‘সব মরণ নয় সমান’। কেউ কেউ মরেও অমর হয়ে থাকেন, অগণিত মানুষের মনে জায়গা করে নেন। এমনই একজন ব্যক্তিত্ব, কালজয়ী শিল্পী বারী সিদ্দিকী। ২০১৭ সালে চলে গেছেন না ফেরার দেশে। কিন্তু আজও বাংলার মানুষ তাঁর স্মৃতিচারণ করে। শুধু কী তাই? লোকগান চর্চা কিংবা এ সংক্রান্ত আলোচনায় বারী সিদ্দিকীর নাম থাকে সামনের কাতারে। এখানেই বোধহয় একজন সৃষ্টিশীল মানুষের সার্থকতা।
লাখো শ্রোতার হৃদয়ের মনিকোঠায় বারী সিদ্দিকী ছিলেন লোকগানের অপার ভাণ্ডারে। একখণ্ড হীরকের মতো জ্বলজ্বলে। শুধু কণ্ঠশিল্পী হিসেবে নয়, বাঁশির জাদুকরী সুর তোলার ক্ষেত্রেও বারী সিদ্দিকী ছিলেন অতুলনীয়।
১৯৯৯ সালে হুমায়ূন আহমেদের ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’ ছবিতে গান গেয়ে সংগীতশিল্পী হিসেবে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন দীর্ঘদিন ধরে বাঁশি বাজানো বারী সিদ্দিকী। এরপর বেশকিছু গান গেয়ে তিনি পৌঁছে যান সব শ্রেণির শ্রোতার কাছে। তার গাওয়া জনপ্রিয় গানগুলোর মধ্যে রয়েছে ‘সুয়াচান পাখি আমি ডাকিতাছি তুমি ঘুমাইছ নাকি’, ‘পুবালি বাতাসে’, ‘আমার গায়ে যত দুঃখ সয়’, ‘ওলো ভাবিজান নাউ বাওয়া’, ‘মানুষ ধরো মানুষ ভজো’ ইত্যাদি।
বারী সিদ্দিকীর জন্মদিবস আজ। প্রখ্যাত এই সংগীতশিল্পী ১৯৫৪ সালের ১৫ নভেম্বর নেত্রকোনা জেলার এক সংগীতজ্ঞ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। শৈশবে পরিবারের কাছেই গান শেখায় হাতেখড়ি। মাত্র ১২ বছর বয়সেই নেত্রকোনার শিল্পী ওস্তাদ গোপাল দত্তের অধীনে আনুষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ শুরু হয় তার। তিনি ওস্তাদ আমিনুর রহমান, দবির খান, পান্নালাল ঘোষসহ অসংখ্য গুণী শিল্পীর সরাসরি সান্নিধ্য লাভ করেন।
ওস্তাদ আমিনুর রহমান একটি অনুষ্ঠানে গান গাওয়ার সময় বারি সিদ্দিকীকে দেখে আরও প্রশিক্ষণ নেওয়ার প্রস্তাব দেন। এরপর, ছয় বছর ওস্তাদ আমিনুর রহমানের অধীনে প্রশিক্ষণ নেন তিনি। সত্তরের দশকে জেলা শিল্পকলা একাডেমির সঙ্গে যুক্ত হন বারী।
ওস্তাদ গোপাল দত্তের পরামর্শে ধ্রুপদী সংগীতে পড়াশোনা শুরু করেন বারী সিদ্দিকী। পরবর্তী সময়ে বাঁশির প্রতি বেশি আগ্রহী হয়ে ওঠায় তিনি বাঁশির ওপর উচ্চাঙ্গসংগীতের প্রশিক্ষণ নেন। নব্বইয়ের দশকে ভারতের পুনে গিয়ে পণ্ডিত ভিজি কার্নাডের কাছে তালিম নেন। দেশে ফিরে লোকগীতির সঙ্গে ধ্রুপদী সংগীতের সম্মিলনে গান গাওয়া শুরু করেন।
বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক ও শিক্ষাবিদ অধ্যাপক যতীন সরকার বলেছেন, ‘বারী সিদ্দিকী শুধু একজন শিল্পী ছিলেন না, তিনি ছিলেন বাউল সাধক ও লোকগানের একজন বাহক। তিনি প্রতিটি লোকগানের মূলে প্রবেশ করেছিলেন এবং তা আমাদের সহজ-সরল ভাষায় বলে গেয়ে উপলব্ধি করাতে শিখিয়েছেন।’
বাউলশিল্পীদের গানকে এ প্রজন্মের কাছে জনপ্রিয় করে তুলতে বারী সিদ্দিকীর ভূমিকা অসামাম্য। আজ জন্মদিবসে এই গুণী শিল্পীর প্রতি অজস্র শ্রদ্ধা। মৃত্যু তাকে পরাজিত করতে পারেনি, ভক্তদের ভালোবাসাই শিল্পী বারী সিদ্দিকীকে বাঁচিয়ে রাখবে আজীবন।