১৭ বছর বয়সে স্কুলের এক বান্ধবীকে নিয়ে লেখা একটি কবিতা পাঠিয়েছিলেন দেশ পত্রিকায়। লেখাটি ছাপাও হয়েছিল। কবিতাটির নাম ছিলো ‘একটি চিঠি’। ওই দিয়েই শুরু। তারপর আর বের হতে পারেননি লেখালেখি থেকে। জীবনভর লিখেছেন দুহাতে। বাংলা সাহিত্যে তাকে সব্যসাচীই বলা যায়। গল্প, উপন্যাস, নাটক, কবিতা কী লিখেননি?
আজ ৭ সেপ্টেম্বর, সব্যসাচী এই লেখক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের জন্মদিন। ১৯৩৪ সালের এদিনে বাংলাদেশের মাদারীপুরের মাইজপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন। চার বছর বয়সে পরিবারের সাথে চলে যান পশ্চিমবঙ্গের কলকাতায়। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা শেষ করে উচ্চ শিক্ষার জন্য যান যুক্তরাষ্ট্রে।আইওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী জীবন শেষ করার পর একই বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরিয়ান হিসেবেও কাজ করেছেন কিছুদিন।
আইওয়াতেই সুনীল পরিচিত হয়েছিলেন ফরাসী তরুণী মার্গারিট ম্যাতিউয়ের সাথে। বেশ লম্বা সময় মার্গারিটার সাথে প্রেম ছিলো তার। কিন্তু তারপর সুনীল দেশে ফিরে আসতে বাধ্য হয়েছিলেন। চিঠি যোগে কথা হতো মার্গারিটার সাথে। তারপর একদিন সব বন্ধ। অনেকদিন পর সুনীল জেনেছিলেন তার যৌবণের প্রথম প্রেম চিরদিনের জন্য হারিয়ে গিয়েছে। একদল নিগ্রো মার্গারিটাকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল। তারপর পাওয়া গেছে তার লাশ। জীবেনের সেই বেদনাতুর উপাখ্যানকে কেন্দ্র করে সুনীল লিখেছিলেন, ‘ছবির দেশে কবিতার দেশে’ এবং ‘মার্গারিটা ফুল হয়ে ফুটে আছে’। জীবনের পরিণত পর্যায়ে মার্গারিটাকে একটা চুমু দেওয়ার আক্ষেপ রয়ে গেছে সুনীলের। হয়তো এই মার্গারিটাকে কেন্দ্র করেই সুনীল লিখেছিলেন তার বিখ্যাত কবিতা, ‘কেউ কথা রাখেনি’; মার্গারিটাও তো কথা রাখেনি। কথা তো সুনীলও রাখেননি। চলে গিয়েছেন আমাদের ছেড়ে।
জীবনের সব গল্প বলা যায় না, বাঙালি হলে আরো বলা যায় না বলেই সুনীল তার আত্মজীবনীর নাম দিয়েছিলেন ‘অর্ধেক জীবন’। জীবনের অনেক গল্পই সুনীল আমাদের বলেন নি। তারপরও যা লিখেছেন তা আমাদের বাংলা সাহিত্যকে ঋদ্ধ করেছে। ‘প্রথম আলো’, ‘পূর্ব পশ্চিম’ ‘সেই সময়’ এর মতো দূর্দান্ত সব উপন্যাস বের হয়েছে তার কলম থেকে। বাংলা রোমন্টিক কবিতার জগতে সুনীল কতোটা পরিচিত তা প্রেমিক-প্রেমিকাদের জিজ্ঞেস করলে বুঝতে পারা যায়। কল্পিত নীরাকে কেন্দ্র করে লিখেছেন তিন তিনটি কাব্যগ্রন্থ। তার কাব্যগ্রন্থ ‘হারিয়ে যেও না নীরা’ যেন আমাদের বারবার মনে করিয়ে দেয় মার্গারিটার কথা কিংবা আমাদের ব্যক্তি জীবেনের সেই হারিয়ে যাওয়া প্রেমের কথা যা আমাদের জীবনে দাগ কেটে রেখে গেছে।
নীল লোহিত এবং নীল উপাধ্যায় নামে পরিচিত এই সাহিত্যিক ‘কাকাবাবু’ চরিত্রের স্রষ্টা। তার লেখা গল্প-উপন্যাসের চিত্রনাট্যে নির্মিত হয়েছে একাধিক সিনেমা। কাকাবাবু চরিত্রের চারটি কাহিনি ‘সবুজ দ্বীপের রাজা’, ‘কাকাবাবু হেরে গেলেন?’, ‘মিশর রহস্য’ এবং ‘পাহাড়চূড়ায় আতঙ্ক’ ইত্যাদি উপন্যাসকে কেন্দ্র করে নির্মিত হয়েছে চলচ্চিত্র। ‘হঠাৎ নীরার জন্য’ তার চিত্রনাট্যে নির্মিত আরেকটি চলচ্চিত্র।
জীবনের অর্ধেক বলা গল্প দিয়ে সুনীল আমাদের জীবনে যতোটা দাগ কেটে গেছেন তা অমলিন থেকে যাবে বাঙালির জীবন ও বাংলা সাহিত্যে। তার না বলা কথাগুলো যেন মনে করিয়ে দেয় সেই মার্গারিটার কথা, যে হারিয়ে গেছে একদিন হঠাৎ করে, মনে করিয়ে দেয় সেই স্বাতীর কথা যে সুনীলের জীবনের আরেক নক্ষত্র। অথচ তাকে আমরা ভালো করে জানিনা।
সুনীলের জীবন হয়তো এমন যে মার্গারিটা নক্ষত্রকে আমরা জানি তাকে আমরা চিনি না, যে স্বাতী নক্ষত্রকে আমরা চিনি তাকে আমরা জানি না। এজন্যই হয়তো সুনীল তার আত্মজীবনীর নাম দিয়েছিলেন, ‘অর্ধেক জীবন’; সুনীলের জীবনের কিছুটা আমরা জানি আর অনেকটা জানিনা। না জানার ব্যথা আমাদের দিয়ে আর না জানানোর আক্ষেপ নিজে নিয়ে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ২০১২ সালের ২৩ অক্টোবরে চলে যান না ফেরার দেশে।