ছিলেন কালো মানুষের নেতা, হয়েছেন বিশ্বনেতা

দ্য রিপোর্ট ডেস্ক

জুলাই ১৮, ২০২২, ০৭:৪৪ এএম

ছিলেন কালো মানুষের নেতা, হয়েছেন বিশ্বনেতা

বর্ণবাদবিরোধী, গণতন্ত্রকামী, মুক্তির দিশারি, মুক্তিকামী জনতার প্রেরণার উৎস, ঐক্যের প্রতীক, গণতন্ত্রের প্রতীক, স্বাধীনতার প্রতীক, সৃজনশীলতা আর ধৈর্যের প্রতীক, কৃষ্ণ আফ্রিকাকে আলো ও সম্মানের আসনে প্রতিষ্ঠিত করার আপোষহীন লড়াকু নায়ক-এমনই অসংখ্য বিশেষণে বিশেষিত করা যায় তাঁকে। তিনিই নেলসন ম্যান্ডেলা-বিশ্বের একমাত্র নেতা যিনি একটানা ২৭ বছর কারাগারে থেকেছেন, তবে দেশের ভৌগলিক সীমানা ছাড়িয়ে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দিয়েছেন বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলন।

আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব, প্রখর রসবোধ, তিক্ততা ভুলে বৈরি প্রতিপক্ষের দিকে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দেয়ার মত উদারতা এবং তাঁর বর্ণাঢ্য ও নাটকীয় জীবন কাহিনী—এসব মিলিয়ে ব্যক্তিত্বে ছিলেন হিমালয় সমান ‍উচ্চতার অধিকারী নেলসন ম্যান্ডেলা।

যেভাবে নেলসন ম্যান্ডেলা নামকরণ

দক্ষিণ আফ্রিকায় বর্ণবাদের অবসান ঘটিয়ে বহু বর্ণ ভিত্তিক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে নেতৃত্ব দেওয়া নেলসনের আজ শুভ জন্মদিন।দিনটিকে ম্যান্ডেলা দিবসও বলা হয়ে থাকে। ১৯১৮ সালের এই দিনে  থেম্বু রাজবংশে জন্ম নেওয়া ছেলেটি ছোটবেলায় খুব চটপটে ছিলেন। আর এ কারণেই তার নাম রাখা হয় ‘রোলিহ্লাহ্লা’ যার অর্থ হলো গাছের ডাল ভাঙে যে অর্থাৎ ‘দুষ্টু ছেলে’।স্কুলে পড়ার সময় তার শিক্ষিকা মদিঙ্গানে তার ইংরেজি নাম রাখেন নেলসন। আর বংশগত ভাবে ম্যান্ডেলা নামটি সঙ্গে জুড়ে যায়।

স্থির করা বিয়ে থেকে পালানো ও কর্মজীবন

২৩ বছর বয়সে অভিভাবকদের স্থির করে দেওয়া বিয়ে থাকে পালিয়ে চলে যান জোহানেসবার্গে। আইনজীবী হওয়ার বাসনা নিয়েই আইনের ডিগ্রি নিতে ভর্তি হন উইটওয়াটার্সব্র্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে। এখান থেকে ডিগ্রি নেওয়ার পর আইন ব্যবসা শুরু  করেন এবং বেশ সুনাম অর্জন করেন। তবে যার রক্তে রয়েছে আন্দোলনের মাধ্যমে বর্ণ বৈষম্য দূর করার তার কী কালো গাউন পরা মানায়। দ্রুত দেশের বিভিন্ন অঞ্চল ও জাতিসত্তার মানুষের সঙ্গে তাঁর আলাপ , উদারনৈতিক , বিপ্লবী , আফ্রিকাপন্থী ভাবনা ও ধারণার সঙ্গে তার চোখ খুলে যায়। বিশেষ করে আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসের (এএনসি) অন্যতম প্রাণপুরুষ ওয়াল্টার সিসুলু’র সঙ্গে পরিচযয়ের পর বর্ণবিদ্বেষ ও বৈষম্যের বর্বরতা সম্পর্কে তার মনটা ভয়ঙ্কর বিদ্রোহী হয়ে ওঠে।

যাবজ্জীবন কারাদণ্ড

১৯৬২ সালের ঘটনা। এই বছরের ৫ আগস্ট নাশকতা ও হিংসার মাধ্যমে সরকারকে উৎখাত করার চেষ্টার দায়ে অভিযুক্ত ম্যান্ডেলা গ্রেফতার হন। তার বিরুদ্ধে দেওয়া হলো রাজদ্রোহ মামলা। তবে একটুও দমাতে পারেনি তাকে। শুরু হল বিচারপর্ব। কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে নেলসন ম্যান্ডেলা দিলেন ঐতিহাসিক ভাষণ। বললেন,“আমি এমন একটা গণতন্ত্র ও স্বাধীন সমাজের আদর্শে বিশ্বাস করি, যেখানে সকল মানুষই পারস্পরিক সৌহার্দ্যের সঙ্গে এবং সমান সুযোগ নিয়ে বাঁচবে। এই আদর্শের জন্য আমি প্রাণ বিসর্জন দিতেও প্রস্তুত। ১৯৬৪ সালের ১২ জুন মামলার রায়ে তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়।"

কারাগার থেকে বেরিয়েই বিপ্লবের ঘোষণা

পৃথিবীতে নেলসন ম্যান্ডেলাই একমাত্র বিশ্বনেতা যিনি কারাগার থেকে মুক্ত হবার সময়েই তার দাবি আদায়ের লক্ষ্যে বিপ্লব চালিয়ে যাবার ঘোষণা দেন। কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে জাতির উদ্দেশে ভাষণে তিনি বলেন, “১৯৬০ সালে আমরা সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু করতে বাধ্য হই। বর্ণবাদের হিংস্রতার হাত থেকে আত্মরক্ষার খাতিরেই আমরা আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসের সশস্ত্র অঙ্গসংগঠন উমখান্তো উই সিযওয়ে গঠন করেছিলাম। সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু করার পেছনের কারণগুলো এখনো রয়ে গেছে। তাই এ সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়া ছাড়া আমাদের হাতে আর কোনো পথ নেই।”

ঢাকায় আগমণ

বাংলাদেশের স্বাধীনতার রজতজয়ন্তী উদযাপন উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে যোগ দিতে ১৯৯৭ সালের মার্চে তিনি ঢাকায় এসেছিলেন। শ্রদ্ধা নিবেদন করেছিলেন জাতীয় স্মৃতিসৌধে। ভাষণ দিয়েছিলেন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের অনুষ্ঠানে। তখন তিনি দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট। ১৯৯৭ সালের ২৫ থেকে ২৭ মার্চ তিন দিনের এই সফরটিই ছিল দক্ষিণ আফ্রিকার মুক্তিকামী মানুষের নেতার প্রথম এবং শেষ সফর।

অনুষ্ঠানে 'আমিও বাংলার বন্ধু হতে চাই' ম্যান্ডেলার এই মন্তব্য সবাইকে অনুপ্রাণিত করে। তিনি আরও বলেন, “স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করেছে এমন একটি জাতিকে শ্রদ্ধা জানাতে আমি বাংলাদেশে এসেছি। রক্তস্নাত এ স্বাধীনতা উদযাপনের অনুষ্ঠানে এসে আজ আমি বলছি, নিপীড়ন ঔপনিবেশিক শাসনের কবল থেকে বের হয়ে স্বাধীনতার পথ কখনোই সহজ নয়।” 

ম্যান্ডেলার মৃত্যু

মৃত্যুর আগের তিন বছর মাঝে মাঝেই অসুস্থ হয়ে পড়তেন নেলসন ম্যান্ডেলা । রবেন দ্বীপের কারাগারে অস্বাস্থ্যকর ১৮ টি বছর তাঁকে যক্ষ্মা উপহার দিয়েছিল। পরবর্তীতে নিউমোনিয়াও তাকে হামলা করে। প্রতিবারই তাঁকে ফুসফুসের সংক্রমণ নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়েছিল৷ এর ফলে পুরো বিশ্ববাসী বেশ কিছুদিন আশঙ্কায় ছিল। অবশেষে সেই আশঙ্কাই সত্যে পরিণত হল । ২০১৩ সালের ৫ ডিসেম্বর গোটা দুনিয়ার কোটি কোটি ভক্তকে ছেড়ে ৯৫ বছর বয়সে না ফেরার দেশে পাড়ি জমান শান্তিতে নোবেলজয়ী এ কিংবদন্তী।

Link copied!