ: ফিরে দেখা বইতে একে বলছেন, ‘এক আসনে দুই পীরের স্থান সম্ভব নয়’।
হক সাহেবের স্বভাব, রাজনৈতিক চেতনা এবং অসাম্প্রদায়িক মনোভাব সম্পর্কে ভিপি মেনন তার ট্রান্সফার অব পাওয়ার ইন্ডিয়া বইতে বলেছিলেন,‘বাংলায় ফজলুল হকই একমাত্র মুসলমান নেতা যিনি প্রদেশের পর্যাপ্ত সংখ্যক হিন্দু-মুসলিম বাঙালিকে ঐক্যবদ্ধ করার ক্ষমতা রাখেন‘। হক সাহেব প্রসঙ্গে আবুল মনসুর আহমেদ লিখছেন, ‘জিন্না ও লীগের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে ফজলুল হক দুর্জয় সাহসের পরিচয় দিয়েছলেন মুসলিম বাংলার রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মুক্তির উদ্দেশ্যে’। ফলে হক সাহেবের তার এই সক্ষমতা, রাজনৈতিক চেতনা, তার রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ এবং সেকারণে কৃষক-প্রজা পার্টিকে মুসলিম লীগের সঙ্গে একত্র করার নির্দেশ দেওয়া, জিন্নাহর চক্রান্তে পড়ে হিন্দু মহাসভাকে সঙ্গে নিয়ে সরকার গঠন করা এ সবই মূলত তাকে ক্রমশ সর্বভারতীয় চরিত্র হতে দেয়নি।
আবুল হাশিম বলছেন, ‘ফজলুল হক কখনো অবাঙালিদের বশ্যতা স্বীকার করেননি। ফজলুল হক ছিলেন, খাঁটি বাঙালি’। মুসলিম লীগের অবাঙালি কেন্দ্রীয় নেতাদের বশ্যতা স্বীকার না করে হক সাহেব তার রাজনৈতিক দর্শনের সঙ্গে আপোষ করেননি। তাই তাকে ব্রাত্য হয়ে পড়তে হয়েছে। তবে হঠকারী যে সিদ্ধান্ত মুসলিম লীগ নেতারা নিয়েছিলেন তা পাকিস্তান জন্মের মাত্র ২৩ বছর পরেই সংশোধিত হয়েছে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের মধ্য দিয়ে। এবং এখানেই জয়ী হয়েছেন ১৮৭৮ সালের ২৬ অক্টোবর তথা আজকের এই দিনে জন্ম নেওয়া বাঙালির অন্যতম চিরন্তন নায়ক হক সাহেব।