খেলাপি ঋণ কমানো ও প্রকৃত ব্যবসায়ীদের ব্যবসায় টিকে থাকার সুযোগ দিতে মাত্র ২ শতাংশ ডাউনপেমেন্টের খেলাপি ঋণ নিয়মিত করার সুযোগ দেয় সরকার। এ বিশেষ সুবিধা নিয়ে চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত ১৩ হাজার ৩০৭ জন খেলাপি গ্রাহক তাদের ঋণ নিয়মিত করেছেন। বৃহস্পতিবার বিকেল ৩টায় জাতীয় সংসদে স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপস্থিতিতে ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেট প্রস্তাব উপস্থাপনকালে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল এসব কথা জানান।
খেলাপি ঋণ হ্রাসে উদ্যোগের কথা জানিয়ে বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী বলেন, দক্ষ ও আধুনিক ব্যাংকিং খাত গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে খেলাপি ঋণ অন্যতম প্রতিবন্ধক। তাই ঋণ খেলাপি সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে একটি উন্নত ঋণ সংস্কৃতি গড়ে তোলার জন্য আমাদের প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। ভালো ঋণগ্রহীতাদের উৎসাহ প্রদান ও ইচ্ছাকৃত ঋণ খেলাপিদের আইনের আওতায় আনার ব্যবস্থাকে সরকার আরও জোরদার করছে।
তিনি বলেন, যারা যৌক্তিক কারণে ঋণ খেলাপি হয়েছেন, কিন্তু ব্যবসায় চালিয়ে নিতে চান, তাদের ব্যবসার সুযোগ করে দেওয়া সরকারের অন্যতম দায়িত্ব। খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনতে এবং প্রকৃত ব্যবসায়ীদের ব্যবসায় টিকে থাকার সুযোগ দানের লক্ষ্যে মাত্র ২ শতাংশ ডাউনপেমেন্টের ভিত্তিতে ঋণ পুনঃতফসিলের সুবিধা প্রদান করে ‘ঋণ পুনঃতফসিল ও এককালীন এক্সিট- সংক্রান্ত বিশেষ নীতিমালা-২০১৯’ জারি করা হয়েছিল। এ সুযোগ গ্রহণ করে নির্ধারিত সময় অর্থাৎ মার্চ ২০২২ পর্যন্ত ১৩ হাজার ৩০৭ জন ঋণগ্রহীতা ঋণ নিয়মিত করেছেন বলে জানান অর্থমন্ত্রী।
সুদের হার বিষয়ে অর্থমন্ত্রী বলেন, বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় ব্যাংক ঋণের সুদ হার বাংলাদেশে তুলনামূলক বেশি থাকায় আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশি উদ্যোক্তাদের কিছুটা পিছিয়ে পড়তে হচ্ছিল। অন্যদিকে, ঋণখেলাপি বাড়ার একটা অন্যতম কারণ ছিল উচ্চ সুদহার। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণের জন্য প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুসারে বিগত অর্থবছরে ব্যাংক ঋণের সুদ হার এক অংকের (single digit) মধ্যে আনা হয়েছিল।
অর্থমন্ত্রী জানান, ঋণপ্রবাহ বাড়াতে ও ব্যাংকে তারল্য ধরে রাখতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিভিন্ন নীতিগত সুদহার কমানো হয়েছিল। ফলে, ঋণের গড় সুদহার চলতি বছরের মার্চে ৭.১১ শতাংশে নেমে এসেছে। আমানত ও ঋণের সুদহারের পার্থক্য ফেব্রুয়ারি ২০১১ সময়ের ৫.৬৮ শতাংশ থেকে চলতি বছরের মার্চে ৩.১০ শতাংশে নেমে এসেছে।
সুদের হার কমানোর ফলে করোনা অতিমারিতেও ব্যাংক খাতের দক্ষতা বেড়েছে। ২০২১ সালে করোনা অতিমারির মধ্যেও বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো তাদের মুনাফা ৯.৫ শতাংশ বৃদ্ধি করতে সক্ষম হয়েছে। উল্লেখ্য, মূল্যস্ফীতির সাম্প্রতিক ঊর্ধ্বগতি বিবেচনায় নিয়ে রেপো হার ৪.৭৫ শতাংশ হতে বৃদ্ধি করে ৫ শতাংশ করা হয়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সবশেষ তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালের মার্চ মাস শেষে ব্যাংকিং খাতের মোট বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৩ লাখ ২৯ হাজার ৭৩৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপিতে পরিণত হয়েছে এক লাখ ১৩ হাজার ৪৪০ কোটি টাকা, যা মোট বিতরণ করা ঋণের ৮ দশমিক ৫৩ শতাংশ।
‘কোভিডের অভিঘাত পেরিয়ে উন্নয়নের ধারাবাহিকতায় প্রত্যাবর্তন’ স্লোগান নিয়ে ২০২২-২৩ অর্থবছরের জন্য ৬ লাখ ৭৮ হাজার ৬৪ কোটি টাকার বাজেট জাতীয় সংসদে পেশ করা হয়েছে। নতুন এ বাজেটে মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হচ্ছে ৭ দশমিক ৫ শতাংশ। এতে মূল্যস্ফীতি ৫ দশমিক ৫ শতাংশে রাখার কথা বলা হচ্ছে। প্রস্তাবিত বাজেটের আকার চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটের তুলনায় ৭৪ হাজার ৩৮৩ কোটি টাকা বেশি। আর সংশোধিত বাজেটের তুলনায় ৮৪ হাজার ৫৬৪ কোটি টাকা বেশি। নতুন বাজেটে সরকারের আয়ের সম্ভাব্য লক্ষ্যমাত্রা হতে যাচ্ছে ৪ লাখ ৩৬ হাজার ২৭১ কোটি টাকা। অনুদান ছাড়া ঘাটতি ধরা হয়েছে ২ লাখ ৪৫ হাজার ৬৪ কোটি টাকা। আর অনুদানসহ ঘাটতি ২ লাখ ৪১ হাজার ৭৯৩ কোটি টাকা।
আয়ের লক্ষ্যমাত্রা চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের তুলনায় ৪৪ হাজার ৭৯ কোটি টাকা বেশি। কর বাবদ ৩ লাখ ৮৮ হাজার কোটি টাকা আয় করার পরিকল্পনা করছে সরকার। এর মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) মাধ্যমে কর আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৩ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকা। নতুন অর্থবছরে এনবিআরকে আগের বছরের তুলনায় ৪০ হাজার কোটি টাকা বেশি রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা দিচ্ছে সরকার। এনবিআর বহির্ভূত কর থেকে আয় করার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে ১৮ হাজার কোটি টাকা। আর কর ছাড়া আয় ধরা হয়েছে ৪৫ হাজার কোটি। বৈদেশিক অনুদান থেকে আয় ধরা হয়েছে ৩ হাজার ২৭১ কোটি টাকা।