বাংলাদেশ ও ভারত- দু’দেশের মানুষের প্রাণের কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। বাঙালির প্রতিটি আবেগ অনুভবে জড়িয়ে আছেন তিনি। প্রয়াত হওয়ার আগেই তিনি প্রয়াণ উপলব্ধি করেছিলেন নানাভাবে। আমরা তাঁর কাব্যে মৃত্যুর প্রতিধ্বনি শুনেছি বারবার। শ্রাবণের ভরা বর্ষার এই দিনে (২২ শ্রাবণ) সমাপ্তি ঘটেছিলো কবি গুরুর জীবনের।
বংলা সাহিত্যের প্রায় সব শাখায় রাজত্ব করা রবি ঠাকুর ভয় পেতেন মৃত্যুকে, বিশেষ করে অকালপ্রয়াণকে। একবার মৃত্যু প্রসঙ্গে তিনি বলেছিলেন "শান্তিপূর্ণ মৃত্যুকে বিন্দুমাত্র ভয় করিনি। ভয় করি অপঘাত মৃত্যুকে।" সেই মানুষটাই চেয়েছিলেন নিজের মেয়ের অপঘাতে মৃত্যু। কারণ ছোট মেয়ে মীরার কষ্ট তিনি সহ্য করতে পারছিলেন না।
নিজের পছন্দের পাত্র নগেন্দ্রনাথের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ তাঁর ছোট মেয়ে মীরার বিয়ে দিয়েছিলেন। তবে এই বিয়েতে সম্মতি ছিল না মীরার। সুন্দর ভবিষ্যতের আশায় এই বিয়ে দিলেও রবি ঠাকুরের ওই আশা পূর্ণ হয়নি। নগেন ছিলেন স্বেচ্ছাচারী যার মজ্জায় মজ্জায় ছিল বর্ব্বরতা। তবে বিশ্বকবি নগেনের চরিত্রের ওই বৈশিষ্ঠ সম্পর্কে জানতেন না।
স্বামীকে কোনও দিনও ভালবাসতে পারেননি মীরা। মেয়ের এই জীবন দেখে অপরাধে ভুগতেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। কবি গুরু সারা জীবন ভুগেছেন অবসাদে। তাঁর মনে হয়েছিল এই ভেবে যে তাঁর চাপিয়ে দেওয়া বিয়ের জন্যই তাঁর মেয়ের জীবন নষ্ট হয়েছে। আর এই উপলব্ধি থেকেই তিনি লিখেছেন,"বিয়ের রাত্রে মীরা যখন নাবার ঘরে ঢুকছিল তখন একটা গোখরো সাপ ফস করে ফনা ধরে উঠেছিল— আজ আমার মনে হয় সে সাপ যদি তখনই ওকে কাটত তাহলে ও পরিত্রাণ পেত।" মেয়ের মৃত্যু কামনাও করে ফেলেছিলেন তিনি।
প্রকৃতপক্ষে, অতি আদরের ছোট মেয়ে মীরার মৃত্যু চাইছেন বলে মনে হলেও কবিগুরু আসলে মনেপ্রাণে চাইতেন মীরা মুক্তি পাক তাঁর জীবন থেকে। বাবা হয়ে এই ভাবনাও যে কতটা কষ্টের তা শুধু তিনিই জানতেন। একারণেই রবি ঠাকুরের জীবন মোটেই বিলাসবহুল ছিল না। প্রতি মুহূর্তে গুরুদেবের মনে এসে দানা বাঁধত বেদনা, যন্ত্রণা।
সপরিবারে রবীন্ত্রনাথ ঠাকুরের ছোট মেয়ে মীরা দেবী (চেয়ারে উপবিষ্ট), বা পাশে ছেলে নীতীন্দ্র, ডান পাশে মেয়ে নন্দিতা, পেছনে স্বামী নগ্রেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়। ছবি: সংগৃহীত
রবি ঠাকুর বাঙালির জীবনে কখনও অপ্রাসঙ্গিক নন। তিনি সব সময় নক্ষত্রের মতো জ্বলজ্বল করেন। বাংলা সাহিত্যে প্রেম, রোমাঞ্চ, ভালবাসা-ভাললাগার কথাগুলো আমরা রবীন্দ্রনাথের মাঝেই পাই। এই মানুষটিই বলে গিয়েছেন হাজারো মানুষের মনের সবচেয়ে কাছের কথাগুলি, ভালবাসার কথা-প্রেমের অমূল্য বাণী।
অথচ প্রেমের এই কবিকে যন্ত্রণা নাম এক কাঁটা সবসময় দহন করতো। আর একারণেই রবি ঠাকুর সবার মধ্যে থেকেও ছিলেন খুবই একা। আর তাই হয়তো তাঁর কলমে উঠে এসেছিল, ' প্রেমের আনন্দ থাকে স্বল্পক্ষণ কিন্তু বেদনা থাকে সারাটি জীবন'-এর মতো লেখা। কোথাও তাঁকে প্রতিনিয়ত দগ্ধ করত কোনও অজানা বেদনা। তা কবি বুঝতে পারতেন মন থেকে। তাইতো অমলের একাকিত্ব আজও আমাদের কাঁদায়।