স্যাম ওয়ালটন ,যিনি খুচরা ব্যবসাকে রীতিমত শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিলেন । ১৯৮২ থেকে ১৯৯২ সালে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ওয়ালটন ছিলেন বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি ছিলেন। ১৯৯২ সালে তার মৃত্যুর পরই বিল গেটস ধনীর তালিকার ১ নম্বরে আসতে পেরেছিলেন। বিশ্বের সবচেয়ে ধনী হওয়ার পথে স্যাম ওয়ালটন এমন একটি কোম্পানী প্রতিষ্ঠা করেছিলেন যা খুচরা ব্যবসার চেহারাই পাল্টে দিয়েছিল। আজ এই হার না মানা ব্যক্তির ২৯ তম মৃত্যুবার্ষকিী।
পুরো নাম স্যামুয়েল মুর ওয়ালটন। ওকলোহামার কিংফিশার এলাকায় ১৯১৮ সালের ২৯ মার্চ তার জন্ম। শৈশবে তিনি অর্থকষ্টের মধ্যে বড় হয়েছেন। তার বাবার ছিল একটি খামার। কিন্তু তা থেকে যথেষ্ট আয় না হওয়ায় সেটা বন্ধক রেখে বিভিন্ন জায়গায় পরিবার নিয়ে ঘুরেছেন তার বাবা। শেষ পর্ন্ত কলম্বিয়ার মিসৌরিতে তারা থিতু হন। দুধ বিক্রি, হকারসহ নানা ধরনের কাজ করেছেন স্কুলে থাকাকালীন। শত প্রতিকূলতার মধ্যেও তিনি অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন ইউনিভার্সিটি অব মিসৌরি থেকে।
ভালো লাগেনি চাকরি
পড়াশুনা শেষ করে তিনি একটি দোকানের সেলসম্যানের চাকরি নেন। চাকরিতে তিনি ভালোই করছিলেন। সেখানে বেতন পেতেন মাসে ৭৫ ডলার। কিছুদিন চাকরি করার পর ১৯৪২ সালে তিনি সেখান থেকে ইস্তফা দেন। স্বাধীন কিছু করার। ইচ্ছে থেকে ব্যবসা শুরু করেন।
সেই সময় ‘বেন ফ্রাঙ্কলিন’ খুবই জনপ্রিয় চেইন শপ ছিল। ১৯৪৫ সালে তিনি সেই চেইনশপের একটি দোকানের ফ্র্যাঞ্চাইজি ভাড়া নেন কয়েক বছরের জন্য। মাত্র তিন বছরের মধ্যে আরকানসের নিউ পোর্ট এলাকার দোকানটি থেকে মাসে আয় হতে লাগল আশি হাজার ডলারের কাছাকাছি।
১৯৫০ ওয়ালটন শহর থেকে দূরে আরকানসের বেনটনভিলে সালে বেন ফ্রাঙ্কলিনের আরেকটি চেইন খুললেন। ১৯৫৪ সালে ওয়ালটন তার ভাইকে সঙ্গে নিয়ে খুলে ফেললেন আরও একটি শাখা। এরপর ঠিক করলেন আর ভাড়া নয় এবার নিজেই কিনে নেবেন দোকান।
ওয়ালমার্ট
আগের অভিজ্ঞতা থেকে তিনি উপলব্ধি করেন বড় শহরের বড় বড় প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা যাবে না। তাই তিনি বেছে নেন ছোট শহরগুলোকে। ৪২ বছর বয়সে আরকানসাস অঙ্গরাজ্যে আরকানসাস অঙ্গরাজ্যে তিনি প্রতিষ্ঠা করলেন ওয়ালমার্ট। সেটা ১৯৬২ সালে। ওয়ালমার্টের প্রথম শাখা আরকানসাসের আউটপোস্টে সফলতা পেলে কানসাস সিটিতে আরেকটি আউটপোস্ট চালু করেন তিনি। এক বছরের মধ্যে তিনি মোট ১৬টি দোকান চালু করেন আর এই সবগুলোকে একটি চেইনের আওতায় নিয়ে আসলেন। নাম দিলেন ‘ওয়ালমার্ট ডিসকাউন্ট সিটি স্টোর’। তারপর আর তাকে পিছু ফিরে তাকাতে হয়নি। সফলতার একের পর এক ধাপ পেরিয়েছেন। স্থাপন করেছেন নজিরবিহীন ইতিহাস। ১৯৯২ সালে ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে মারা যান ওয়ালটন। তার আগ পর্যন্ত তিনি ছিলেন বিশে^র সেরা ধনী। ব্যক্তিগত জীবনে চার সন্তানের জনক ওয়ালটন। এর মধ্যে জন থমাস নামে এক ছেলে ২০০৫ সালে বিমান দুর্ঘটনায় মারা যায়।
বর্তমানে এমন কোনো জিনিস নেই যেটা ওয়ালমার্টে পাওয়া যায় না। ২০১৬ সালের জুন পর্যন্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ১৪.৭ শতাংশ মুদি মালামাল একাই বিক্রি করেছে ওয়ালমার্ট। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী বিক্রি করেছে ৭ শতাংশ।
প্রচণ্ড রকম মেধাবী ও বিনয়ী ওয়ালটন প্রতিনিয়ত শিখেছেন। দোকানকে জনপ্রিয় করতে তিনি বেছে নিতেন নানা ধরনের কৌশল। যেমন বিভিন্ন বিক্রয় সম্পর্কিত সেমিনারে তিনি প্রতিনিয়তই যেতেন। সেখান থেকে যা শিখতেন তা তার ব্যবসায় কাজে লাগাতেন। পড়তেন ব্যবসার ওপর বিভিন্ন বই। একবার এক দোকানের সামনে বসিয়েছিলেন পপকর্ন আর আইসক্রিমের মেশিন। এতে করে প্রচুর মানুষ ভিড় করত। সেই সঙ্গে তিনি পণ্য বিক্রিও করতে লাগলেন অন্য দোকানের থেকে অনেক কম দামে। এর ফলে বিক্রি হতো বেশি। এতো কম দাম আর বিভিন্ন ডিসকাউন্ট অফারের কারণেই এক সময় শহরের সব থেকে জনপ্রিয় চেইনশপে পরিণত হয়ে গেল ওয়ালমার্ট। বর্তমানে বিশ্বের ২৭টা দেশে এর প্রায় ১১ হাজার ৩০০ স্টোর রয়েছে। তবে সব দেশে ওয়ালমার্ট নামে স্টোর নেই। ৫৮টি ভিন্ন ভিন্ন নামে রয়েছে এই শাখা। যেমনÑ ব্রিটেনে আসডা, ভারতে বেস্ট প্রাইস, জাপানে সেইয়ু। বতর্মানে ২২ লাখেরও বেশি মানুষ কাজ করছে এই ওয়ালমার্টে।
অল্প দাম, বেশি বিক্রি
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত সুপারস্টোর ওয়ালমার্ট। বর্তমানে বিশ্বের সর্ববৃহৎ খুচরা বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান এটি। এ ছাড়া আয়ের দিক থেকেও খুচরা পণ্য বিক্রি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে এটি সবচেয়ে বড়। এই স্টোরে নিত্যপ্রয়োজনীয় প্রায় সবকিছুই পাওয়া যায়। সপ্তাহে প্রায় ১৪ কোটি মানুষ আমেরিকার ওয়ালমার্ট স্টোরগুলোতে আসে। তাছাড়া পণ্য বিক্রির মাধ্যমে সব থেকে বেশি রেভিনিউ করা কোম্পানির তালিকায় রয়েছে এর নাম। ২০১৭ সালে ওয়ালমার্টের রেভিনিউ ছিল ৪৮৬ বিলিয়ন ডলার। ওই একই বছর স্টিভ জবসের এ্যাপলের আয় ছিল ২৫৫ বিলিয়ন ডলার। ভাবতে পারেন ওয়ালমার্টের জনপ্রিয়তা তাহলে কতটুকু।
কিন্তু ওয়ালটন যখন ব্যবসা করার সিদ্ধান্ত নেন তখন কিন্তু পুঁজি বলতে সদিচ্ছা আর চেষ্টা ছাড়া তেমন কিছুই ছিল না। প্রাথমিকভাবে ব্যবসা পরিচালনা করতে পণ্য ক্রয়ের জন্য স্যাম ওয়ালটন তার শ্বশুরের থেকে ২৫ হাজার ডলার ঋণ নেন। তারপর নানা ধাপ পেরিয়ে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন ওয়ালমার্ট। ১৯৬২ সালে চালু হওয়ার পর ১৯৭৬ সালের মধ্যেই এই প্রতিষ্ঠানটির মূল্য দাঁড়ায় ১৭৬ মিলিয়ন ডলারেরও বেশি। তার সাফল্যের মূলমন্ত্র ছিল অল্প দাম, বেশি বিক্রি।
বেলজিয়ামের চেয়েও সম্পদ বেশি
একটি দেশ ছোট হলেও কোনো একটি কোম্পানির চেয়ে এর সম্পদ কম হবে এটা শুনতে অবিশ্বাস্য লাগতে পারে। বিশ্বাস করতে কঠিন হলেও ওয়ালমার্টের বাৎসরিক আয় এত বেশি যা বেলজিয়ামের জিডিপিকেও ছাড়িয়ে যায়। ২০১৭ সালে এই কোম্পানিটির বার্ষিক মুনাফা ছিল ৪৮৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। সম্পদের দিক থেকে এই কোম্পানি বেলজিয়ামকে (জিডিপি ৪৬৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার) পেছনে ফেলে দেয়। যদি ওয়ালমার্ট কোনো দেশ হতো, তাহলে বৈশ্বিক সূচকে এটি ২৪তম বৃহৎ অর্থনীতির দেশ হতো।
যুক্তরাষ্ট্রের ধনী পরিবার
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে ধনী পরিবারের তালিকায় রয়েছে ওয়ালটন পরিবারের নাম। ওয়ালমার্টই তাদের আয়ের মূল উৎস। ওয়ালটন পরিবার এই সংস্থার প্রায় ৫০ শতাংশ শেয়ারের মালিক। এতেই তাদের অর্থের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৫২ বিলিয়ন ডলারে। স্যাম ওয়ালটনের মেয়ে অ্যালিস ওয়ালটন ও ছেলে জিম ওয়ালটন ছিলেন ফোর্বস ম্যাগাজিনের সেরা ধনীর তালিকায়। বর্তমানে অ্যালিস ওয়ালটনের সম্পদের পরিমাণ ৪৬. ৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। আর তার ভাই জিম ওয়ালটনের সম্পদ রয়েছে ৪৭. ১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।
বর্তমানে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ ধনী নারীও অ্যালিস। স্যান অনটোনিওর ট্রিনিটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অ্যালিস অর্থনীতি ও ফিন্যান্স বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করার পর অর্থনৈতিক বিশ্লেষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। তাছাড়া অ্যালিস বেশ কয়েকটি জাদুঘর ও চিত্র সংগ্রহশালার পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।
জাদুঘরে ওয়ালমার্টের দরজা
ওয়ালমার্ট প্রথমে এত বড় ছিল না। ওয়ালমার্টের প্রথম যুগে চালু হওয়া স্টোরের মধ্যে আরাকানসাসের আউটপোস্ট ছিল অন্যতম। সেখানে ব্যবহৃত দরজাগুলো দান করা হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন ডিসির স্মিথসোনিয়ান’স ন্যাশনাল মিউজিয়ামে। সেখানেই প্রদর্শিত হচ্ছে মার্কিন ইতিহাসের অন্যতম সফল এ প্রতিষ্ঠানের নিদর্শনগুলো।
বিশ্বের অনেক দেশে ওয়ালমার্ট জনপ্রিয়তা পেয়েছে। চীনে ও কানাডায় দোকান চালু করার পর তা সে সব দেশে খুবই জনপ্রিয় হয়। সেই ধারাবাহিকতায় তারা জার্মানি ও দক্ষিণ কোরিয়ায়ও শাখা খোলে। কিন্তু সেখানে চরমভাবে ব্যর্থ হয়। আর তাই সেখান থেকে একসময় দোকান গুটিয়ে নিতে বাধ্য হয় ওয়ালমার্ট।