১৮৯০ সালের ৪ সেপ্টেম্বর ভারতের পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলার শ্রীরামপুরের বড় তাজপুর গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন শেখ ওয়াজেদ আলী। যাকে আমরা এস ওয়াজেদ আলী নামে চিনি। তাকে বলা হয় ভবিষ্যতের বাঙালী। ১৯৪৩ সালে প্রকাশিত ‘ভবিষ্যতের বাঙালী’ শীর্ষক এক বিখ্যাত প্রবন্ধ গ্রন্থে তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতার ভবিষ্যদ্বাণী করে লিখেছিলেন, ‘গণতান্ত্রিক ভাব (Democratic) ভারতের রাজনীতিক্ষেত্রে বাঙালিই গণতান্ত্রিকতা এবং জাতীয়তাবাদের প্রধান এবং বিশ্বস্ত সমর্থক’। সেই কথার প্রমাণ দিতেই যেন বাংলাদেশ পাকিস্তানী অধীনতার নাগপাশ ছিড়ে গণতন্ত্র ও বাঙালী জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে স্বাধীন হয়।
এস ওয়াজেদ আলী তার পিতা শেখ বেলায়েত হোসেনের কর্মস্থল শিলংয়েই বড় হন। ১৯০৮ সালে আলীগড় কলেজ থেকে আইএ এবং ১৯১০ সালে এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএ পাশ করেন। এর বছর দুয়েক পর তিনি ইংল্যান্ডের কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় আরো একটি ব্যাচেলর ডিগ্রি অর্জন করেন। একই সময়ে তিনি বার এট ল ডিগ্রি অর্জন করে ১৯১৫ সালে থেকে কলকাতা হাইকোর্টে আইন ব্যবসায় যুক্ত হন। পরে ১৯২৩ সালে তিনি কলকাতা প্রেসিডেন্সির ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে নিয়োগ পান। প্রায় ৩২ বছর ম্যাজিস্ট্রেসি দায়িত্ব পালন করে ১৯৪৫ সালে তিনি অবসর গ্রহণ করেন।
এস ওয়াজেদ আলির প্রথম প্রবন্ধ ’অতীতের বোঝা’। এটি ১৯১৯ সালে প্রমথ চৌধুরী সম্পাদিত সবুজপত্র পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। একই বছর সালে ‘Bulletin of the Indian Rationalistic Society’ নামে একটি ইংরেজি জার্নাল এবং ১৯৩২ সালে ‘গুলিস্তাঁ’ নামে একটি বাংলা মাসিক সাহিত্য পত্রিকা সম্পাদনা ও প্রকাশ করেন।
১৯২৫ ও ১৯২৬ সালে এস ওয়াজেদ আলী পরপর দুবার বঙ্গীয় সাহিত্য সমিতির সভাপতি নির্বাচিত হন। এরপর ১৯২৭ সালে তিনি সমিতির সভাপতির পদ থেকে পদত্যাগ করেন। এবং একই বছর তার ছোটোগল্পগ্রন্থ ‘গুলদাস্তা’ প্রকাশিত হয়।
ওয়াজেদ আলী ছিলেন একজন উদার ও প্রগতিশীল ব্যক্তিত্ব। মননশীল চেতনা, ইতিহাস ও নীতিজ্ঞান, সত্য-সুন্দরের মহিমায় সমৃদ্ধ তার সাহিত্যকর্ম। এস ওয়াজেদ আলীর স্বপ্ন ছিল বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও ভাষাভিত্তিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা। যেন তার স্বপ্ন সার্থক করেই জন্ম হয় বাংলাদেশের।
লেখক হিসেবে গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, রম্যরচনা ও ভ্রমণকাহিনী রচনায় তিনি খ্যাতি অর্জন করেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য সাহিত্যকর্মের মধ্যে রয়েছে: প্রবন্ধ জীবনের শিল্প (১৯৪১), প্রাচ্য ও প্রতীচ্য (১৯৪৩), ভবিষ্যতের বাঙালী (১৯৪৩), আকবরের রাষ্ট্র সাধনা (১৯৪৯), মুসলিম সংস্কৃতির আদর্শ; গল্প গুলদাস্তা (১৯২৭), মাশুকের দরবার (১৯৩০), বাদশাহী গল্প (১৯৪৪), গল্পের মজলিশ (১৯৪৪); উপন্যাস গ্রানাডার শেষ বীর (১৯৪০); ভ্রমণকাহিনী পশ্চিম ভারত (১৯৪৮), মোটর যোগে রাঁচী সফর (১৯৪৯) প্রভৃতি।
‘ভবিষ্যতের বাঙালি’ বলে খ্যাতি এই মহা মানব ভাষা আন্দোলনের মাত্র কয়েক মাস আগে ১৯৫১ সালের ১০ জুন মৃত্যু বরণ করেন।