পাবলো নেরুদা, প্রকৃত নাম রিকার্দো এলীসার নেফতালি রিয়েস বাসোয়ালতো। তিনি তাঁর বাবার কাছ থেকে নিজেকে লুকানোর জন্য পাবলো নেরুদা ছদ্মনাম গ্রহন করেছিলেন যাতে তাঁকে কেউ কাব্যচর্চায় বাধা দিতে না পারে। তাঁর বাবা নেরুদার কাব্যচর্চায় ত্যক্তবিরক্ত ছিলেন। অথচ সেই নেরুদাই ১৯৭১ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার জিতে নেন। তিনি একজন চিলিয় কবি, কুটনীতিবিদ ও রাজনীতিবিদ ছিলেন। তাঁকে চিলির জাতীয় কবিও বলা হয়।
নেরুদা মাত্র তেরো বছর বয়েসে কবি হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন যখন তিনি বিভিন্ন ধরণের কবিতা লিখতে শুরু করেন। এর মধ্যে ছিল পরাবাস্তববাদী কবিতা, ঐতিহাসিক মহাকাব্য, প্রকাশ্য রাজনৈতিক ইশতেহার, গদ্য আত্নজীবনী এবং ভালোবাসার কবিতা যা তাঁর ১৯২৪ সালে প্রকাশিত বিশটি ভালোবাসার কবিতা ও একটি মন খারাপের গান শীর্ষক কাব্যগ্রন্থ থেকে গৃহীত। কিংবদন্তি এই কবির শতসহস্র সাহিত্য কীর্তি বিশ্বের বহু ভাষায় অনুদিত হয়েছে। তাঁকে বলা হয় কবিদের কবি। বিপ্লবী আর্নেস্তো চে গুয়েভারা তাঁর কবিতার প্রেমী ছিলেন।
প্রাথমিক জীবন
পাবলো নেরুদা সান্তিয়াগোর ৩৫০ কি.মি দক্ষিণে চিলির লিনারেস প্রদেশের অন্তর্গত পারাল -এ ১৯০৪ সালের ১২ই জুলাই জন্মগ্রহণ করেন। মোরেলসের মতে, একজন রেলওয়ে কর্মী, রোজা অপ্যাজো ও একজন স্কুল শিক্ষক যিনি তাঁর জন্মের দুমাস পর মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর মৃত্যুর পর পরই রিয়েস তিমুকোতে পাড়ি জমান। তিনি সেখানে মালভারদে নামক একটি মহিলাকে বিয়ে করেন, যার কাছে তাঁর পূর্বে নয় বছর বয়েসি রোদোলফো নামক একজন ছেলে ছিল। নেরুদা তিমুকোতে রোদোলফো ও তাঁর বোন লরিতার সাথে বেড়ে ওঠেন। লরিতা ছিল তাঁর বাবার বিয়েবহির্ভূত প্রেমিকা অরেলার মেয়ে। নেরুদা কোনো ধর্মে বিশ্বাসী ছিলেন। মুক্তমনা এই কবি তাঁর প্রথম দিকের কবিতাগুলি ১৯১৪ সালের শীতকালে রচনা করেছিলেন।
ব্যক্তিগত জীবন
নেরুদা ব্যক্তিগত জীবনে পরপর মারজিকে এন্তোনিতা, দালিয়া দেল ও মাতিলদের সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। তাঁদের সবার-ই বিবাহবিচ্ছেদ হয়। তাঁর একমাত্র কন্যাসন্তান ছিলেন মালভা ম্যারিনা।
সাহিত্যিক জীবন
নেরুদার বাবা তাঁর লেখালিখি ও সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনার বিরোধিতা করলেও নোবেল পুরস্কার বিজয়ী গ্যাব্রিয়েলা মিস্ট্রালদের মতো আরও অনেকজন থেকে সহযোগিতা পেয়েছে। ১৯১৭ সালের ১৮ই জুলাই তাঁর প্রথম লিখা আন্তরিকতা ও অধ্যবসায় মাত্র তেরো বছর বয়েসে দৈনিক সংবাদপত্র লা মানানা-তে প্রকাশিত হয়। ১৯১৮ থেকে ১৯২০ সাল পর্যন্ত তাঁর বহু কবিতা প্রকাশ পায়। ১৯১৯ সালে তিনি সাহিত্য প্রতিযোগিতায় যোগ দেন আর সেখানে তিনি তৃতীয় স্থান অধিকার করেন। ১৯২১ সালে শিক্ষক হওয়ার অভিপ্রায়ে নেরুদা চিলি বিশ্ববিদ্যালয়ে ফরাসি পড়তে যান। দিন-রাত এক করে তিনি সাহিত্য ও কবিতা লিখায় মন দেন। পরে তিনি একজন সফল আন্তর্জাতিক কবি হওয়ার খ্যাতি অর্জন করেন।
কুটনৈতিক ও রাজনৈতিক জীবন
চিলিতে ফেরার পর নেরুদাকে বুয়েনস এয়ারস-এ কুটনৈতিক পদ দেওয়া হয়েছিল, পরে স্পেনের বার্সেলোনায়। পরবর্তীতে তিনি মাদ্রিদে সাহিত্যের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে কাজ করেন। তাঁর একমাত্র কন্যা মালভা ম্যারিনা মাদ্রিদে জন্মগ্রহণ করেছিল। ছোট থেকেই তাঁর রোগব্যাধি থাকায় মাত্র নয় বছরে তাঁর কন্যা মারা যান। পরবর্তীতে তিনি সাহসী সাম্যবাদী ও বামপন্থী হিসেবে জীবন কাটিয়ে দেন। ১৯৪৫ সালের ৪ঠা মার্চ নেরুদা অ্যান্তোফাগাস্তা ও তারাপাসা -এর উত্তর প্রদেশের সাম্যবাদী সিনেটর হিসেবে নির্বাচিত হন। সরকারিভাবে তিনি চার মাস পর সাম্যবাদী দলে যোগ দেন।
কর্মময় জীবন শেষে মৃত্যু
নেরুদা তাঁর জীবদ্দশায় বিভিন্ন দেশে বহু কুটনৈতিক পদে বহাল ছিলেন এবং চিলিয় সাম্যবাদী দলের সিনেটর হিসেবে নিজেকে নিয়োজিত রাখেন। রাষ্ট্রপতি গ্যাব্রিয়েল ভিদেলা যখন চিলিতে ১৯৪৮ সালে সাম্যবাদী বন্ধের ডাক দিয়ে নেরুদার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন। বন্ধুরা তাঁকে ভালপারাইসোর বন্ধর শহরে একটি ঘরের ভিতর লুকিয়ে রাখেন। সেখান থেকে নেরুদা পাহাড়ের উপর দিয়ে মাইহু হ্রদ অতিক্রম করে আর্জেন্টিনায় পালিয়ে যান। বছর কয়েক পর নেরুদা চিলির সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রপতি সালভাদর আয়েন্দের সাহচর্যে আসেন। নেরুদা নোবেল পুরস্কার গ্রহণের পর যখন তিনি চিলিতে ফেরত আসেন, তখন আয়েন্দে তাঁকে এস্তাদিও নেশনালে (ন্যাশনাল স্টেডিয়াম) সত্তর হাজার লোকের সম্মুখে বক্তব্য রাখার আমন্ত্রণ জানান। অগাস্তো পিনোশের শাসনামলে নেরুদা ১৯৭৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ক্যান্সারে আক্রান্ত হন। তাঁর মনে হয়েছিল কোনো এক ডাক্তার পিনোশের আদেশে তাঁকে ইঞ্জেকশনের মাধ্যমে হত্যা করার পরিকল্পনা করেছে।
নেরুদা ১৯৭৩ সালের ২৩শে সেপ্টেম্বর তাঁর নিজ বাড়িতে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। অনেকে মনে করেন, তাঁকে স্পষ্টত ওইভাবে পরিকল্পনা করে হত্যা করা হয়েছে।
কিংবদন্তি নেরুদার মৃত্যুতে স্বাভাবিকভাবেই সারাবিশ্বে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে। নেরুদার জনপ্রিয়তার কারণে ভয়ে ভীত পিনোশে তাঁর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া জনসমক্ষে করার অনুমতি দেননি। কিন্তু হাজারও শোকার্ত চিলিয়রা তাঁর আদেশ অমান্য করে পথে ভিড় জমান। নেরুদাকে প্রায়ই চিলির জাতীয় কবি হিসেবে ধরা হয় এবং তাঁর সাহিত্যকর্মগুলি বিশ্বজুড়ে বেশ জনপ্রিয়তা পায়। কলম্বিয়ার ঔপন্যাসিক গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ একদা তাঁকে বিংশ শতাব্দীর সকল ভাষার মহান কবি হিসেবে আখ্যায়িত করেন। অর্থাৎ, তিনি ছিলেন কবিদেরও কবি।