বিপ্লবের সোনালী যুগে ১৯০৮ সালের ১১ ই আগস্ট ফাঁসি হয়েছে ক্ষুদিরামের। ঠিক তার তিন মাস পরে ১০ ই নভেম্বর। ফাঁসির মঞ্চে কানাইলাল দত্ত কানাইলাল দত্ত (ইংরেজি: Kanailal Dutt; ৩১ আগস্ট ১৮৮৮ – ১০ নভেম্বর ১৯০৮)। সিপাহীর হাতে মুখ ঢাকবার কালো কাপড়। ভুবনভোলানো হাসিটা তার দিকে ছুঁড়ে দিয়ে কানাইলাল বললেন, "No no don't blacken my face, please!" সদ্যস্নাত কানাইলাল সেই মুহূর্তে আরও শানিত, আরও দৃপ্ত, আরও নির্মল, আরও প্রফুল্ল হাসিখুশি!
ফাঁসির মঞ্চের পেছনে দাঁড়িয়ে ইংরেজ অফিসার ইথান প্রাইস। প্রাইসের স্নায়ু যেন এবার দুর্বল হয়ে পড়ছে। ফাঁসির মঞ্চে এ রকম অনুরোধ! কমিশনার হ্যালিডেও উপস্থিত। তিনি জানালেন, আসামির ইচ্ছাকে মান্যতা দিতে। তার হাসিমাখা মুখ কালো কাপড়ে না ঢেকেই গলায় ফাঁসির দড়ি পরানো হলো।
"It doesn't feel right."
চমকে তাকালেন হ্যালিডে। কানাইলাল গলার ফাঁসির দড়িটা ঠিকঠাক করে পরে নিচ্ছেন।
এবার সরাসরি প্রাইসকে বললেন, "Mister Prise, Are you there?"
আর কত নিয়ন্ত্রণ রাখা যায় নিজের স্নায়ুর ওপর। মাথা নিচু করে কানাইলালের চোখের থেকে চোখ সরালেন প্রাইস।
"You wanted to see me, right? How do you find me now?"
গতকাল সন্ধ্যাতেও কানাইয়ের মুখে এই মিষ্টি হাসি দেখেছিলেন প্রাইস। তখন বলেছিলেন, "কানাই, আজ তুমি হাসছো কিন্তু আগামীকাল দেখব। মরণের ছায়া তোমার হাসিভরা ঠোঁটকে ম্লান করে দেবে।" অথচ! আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলেন না ইথান প্রাইস। হাঁটা দিলেন জেল অফিসের দিকে।
দাদা আশুতোষ দত্ত, মতিলাল ব্যানার্জিদের হাতে মৃতদেহ তুলে দেওয়ার সময় প্রাইস জিজ্ঞাসা করেছিলেন, "আপনারা কানাইলাল দত্তর মত আর কতজন রয়্যাল বেঙ্গল টাইগারের জন্ম দিয়েছেন এই বাংলায়?"
বিপ্লবী বারিন্দ্র ঘোষ লিখেছেন, "ফাঁসির পূর্বদিন সন্ধ্যার সময় উঠানে বেড়াতে বাহির হইয়া সে আমার এবং অনেকের কুঠুরির সামনে দাঁড়াইয়া স্মিত হাস্যে বিদায় নমস্কার করিয়াছিল। সে সহাস্য প্রসন্ন জ্যোতির্ময় রূপ আমি কখনও ভুলিব না। কানাই তখন মহা তাপস, প্রকৃত সর্বত্যাগী সন্ন্যাসী।"
বিপ্লবী উপেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, "মুখে চিন্তার রেখা নাই, বিপদের ছায়া নাই, চাঞ্চল্যের লেশমাত্র নাই। প্রফুল্ল কমলের মত তাহা যেন আপনার আনন্দে আপনিই ফুটিয়া রহিয়াছে।"
১৮৮৮ সালের ৩১ আগস্ট (মতান্তরে ৩০ আগস্ট)হুগলি জেলার চন্দননগরে জন্ম হয় কানাইলাল দত্তের। জন্মাষ্টমীর দিন জন্ম বলে কানাইলাল নামকরণ। বাবা চুনিলাল দত্ত ছিলেন সরকারি কর্মচারী। বাবার কর্মসূত্রে ছোটবেলায় তিনি বম্বে চলে যান। ফিরে এসে চন্দননগর ডুপ্লে কলেজে ভর্তি হন। হুগলি মহসিন কলেজ থেকে বি এ পাস করেন।
আলিপুর বোমা মামলায় গ্রেপ্তার করা হয় কানাইলাল দত্তকে।অরবিন্দ ঘোষ, বারীন্দ্রনাথ ঘোষ, বিভূতিভূষণ সরকার, উপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, ইন্দুভূষণ রায়, উল্লাসকর দত্ত, হেমচন্দ্র কানুনগো সহ আরো অনেকে গ্রেপ্তার হন। পরবর্তীতে গ্রেপ্তার হন নরেন গোঁসাই। এর পরেই ঘটল বিপত্তি। নরেন গোঁসাই রাজসাক্ষী হয়ে গেল। জেলে তার থাকার জায়গাও হল আলাদা। ১লা সেপ্টেম্বর পরবর্তী শুনানির দিন। কোর্টে নরেন সব বলে দিলে আরও অন্তত কুড়ি জন গ্রেফতার হবে। অরবিন্দ ঘোষ সহ অনেকেরই মৃত্যুদণ্ড অথবা আন্দামানের সেলুলার জেল নিশ্চিত। সত্যেন বোস এবং কানাইলাল মিলে ঠিক করলেন গোঁসাইকে সে সুযোগ দেওয়া হবে না। সত্যেন বোস টোপ দিলেন তিনি রাজসাক্ষী হতে চান। টোপ গিলল ইংরেজ। তিনি তখন জেল হাসপাতালে। পেটে ব্যথার অভিনয়ে কানাইলালও ভর্তি হলেন জেল হাসপাতালে। বাইরে থেকে আনানো হল রিভলভার। ৩১ আগস্ট। ঘরের মধ্যে রাজসাক্ষী হওয়ার ব্যাপারে নরেন গোঁসাইয়ের সঙ্গে কথা বলছেন সত্যেন বোস। বাইরে কানাইলাল দত্ত। ফায়ার করলেন সত্যেন। গুলিবিদ্ধ নরেন দৌড়ে পালাতে গেলে পিছন থেকে তাড়া করে ফায়ার করলেন কানাইলাল।
কোর্টে কানাইলাল কে জিজ্ঞাসা করা হল পিস্তল কোথায় পেয়েছিলে। উত্তরে বললেন -"ক্ষুদিরামের আত্মা পিস্তল দিয়ে গেছে।" শোনা যায় কাঁঠালের মধ্যে পিস্তল আনানো হয়েছিল। বিচারে দুজনেরই মৃত্যুদণ্ড হল। এই সময়ে ১৬ পাউন্ড ওজন বেড়েছিল কানাইলালের। মৃত্যুদণ্ডের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপিল করতে বললে তার উত্তরে তিনি বললেন -"There shall be no appeal." একথা শুনে আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় বলেছিলেন -"কানাই shall আর will এর যথাযথ ব্যবহার শিখিয়ে দিয়ে গেল হে।"
মৃত্যুর পরেও যাতে তার বিপ্লবী জীবন ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে ভূমিকা পালন করতে পারে তাই তিনি শেষ ইচ্ছা হিসেবে বললেন, "তার মৃতদেহ নিয়ে যেন শোক না করা হয়, যেন শোভাযাত্রা হয়।" ১০ ই নভেম্বর সেন্ট্রাল জেল থেকে কেওড়াতলা মহাশ্মশান পর্যন্ত লোকে লোকারণ্য। এই ঘটনার পর বিপ্লবীদের মরদেহ নিয়ে শোভাযাত্রাই বন্ধ করে দিল ইংরেজ।
ফাঁসির আগে দাদা আশুতোষ দত্ত কানাইয়ের কাছে তার চশমাটা চেয়ে ছিলেন। উত্তরে দাদা কে বলেছিলেন -"চশমাটা মৃত্যুর পর নিও। চশমা না পরে ফাঁসির মঞ্চে হোঁচট খেলে ইংরেজ ভাববে ভয় পাচ্ছি।"
আজও চশমাটা রাখা আছে কানাইলাল বিদ্যামন্দিরে।