পৃথিবীর বুকে সর্বপ্রথম প্রলেতারিয়েত শ্রেণির স্বতন্ত্র রাষ্ট্রের স্বপ্ন পূরণের স্পর্ধা দেখিয়েছিলেন ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিন। পুঁজিবাদী শাসনব্যবস্থা ও রাশিয়ার জারেদের নিপীড়নেপৃষ্ঠ মেহনতি মানুষেরা যখন দিশেহারা হয়ে পড়েন, তখনই আবির্ভূত হন লেনিন। বিপ্লবী কার্ল মার্কস ও এঙ্গেলসের মতবাদের অনুসারী লেনিন সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা। আজ এই মহান বিপ্লবীর ১৫১ তম জন্মদিন।
১৮৭০ সালের ২২শে এপ্রিল রাশিয়ার ভলগা নদীর তীরে সিমবির্স্ক (বর্তমানে উলিয়ানভস্ক) শহরে জন্মগ্রহণ করেন মহামতি লেনিন। তার বাবা ইলিয়া নিকোলায়েভিচ উইলিয়ানভ ছিলেন মাধ্যমিক স্কুলের শিক্ষক। আর মা-মারিয়া আলেক্সান্দ্রভনা ছিলেন একজন বিশিষ্ট শিক্ষিকা। উইলিয়ানভ-আলেক্সান্দ্রভনা দম্পতির ছয় ছেলেমেয়ে ছিল। তারা হলেন- আন্না, আলেক্সান্দর, ভ্লাদিমির (লেনিন), ওলগা, দৃমিত্রি ও মারায়া। লেনিনের ছয় ভাই-বোনের মধ্যে পাঁচজনই বিপ্লবী হয়ে ওঠেন।
লেনিন পড়াশোনায় খুব মনোযোগী ছিলেন। ছিলেন মেধাবীও। ক্লাসের পর ক্লাস উত্তীর্ণ হলেন প্রথম শ্র্রেণির পুরস্কার পেয়ে। পাঠ্যবইয়ের বাইরেও অনেক পড়াশোনা করেন লেনিন। লেরমন্তভ, পুশকিন, তুর্গেনিভ, নেক্রাসভ, তলস্তয়, সালতিকভ, শ্যেদ্রিন প্রমুখ লেখকের লেখা তিনি পড়তে থাকেন আগ্রহ নিয়ে।তবে বিপ্লবী গণতন্ত্রী লেখকরা তার বেশি প্রিয় ছিল। যেমন ভ. গ. বেলিনস্কি, আ.ই. হেতসের্ন, চেনিশেভস্কি, দব্রলিউবভ ও পিসারেভের রচনা তিনি গভীর আগ্রহ নিয়ে পড়তেন।
কিশোর লেলিনের চরিত্র ও দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে ওঠে রুশ সাহিত্য ও পরিবেশের জীবন পর্যবেক্ষণের প্রভাবে। এ সময় পুঁজিবাদ দ্রুত বিকাশ পাচ্ছিল, যান্ত্রিকতা ও প্রযুক্তি হাজার হাজার মজুর নিয়ে মাথা তুলছিল কলকারখানা। ভূমিদাস প্রথার সঙ্গে জার সরকারের স্বৈরাচার, জমিদার ও পুঁজিপতিদের নিপীড়ন; মানুষের অধিকারহীনতা লেলিনের মনে প্রশ্ন জাগায়।
১৮৮৭ সালের মার্চে তার বড় ভাইকে আলেক্সান্দর উইলিয়ানভ জার তৃতীয় আলেক্সান্দরকে হত্যার অভিযোগে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়। এই ঘটনা লেনিনকে প্রচন্ড আলোড়িত করে। ভাইয়ের ফাঁসির পরই মূলত লেনিন বিপ্লবী সংগ্রামের দিকে বেশি ঝুঁকে পড়েন।
লেনিন সবসময় মার্কস ও এঙ্গেলসের লেখা পড়তেন। পাশাপাশি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিপ্লবী শক্তগুলোকে একীভূত করার প্রক্রিয়ায় নেমে যান।১৮৯২ সালে লেনিন সামারায় প্রথম মার্কসবাদী গ্রুপ স্থাপন করেন।
১৮৯৩ সালের আগস্ট মাসে লেনিন সামারা থেকে সেন্ট পিটার্সবার্গে চলে আসেন। সেখানে কিছু গুপ্তচক্র ও তাদের সদস্যরা মার্কসবাদ চর্চা করত এবং তা শ্রমিকদের মধ্যে প্রচার করত। এই ধরনের একটি চক্রে যোগ দেন লেনিন। এ সময় তিনি বিপ্লবী কাজে গভীর আত্মনিয়োগ করলেন এবং পিটার্সবার্গে মার্কসবাদী স্বীকৃত নেতা হয়ে উঠেন।
১৮৯৭ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি জার সরকার লেনিনকে তিন বছরের জন্য সাইবেরিয়ায় নির্বাসনে পাঠায়। এর এক বছর পর লেলিনের বাগদত্তা বধূ নাদেজদা কনস্তানতিনোভনা ক্রুপস্কায়াকেও জার সরকার সাইবেরিয়ায় নির্বাসনে পাঠায়। পরে স্ত্রীর সঙ্গে তিনি সাইবেরিয়ায় থাকেন। স্ত্রী হিসেবে ক্রুপস্কায়া ছিলেন লেলিনের অন্তরঙ্গ বন্ধু ও বিশ্বস্ত সহায়ক।
লেলিনের বিখ্যাত গ্রন্থ ‘রাশিয়ায় পুজিঁবাদের বিকাশ’ বইটি নির্বাসিত জীবনেই লেখে শেষ করেন। ১৯০০ সালের ২৯ জানুয়ারি নির্বাসনের মেয়াদ শেষ হলে ভ্লাদিমির সস্ত্রীক শশুনস্কয়ে ত্যাগ করেন।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের বিরোধিতা করায় লেনিনকে গ্রেপ্তার করা হয়। দুই সপ্তাহ্ পর তিনি মুক্তি পান। মুক্তির পর লেনিন সুইজারল্যান্ড চলে যান তার বিপ্লবী সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার জন্য। ১৯১৭ সালের ৩ এপ্রিল রাতে লেনিন রাশিয়ায় পৌঁছান। সেখানে বিপ্লবের দ্রুত বিকাশ দেখে পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সামনে লেনিন শ্রমিকশ্রেণি ও গরিব কৃষকদের ক্ষমতা দখলের জন্য ব্যবহারিক প্রস্তুতির কর্তব্য, সশস্ত্র অভ্যুত্থানের জন্য তৈরি হবার জন্য জোর দেন।
১ অক্টোবর চিঠিতে লেনিন আর বিলম্ব না করে অভ্যুত্থানে এগোতে বলেন। ২৪ অক্টোবর রাতে পেত্রগ্রাদের ফাঁকা রাস্তাগুলোয় যখন কসাক ও ইউঙ্কার বাহিনীগুলো টহল দিচ্ছিল তখন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে লেনিন স্মোলনি আসেন এবং অভ্যুত্থান পরিচালনায় সরাসরি নেতৃত্ব দেন।
লেনিন ও বলশেভিক পার্টির নেতৃত্বে শ্রমিক, লালরক্ষী, সৈন্য ও নাবিকদের আত্মৎসর্গী সংগ্রাম ও বীরত্বের ফলে জমিদার ও পুঁজিবাদ ধ্বংস হয়।
২৫ অক্টোবর সকাল ১০টায় পেত্রগ্রাদে সোভিয়েতের অধীনস্থ সামরিক বিপ্লব কমিটি লেনিনের বিবৃতি প্রকাশ করে জনগণের নিকট ঘোষণা দিল যে, সাময়িকবক সরকারের সঙ্গে যে আদর্শের জন্য জনগণ লড়ছিল তা সফল হয়েছে। এদিন সন্ধ্যাতেই স্মোলনিতে শুরু হয় দ্বিতীয় সোভিয়েত কংগ্রেস। এতে নানা অঞ্চল থেকে ৬৫০ জন প্রতিনিধি অংশ গ্রহণ করেন, যার মধ্যে ৪০০ জনই বলশেভিক।
২৬ অক্টোবর কংগ্রেসে লেনিনের বক্তৃতা উল্লাসে অভিনন্দিত করে প্রতিনিধিরা। এভাবেই যাত্রা শুরু হয় সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র সোভিয়েত ইউনিয়নের।
১৯২৩ সালের মার্চের গোড়ায় লেনিনের শারীরিক অবস্থা খুবই খরাপ হয়ে আসে। মে মাসেই তিনি গোর্কিতে ফিরে যান। ১৯২৪ সালের ২১শে জানুয়ারি সন্ধ্যা ৬টা ৫০ মিনিটে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণের ফলে মারা যান মহান এক বিপ্লবী নেতা লেনিন।