প্রেমই তার ধর্ম, যার জন্য তিনি মরতে প্রস্তুত

দ্য রিপোর্ট ডেস্ক

অক্টোবর ৩১, ২০২১, ০৬:০৯ এএম

প্রেমই তার ধর্ম, যার জন্য তিনি মরতে প্রস্তুত

তাকে বলা হয়ে থাকে ‘চিরসুন্দরের কবি’। পোয়েট অব বিউটি কিংবা পোয়েট অব সেনসুয়সনেস। সৌন্দর্য, তারুণ্য আর একই সাথে দণ্ডিতের প্রতীক তিনি। মাত্র ছয় বছর তিনি সাহিত্য চর্চার সুযোগ পেয়েছিলেন। তারপরও তিনি ইংরেজি সাহিত্যে অনন্যসাধারণ কল্পনাশক্তি, মনন, ভাব, বৈচিত্রময় সৌন্দর্য ও প্রেমকে প্রতিষ্ঠিত করতে ক্ষুরধার লেখনির আঁচড়ে জাতকবি হিসেবে স্থান পাকাপোক্ত করে নিয়েছেন। তিনি জন কীটস-ইংরেজি সাহিত্যের রোমান্টিক যুগের সর্বকনিষ্ঠ কবি। 

অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ দিকে শুরু হয় ইংরেজি সাহিত্যের রোমান্টিক যুগের। ১৮৩৭ সালের ২০ জুন রানী ভিক্টোরিয়া সিংহাসনে বসার আগে ১৭৮৫ সাল থেকে ১৮৩০ সাল পর্যন্ত রোমান্টিক যুগের ইংরেজি সাহিত্যের ৫ কবি হলেন-ইউলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ার্থ, স্যামুয়েল টেইলর কোলরিজ, জন কীটস, পার্সি বিশি শেলি ও লর্ড বায়রন। এই পাঁচ কবির অন্যতম প্রধান ছিলেন জন কীটস। মৃত্যুর ৪০ বছর পর যিনি ইংরেজি সাহিত্যের অন্যতম প্রধান রোমান্টিক কবি হিসেবে বিশ্বখ্যাতি অর্জন করেন।

ইংরেজি সাহিত্যের রোমান্টিক আকাশে ১৭৯৫ সালের এই দিনে (৩১ অক্টোবর) ধুমকেতুর মতো আবির্ভূত হয়েছিলেন কীটস। সমসাময়িক কবিদের মধ্যে কম সময় বেঁচেছিলেন তিনি। ওয়ার্ডসওয়ার্থ যেখানে ৮০ বছর, কোলরিজ ৬১ বছর, বায়রন ৩৬, শেলি ২৯ বছর বেঁচেছিলেন, সেখানে জন কীটস মাত্র ২৫ বছর বয়সে মরণব্যাধী যক্ষার কাছে পরাজিত সৈনিক। 

শিক্ষা-দীক্ষায়ও অন্য ৪ কবির চাইতে পিছিয়ে ছিলেন তিনি। স্কুলের গন্ডীটাও ঠিকমতো পার হতে পারেন নি। তবে প্রচুর পড়তেন, আর যার সংস্পর্শে আসতেন, তাকে আত্মসাৎ করে নেওয়ার অসাধারণ ক্ষমতা ছিলো। আর একারণেই তার লেখায় মিল্টন, শেক্সপিয়র, চ্যাপম্যান, লে-হান্ট, স্পেন্সারসহ কারও বলয় থেকে তিনি বের হতে পারেননি। 

সৌন্দর্য পিয়াসী ছাড়াও কিটস ছিলেন পরিশুদ্ধ এক দার্শনিক কবি। রোমন্টিক যুগের কবিদের মধ্যে বিশুদ্ধতম ভাববাদী বা আইডিয়ালিস্ট ছিলেন। রবীন্দ্রনাথ আর ওয়ার্ডসওয়ার্থ ছাড়া কেউ তার সমকক্ষ ভাববাদী কবি নন। 

ঘোড়ার আস্তাবলের কর্মচারীর সন্তান জন কীটস ৮ বছর বয়সে বাবাকে হারান। ১৪ বছর বয়সে কীটসের মাও চলে  যানি। এভাবেই ক্রমে নিঃসঙ্গ হতে থাকে কীটসের বেড়ে ওঠার দিনগুলো। স্কুল অসমাপ্ত রেখেই হ্যামন্ড নামে এক ডাক্তারের অধীনে শিক্ষানবিশ নিযুক্ত হন। কিছুদিন পরেই ছেড়ে দিয়ে লন্ডন ফিরে আসেন। এখানে সেন্ট টমাস হাসপাতালে বেশ কিছুদিন ধরে হাতে-কলমে ডাক্তারি শিখেন। 

তবে যার জন্য ইংরেজি সাহিত্য অনেক কিছু আশা করে আছে, তার কি এসব মানায়। তাইতো ছেড়ে দিয়ে কীটসের ভাবুক মন কাব্যের সৌন্দর্য জগতে ছুটে চলতে থাকে অবিরত। উনিশ বছর বয়সে ১৮১৪ সাল থেকে তার কাব্য রচনার শুরু। ১৮১৭ সালে ডাক্তারি ছেড়ে পুরোপুরি কাব্যের জগতে নিমগ্ন হন কীটস।

কীটসের সমস্ত হৃদয়-মন ছিলো সৌন্দর্যের নন্দলোকে আবদ্ধ। তার সব সৃষ্টিকর্মে সৌন্দর্য ও মাধুর্য ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। সৌন্দর্যের অসম্ভব পূজারী ছিলেন কীটস। সব কিছুতেই সৌন্দর্য খুঁজে পেয়েছেন তিনি। এমনকি তুচ্ছ বস্তুগুলোর মধ্যেও তিনি আবিষ্কার করেছেন সৌন্দর্য, অসম্ভব হতাশা আর বিষন্নতাকে বলেছেন সৌন্দর্যের পরিপূরক। তাই তো আমরা দেখি- দোয়েল পাখির মধ্যে অসম্ভব সৌন্দর্য খুঁজে পেয়ে তিনি রচনা করেছেন ‘Ode to a Nightingale’। আবার নিঃসঙ্গ প্রকৃতি জগতের চিত্র অঙ্কনে সৃষ্টি করেছেন ওড অন এ গ্রেসিয়ান আর্ন। এখানেই কীটসের একটি বিখ্যাত উক্তি হল-Beauty is truth, truth beauty that is all Ye know on earth, and all ye need to know.

সেন্স অব বিউটির জন্য সবচেয়ে বেশি পরিচিত ছিলেন জন কীটস। সৌন্দর্যের মধ্যে একটা গভীর শান্তির ভাবও থাকতে পারে-এটা শুধুমাত্র  কীটসই তার লেখায় আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়েছেন। কীটস মনে প্রাণে বিশ্বাস করতেন বিষন্নতার আবাস আনন্দের মন্দিরে। তার এই বিশ্বাসকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে রচনা করেন ওড অন মিলানকোলি। ওড টু সাইকি’ ” তে কীটস সাইকির সৌন্দর্য্যের বন্দনা করেছেন। সাইক হল বিষন্ন প্রেমের প্রতিমুর্তি। বিষন্ন বলতে কোন দুঃখজনক ঘটনাকে বোঝায়না-এটি কীটসই বলেছেন ওড টু সাইকিতে। 

১৮২০-এর ফেব্রুয়ারিতে প্রেমিকা ফ্যানিকে কীটস লিখেছিলেন, “আমি এমন কোনো মহান কর্ম পেছনে ফেলে যাচ্ছিনা যা আমার বন্ধুদের গর্বিত করবে, আমি শুধু প্রতিটি জিনিসের ভেতরের সৌন্দর্য্যের উৎসকে ভালোবেসেছি। সময় পেলে নিজেকে স্মরণীয় করে যেতাম।”

সবার মতো কীটসের জীবনেও প্রেম এসেছে। যক্ষায় ভাই টম মারা যাওয়ার পর স্বজনহীন কীটস তার বন্ধু ব্রাউনের বাড়িতে উঠলে সেখোনে পরিচয় হয় 'ফ্যানি ব্রাউন' নামে ১৮ বছর বয়সী এক তরুনীর সঙ্গে। এরই ধারাবাহিকতায় উচ্ছল মধুবসন্তে কিট্সের হৃদয়ের দু’কূল উজাড় করে এল প্রেম।

প্রেমে পড়লে প্রেমিকেরা কবি হয়ে যায়-অনেকেই বলে থাকেন। এ কারণেই হয়তোবা  কিটস লিখেছেন তার কালজয়ী কবিতাগুলি, বিখ্যাত ‘ওড’গুলিও। ফ্যানি ব্রাউনের সংস্পর্শে থাকাকালে ১৮১৯ সালে কীটসের সৃষ্টিগুলো তাকে ইংরেজি সাহিত্যে সর্বকালের শ্রেষ্ঠ রোম্যান্টিক কবিদের অন্যতম হিসেবে স্থান দিয়েছে। ইজাবেলা জোনস নামে এক শিক্ষিতা তরুণীর প্রতি আকৃষ্ট থাকলেও ফ্যানি ব্রাউনের প্রতি ছিল তার আমৃত্যু প্রেম। ‘ব্রাইট স্টার’ কবিতা তাকেই নিবেদন করেন তিনি। 

প্রেমের সাথে সন্দেহবাতিকতা থাকাটা অস্বাভাবিক নয়। বরং এটা যেনো প্রেমেরই একটা অংশ। কীটসও এর ব্যতিক্রম ছিলেন না। অষ্টাদশী ফ্যানি ব্রাউনের অনুরাগীর অভাব ছিল না। কীটসের চোখ ফাঁক দিয়ে স্থানীয় ক্যান্টনমেন্টে নাচের অনুষ্ঠানে নিয়মিত যোগদান করতেন ফ্যানি। একদিন নাচের সময় এক সেনাকর্মকর্তার বাহুলগ্ন অবস্থায় দেখতে পান কীটস। এতে তার হৃদয় ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যায়। তবে জানতে দেননি ফ্যানিকে। তবে ফ্যানিকে উদ্দেশ্য করে কীটস লেখেন তার হৃদয় নিংড়ানো ভালবাসা ও বেদনাদায়ক কবিতা-টু ফ্যানি।

ফ্যানি ব্রাউনের প্রতি প্রেমের আকুলতা থেকে কীটস লিখলেন --"আমার ভালোবাসা আমায় কী যে স্বার্থপর করেছে/তোমাকে ছাড়া আমি বাঁচবো না- তোমার সঙ্গে আবার দেখা হওয়ার কথা ছাড়া কিছুই মনে পড়ছে না। তুমি আমায় নিজের ভেতর শুষে নিয়েছ। এখন আমার মনে হচ্ছে আমি ডুবে যাচ্ছি- তোমাকে এক্ষুনি না দেখলে কী দুর্দশা হবে আমার.... আমি অবাক হই যে লোকে ধর্মের জন্য শহীদ হয়- শুনে আমার গা শিরশির করছে, এখন আর করে না- আমার ধর্মের জন্য আমি প্রাণ দিতে পারব না- প্রেমই আমার ধর্ম- তাঁর জন্য আমি মরতে পারি- আমি মরতে পারি তোমার জন্য।"

কীটসকে অসম্ভব ভালোবাসতেন আরেক রোমান্টিক কবি শেলি। কীটসের মারণরোগের খবর যখন তার কাছে পৌঁছায় তখন তাকে আমন্ত্রণ জানান শেলি৷ শেলির ধারণা ছিল আবহাওয়া বদল হলে কীটস হয়তো সুস্থ হয়ে উঠবেন। হয়তো তাঁর সঙ্গে কীটসের যন্ত্রণাকে লাঘব করবে৷ ভীষণ অসচেতন কীটস কিন্তু শেলির আতিথেয়তা গ্রহণ করেননি। ১৮২০ সালে কীটস ইতালি যাত্রা করলেন ঠিকই, পৌঁছলেন রোম শহরে, কিন্তু শেলির কাছে নয়। এক বছরের মাথায় রোমেই মৃত্যুবরণ করেন ইংরেজি সাহিত্যের এই অমর রোমান্টিক কবি।

Link copied!