সুচিত্রা সেন: রোমান্টিকতা সৃষ্টির জন্য বাংলা চলচ্চিত্রের মহানায়িকা

দ্য রিপোর্ট ডেস্ক

জানুয়ারি ১৭, ২০২৩, ০৬:২৪ পিএম

সুচিত্রা সেন: রোমান্টিকতা সৃষ্টির জন্য বাংলা চলচ্চিত্রের মহানায়িকা

সুচিত্রা সেন। নামটি শুনলেই চোখের সামনে ভেসে আসে তাতের শাড়ি পড়া, কপালে টিপ ও মাঝ বরাবর সিঁথি করা লম্বাটে গড়নের এক যুবতী নারী। বাংলা চলচ্চিত্রের অভিনয় ও ভাব-ভঙ্গিতে নতুন ধারার সৃষ্টি করে বাঙালি হৃদয় জয় করেছেন তিনি। 

ভারতের কিংবদন্তি এই অভিনেত্রী মূলত বাংলা ও হিন্দি চলচ্চিত্রে অভিনয় করে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। তিনিই প্রথম ভারতীয় অভিনেত্রী যিনি কোনো আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে পুরস্কৃত হয়েছিলেন। রূপালি পর্দার উত্তম-সুচিত্রা জুটি আজও তুমুল দর্শকপ্রিয়। এ কারণে উত্তমকে বলা হয় মহানায়ক আর সুচিত্রাকে বলা হয় মহানায়িকা।

জন্ম ও পরিবার

মহানায়িকা সুচিত্রা জন্মসূত্রে বাংলাদেশি। ১৯৩১ সালের ৬ এপ্রিল পাবনা জেলার সদর পাবনায় সুচিত্রা সেন জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তাঁর বাবার বাড়ি সিরাজগঞ্জ জেলার বেলকুচি থানার অন্তর্গত সেন ভাঙ্গাবাড়ী গ্রাম। জন্মের পরপরই তাঁর নাম রাখা হয়েছিল রমা দাশগুপ্ত। সেই রমাই একদিন উপমহাদেশের রূপালি পর্দার ঝলমলে দুনিয়া শাসন করেছিলেন।

সুচিত্রার বাবা করুণাময় দাশগুপ্ত ছিলেন স্থানীয় বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ও মা ইন্দিরা দেবী ছিলেন গৃহবধূ। তিনি ছিলেন পরিবারের পঞ্চম সন্তান ও তৃতীয় কন্যা।সুচিত্রা সেন পাবনা শহরেই পড়াশোনা করেছিলেন। তিনি ছিলেন কবি রজনীকান্ত সেনের নাতনী।

বিয়ে ও চলচ্চিত্রে অভিনয় শুরু

১৯৪৭ সালে বিশিষ্ট শিল্পপতি আদিনাথ সেনের পুত্র দিবানাথ সেনের সঙ্গে সুচিত্রা সেনের বিয়ে হয়। তাদের একমাত্র কন্যা মুনমুন সেনও একজন খ্যাতনামা অভিনেত্রী। ১৯৫২ সালে সুচিত্রা সেন বাংলা চলচ্চিত্র জগতের সাথে যুক্ত হন।

মহানায়ক উত্তম কুমারের সঙ্গে পর্দায় উপস্থিতি কম থাকলেও বাস্তবে সুচিত্রা সেন তাঁর সাথে প্রণয়ের বন্ধনে আবদ্ধ ছিলেন।

প্রথম ছবি

সুচিত্রা সেনের প্রথম ছবিটি মুক্তি পায়নি। ১৯৫২ সালে শেষ কোথায়’ ছবির মাধ্যমে তাঁর চলচ্চিত্রে যাত্রা শুরু হয়। সুচিত্রা উত্তম কুমারের বিপরীতে ‘সাড়ে চুয়াত্তর’ ছবিতে প্রথম অভিনয় করেন।

রোমান্টিকতার সূচনা

১৯৫৫ সালের ঘটনা। নতুন রোমান্টিক জুটি নিয়ে তৈরী হয়েছিল ‘অগ্নিপরীক্ষা’। সেই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছিল উত্তম-সুচিত্রা জুটি। ষ্টার হওয়ার জন্য প্রতিভার সাথে থাকতে হয় গ্ল্যামার। গ্ল্যামার আবার দু’জনেরই থাকতে হবে। দুজনের ঘনিষ্টমুহূর্তগুলো হতে হবে গ্ল্যামারাস। উত্তম-সুচিত্রা জুটির মধ্যে প্রথম বাঙালি পায় প্রেমের নতুন রসায়ন। সিনেমা হলেই বাঙালি দর্শক দেখতে শুরু করে সুচিত্রা সেনের অতলস্পর্শী রোমান্টিক চাহনি আর উত্তমের দ্বিধাহীন নিবিড় আলিঙ্গন। আর এই দৃশ্য বাঙালি তরুণীদের করে তোলে বোহেমিয়ান।

এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাঁকে। ছবিটি বক্স-অফিসে সাফল্য লাভ করে এবং উত্তম-সুচিত্রা জুটি একের পর এক হিট ছবি উপহার দিতে থাকেন তারা। বাংলা ছবির এই অবিসংবাদিত জুটি পরবর্তী ২০ বছরে ছিলেন আইকন স্বরূপ।

উত্তম-সূচিত্রার রসায়ন

১৯৬১ সালের পর পর্দায় তেমন উপস্থিতি না থাকলে ব্যক্তিজীবনে উত্তম-সুচিত্রা খুব কাছাকাছি ছিলেন। তাদের জুটি হিসেবে করা ৩০টি ছবিতে কখনোই তাদেরকে স্বাভাবিক মনে হয়নি। সিনেমাপাড়া থেকে শুরু করে নিজের মেয়ে মুনমুন সেনও জানতেন তাদের প্রণয়ের কথা।

প্রখ্যাত চিত্রপরিচালক সত্যজিৎ রায়ের একটি আলোচিত মন্তব্যে উত্তম-সুচিত্রার সম্পর্কটি বেশ জোরালোভাবে টালিউড পাড়ায় চর্চিত হয়। উত্তম কুমার বলেছিলেন, “পৃথিবীতে খুব কম জুড়ি আছে যাদের মধ্যে বন্ডটা এত ম্যাজিকাল।” তিনি প্রযোজকদের উত্তমকুমারের উপরে তার নাম লিখতে বাধ্য করেছিলেন। সকলে সেটা মেনেও নিয়েছিল।

১৯৫৪ সালে উত্তম কুমারের সঙ্গে অগ্নিপরীক্ষা ছবি নিয়েও হইচই পড়ে গিয়েছিল। ছবির পোস্টারে অটোগ্রাফ দিয়ে সুচিত্রা লেখেন, 'আমাদের প্রণয়ের সাক্ষী হল অগ্নিপরীক্ষা।’ প্রায় সাত দশক পেরিয়ে গেলেও এমন কাজ এখনকার কোনও অভিনেতা বা অভিনেত্রী করতে হয়তো সাহস পাবেন না নিঃসন্দেহে বলা যায়।  কিন্তু সুচিত্রা সেন এই দুঃসাহস দেখিয়েছিলেন।

এই ঘটনার পর উত্তমের সাংসারিক জীবনে প্রবল অশান্তির খবরও ফলাও করে লেখা হয়েছিল ওই সময়ের বিভিন্ন প্রিন্ট মিডিয়ায়। উত্তমের স্ত্রী গৌরী দেবী মানসিকভাবে অত্যন্ত ভেঙে পড়েছিলেন। অপরদিকে, স্বামী দিবানাথের সঙ্গে মন কষাকষি শুরু হয় সুচিত্রার। একে দর্শকের চরম বিশ্বাস এবং ফিল্ম পত্রিকার নানা খবর, তার পর এই ঘটনা চাপা গুঞ্জনকে সমবেত কণ্ঠে পরিণত করে।

বলা হয়ে থাকে, উত্তম কুমারের সাথে সুচিত্রার প্রেমের সম্পর্কের কারণে সংসারে ভাঙন ধরেছিল। ১৯৬৩ সাল থেকে সুচিত্রা স্বামী দিবানাথের কাছ থেকে আলাদা হন। তাদের মধ্যে ডিভোর্স হয়নি কখনো। সবশেষ আমেরিকার পাড়ি জমান দিবানাথ।

পুরষ্কার ও সম্মামনা

১৯৫৫ সালের ‘দেবদাস’ ছবির জন্য সুচিত্রা শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রীর পুরস্কার জিতেন, যা ছিল তার প্রথম হিন্দি ছবি। উত্তম কুমারের সাথে বাংলা ছবিতে রোমান্টিকতা সৃষ্টি করার জন্য তিনি বাংলা চলচ্চিত্রের সবচেয়ে বিখ্যাত অভিনেত্রী।

১৯৬৩ সালে ‘সাত পাকে বাঁধা’ চলচ্চিত্রে অভিনয়ের জন্য মস্কো চলচ্চিত্র উৎসবে সুচিত্রা সেন সিলভার প্রাইজ ফর বেস্ট অ্যাকট্রেস জয় করেন।

১৯৭২ সালে ভারত সরকার তাঁকে পদ্মশ্রী সম্মান প্রদান করে। শোনা যায়, ২০০৫ সালে তাঁকে দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার দেওয়ার প্রস্তাব রাখা হয়েছিল। কিন্তু সুচিত্রা সেন জনসমক্ষে আসতে চান না বলে সেই পুরস্কার তখন গ্রহণ করেননি তিনি। ২০১২ সালে তাঁকে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সর্বোচ্চ সম্মাননা বঙ্গবিভূষণ প্রদান করা হয়।

অভিনয়ের স্বর্ণযুগ

১৯৬০ ও ১৯৭০ দশকে সুচিত্রা সেন অভিনীত সবকটি ছবিই ব্যবসা সফল। স্বামী মারা যাওয়ার পরও তিনি অভিনয় চালিয়ে গেছেন। এদের মাঝে ছিল হিন্দি ছবি আন্ধি’। এই চলচ্চিত্রে তিনি একজন নেত্রীর ভূমিকায় অভিনয় করেছেন। বলা হয় যে চরিত্রটির প্রেরণা এসেছে ইন্দিরা গান্ধী থেকে।

‘আন্ধি ছবির জন্য তিনি ফিল্মফেয়ার শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী হিসেবে মনোনয়ন পেয়েছিলেন এবং তার স্বামী চরিত্রে অভিনয় করা সঞ্জীব কুমার শ্রেষ্ঠ অভিনেতার পুরস্কার জিতেছিলেন।

অবসর

১৯৭৮ সালে সুদীর্ঘ ২৫ বছর অভিনয়ের পর তিনি চলচ্চিত্র থেকে অবসরগ্রহণ করেন। এর পর তিনি লোকচক্ষু থেকে আত্মগোপন করেন এবং রামকৃষ্ণ মিশনের সেবায় ব্রতী হন। উত্তম কুমারের মৃত্যু ভীষণভাবে নাড়িয়ে দেয় সুচিত্রা সেনকে। ১৯৮০ সালের ২৪ জুলাই উত্তম কুমারের মৃত্যু হলে গভীর রাতে প্রিয় মানুষটিতে দেখতে যান ইতিমধ্যে লোকচক্ষুর আড়ালে চলে যাওয়া সুচিত্রা।

মৃত্যু

মহানায়ক উত্তম কুমারের মৃত্যুর পর আরও ৩৪ বছর এভাবেই লোকচক্ষুর অন্তরালে থেকে না ফেরার দেশে পাড়ি জমান সুচিত্রা সেন। ২০১৪ সালের ১৭ জানুয়ারি ভারতীয় সময় সকাল ৮টা ২৫ মিনিট নাগাদ কলকাতার বেল ভিউ হাসপাতালে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে এ কিংবদন্তি শিল্পীর মৃত্যু হয়। 

Link copied!