মার্চ ৪, ২০২৩, ০৮:৩৭ পিএম
এক অধ্যাপকের বিরুদ্ধে অপমান করার অভিযোগ এনে আত্মহত্যার চেষ্টা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০১৮-১৯ সেশনের শিক্ষার্থী এহসান উল্লাহ (ধ্রুব)। তিনি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হল শাখা ছাত্রলীগের উপ প্রশিক্ষণ বিষয়ক সম্পাদক। এখন ধ্রুবর সহপাঠীরা দাবি করছেন, প্রেমে প্রত্যাখ্যাত হয়ে তিনি ওই কাণ্ড করেছেন। এ জন্য তিনি ছাত্রলীগের নাম ব্যবহার করে ওই শিক্ষককে ফাঁসানোর চেষ্টা করেছেন।
গত বৃহস্পতিবার (২রা মার্চ) রাতে নিজের ফেসবুক এ্যাকাউন্টে আত্মহত্যার পথে এগিয়ে যাওয়ার কথা জানিয়ে নিখোঁজ হয়েছিলেন ধ্রুব। পরে মোবাইল ফোনের লোকেশন ট্র্যাক করে রাত সাড়ে ১২ টার দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদুল্লাহ হলের পুকুর পাড় থেকে তাঁকে অচেতন অবস্থায় উদ্ধার করা হয়। এরপর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতলের জরুরী বিভাগে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সেবা দেওয়া হয়।
আত্মহত্যার উদ্যোগ নিয়ে ধ্রুব তার ফেসবুক ওয়ালে একটি ছবি ব্যবহার করেছেন যেখানে ইংরেজিতে লেখা ছিল: থ্যাংকস ফর কিলিং মী স্যার। একই পোস্টের ক্যাপশনে তিনি লেখেন, ‘ প্রিয় তানজীম স্যার, আপনার পরে আমার আর কোনো রাগ নেই। ভালো থাকবেন।’ এছাড়া তিনি অধ্যাপক তানজীমউদ্দিন খানকে উদ্দেশ্য করে আরো মন্তব্য প্রকাশ করেন: আপনি যতই অস্বীকার করেন, আমি ছাত্রলীগ করি বলে আপনি এমন করেছেন।
এই পোষ্টের সূত্র ধরে বৃহস্পতিবার মধ্যরাতে উপাচার্যের বাসভবনের সামনে অবস্থান নেয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগ। তারা ‘শিক্ষকদের নগ্ন কাজ, রুখে দাঁড়াও ছাত্রসমাজ’, ‘শিক্ষার্থীর ওপর নির্যাতন কেন, প্রশাসন জবাব চাই’, ‘শিক্ষকদের কালো হাত, ভেঙে দাও গুঁড়িয়ে দাও’, ‘আমার ভাই নিখোঁজ কেন, প্রশাসন জবাব চাই’ ইত্যাদি স্লোগান দেয় প্রায় দুই ঘন্টা। ওই মুহুর্তে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক তানভীর হাসান সৈকত তাঁর ফেসবুক পেজেও লেখেন: আমার ভাইয়ের কিছু হলে কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না। ছাত্রলীগের রক্তের মূল্য আছে। প্রয়োজনে রক্ত দিয়ে রক্তের মূল্য আদায় করা হবে।
তানভীর হাসান সৈকতের ওই স্ট্যাটাসকে নিজের প্রাণনাশের হুমকি মনে করছেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক তানজীমউদ্দিন খান। শুক্রবার দিবাগত রাতে তানজীমউদ্দিন খান তাঁর ফেসবুক ওয়ালে লিখেন: কোনো এক “রাজনৈতিক” কর্মী ‘প্রয়োজনে রক্ত দিয়ে রক্তের মূল্য আদায়’ এর মত ভয়ানক ফেসবুক স্ট্যাটাস দিয়েছে, যা আমার জীবনের প্রতি হুমকি ছাড়া অন্য কিছু হিসেবে বিবেচনা করতে পারি না! একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী এভাবে প্রকাশ্যে কোনো শিক্ষককে জীবন নাশের হুমকি দিতে পারে সেটা আমার ধারনার বাইরে ছিলো! আমরা আসলে শিক্ষার্থীদের কী শিক্ষা দিচ্ছি? শিক্ষক অপমান করায় আত্মহত্যার উদ্যোগ গ্রহণ নাকি এর পেছনে অন্য কোনো উস্কানি কাজ করছে, এ নিয়ে নানান সংশয় রয়ে গেছে এখনো।
তবে এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক তানভীর হাসান সৈকত বলেন, আমার স্ট্যাটাসে আমি লিখেছি ছাত্রলীগের রক্তের মূল্য আছে। প্রয়োজনে আরো রক্ত দিয়ে রক্তের মূল্য আদায় করব। এখানে কাউকে আমি হুমকি প্রদান করিনি। নিজের রক্ত দেওয়ার কথাই বলেছি।
এহসান উল্লাহর ধ্রুবর বিষয়ে তিনি বলেন, আমরা শুনেছি ধ্রুবর এই ঘটনার সাথে একটি মেয়ে জড়িত। তবে এটি এক বছর আগের ঘটনা। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষার্থীরা যখন সুন্দরবন ট্যুরে যায় তখন ধ্রুব তাঁদের সাথে যায়নি। যে সাথেই যায়নি সে কীভাবে গুজব ছড়াতে পারে? এছাড়া তিনি আরো বলেন, বিভাগে অভিযোগ দায়ের করা হলেও একজন শিক্ষক সকলের সামনে শিক্ষার্থীর আত্মসম্মানে আঘাত হানতে পারেন না। এটিও এক ধরনের র্যাগিং। বিশ্ববিদ্যালয়ে শুধু সিনিয়র জুনিয়রদের র্যাগ দেয় না, শিক্ষকরা র্যাগিং কালচারের সাথে জড়িত। এই সংস্কৃতি ভাঙতে সাধারণ শিক্ষার্থীরা জেগেছে এবং আমরা তাঁদের সাথে একাত্মতা পোষণ করেছি। এছাড়া আর কিছু নয়।
কী ঘটেছিল সেদিন ক্লাসে
অভিযোগকারী এহসানউল্লাহ ধ্রুব ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগ আত্মহত্যার উদ্যোগ নেওয়ার পেছনে তানজীমউদ্দিন খানের অপমানকে দায়ী করলেও গত বৃহস্পতিবার শ্রেণিকক্ষে কী ঘটেছিল সে সম্পর্কে পঞ্চাশ জনেরও বেশি শিক্ষার্থীর স্বাক্ষর সম্বলিত একটি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছে আন্তর্জাতিক বিভাগের চতুর্থ বর্ষের (৭২তম ব্যাচ) শিক্ষার্থীরা। বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে তাঁরা দাবি করেন যে, ‘গত বৃহস্পতিবার (২রা মার্চ) এহসান উল্লাহ ধ্রুব ক্লাসে আসার আগেই স্যার আমাদের ক্লাস শুরু করেন এবং তিনি সহপাঠীদের নিয়ে গুজব ছড়ানোকে ইর্যাশনাল বিহেভিয়ার হিসেবে অভিহিত করেন। এরপরে তিনি আমাদের পড়ানো শুরু করেন।
ক্লাসের মাঝামাঝি সময়ে এহসান ধ্রুব ক্লাসরুমে প্রবেশ করে। ক্লাসের শেষের দিকে স্যার ধ্রুবকে দাঁড়াতে বলেন এবং তাঁর রটানো গুজবের সূত্র সম্পর্কে জানতে চান। ধ্রুব কোনো ব্যক্তির নাম প্রকাশ করতে অস্বীকৃতি জানায় এবং এর বদলে স্ক্রিনশট দেখানোর ইচ্ছা পোষণ করে। তানজীম স্যার এরপরও নাম বলায় গুরুত্ব আরোপ করলে সে নাম বলতে ব্যর্থ হয়। তানজীম স্যার তখন সহপাঠীদের নামে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হতে বারণ করেন। প্রত্যুত্তরে এহসান ধ্রুব আশ্চর্জজনকভাবে "They conspired against me so I conspired against them" এই স্বীকারোক্তিমূলক বাক্যটি ব্যবহার করে যা শুনে স্বাভাবিকভাবে আমরা অবাক হই। এরপর তানজীম স্যার তাঁকে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হিসেবে নিজের সহপাঠীদের সম্পর্কে কী বলা যায় আর যায় না সেটি তাঁর বোঝা উচিত। প্রত্যুত্তরে যখন ধ্রুব কিছু বলতে চায় তখন স্যার তাঁকে থামিয়ে বলেন যে একজনকে প্রেমের প্রস্তাব দিয়ে প্রত্যাখ্যাত হওয়ার কারণে সেই ব্যক্তির সম্পর্কে কুৎসা রটনা করার অধিকার তাঁর (ধ্রুব) নেই। এরপর স্যার ক্লাস থেকে বেরিয়ে গেলে ধ্রুব তাঁর কাছে ক্ষমা চাইতে যায়। পরবর্তীতে স্যার তাঁর সাথে নিচে নেমে তাঁকে ফুচকা খাওয়ান।
ওই ঘটনায় আমাদের সহপাঠী ধ্রুব'র ফেসবুক পোস্ট এবং আত্মহননের চেষ্টা বেশ দুঃখজনক। কিন্তু একটা ব্যাপার ভালোভাবে স্পষ্ট করা প্রয়োজন যে এই পুরো ঘটনার সাথে এহসান ধ্রুব'র রাজনৈতিক পরিচয়ের কোনোই যোগসূত্র ছিল না।’
ধ্রুবর সমস্যা সমাধানে তানজীমউদ্দিন খান
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের ৭২তম ব্যাচের একাধিক শিক্ষার্থীর সূত্রানুসারে জানা যায়, বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের প্রথম বর্ষ থেকেই একই বিভাগের একজন নারী শিক্ষার্থীর সাথে বন্ধুত্ব ছিল এহসান ধ্রুবর। দীর্ঘদিন বন্ধুত্ব থাকার পর একপর্যায়ে ধ্রুব মেয়েটিকে প্রেম নিবেদন করে। কিন্তু মেয়েটি তা প্রত্যাখান করে। যার ফলস্বরূপ গত এক বছর ধরে ধ্রুব মেয়েটিকে নানাভাবে উত্যক্ত করার চেষ্টা করে। নিরাপত্তার ভয়ে প্রথমদিকে অভিযোগ না জানালেও সুন্দরবন ভ্রমনের পর অনোন্যপায় হয়ে বিভাগকে অবহিত করেন। সেই সময়ে বিভাগীয় প্রধান লাইলুফার ইয়াসমীন দেশের বাহিরে থাকায় ভারপ্রাপ্ত দায়িত্ব পালন করেছিলেন তানজীমউদ্দিন খান। পরে ওই নারী শিক্ষার্থী ও ধ্রুবকে নিয়ে একবার আলোচনায়ও বসেছিলেন তানজীমউদ্দিন খান।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক শিক্ষার্থী বলেন, গত বৃহস্পতিবার সমস্যার সমাধান করার জন্যই তানজীম স্যার ধ্রুবকে নাম জিজ্ঞেস করেছিলেন। পরে তাঁর আত্মহত্যার উদ্যোগ গ্রহণ খুবই দুঃখজনক। প্রশাসনিক সহায়তার সাথে আমরা বেশ কয়েকজন ধ্রুবকে খুঁজে বেড়িয়েছি। তবে ছাত্রলীগের সরাসরি সমর্থন পেয়ে ধ্রুব স্যারকে ফাঁসানোর চেষ্টা করছে।
ধ্রুবর পরিবারের ইচ্ছে
এহসানউল্লাহ ধ্রুবর মায়ের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, এই বয়সে ছেলেমেয়েরা একটু আবেগী থাকে। আমার ছেলে তারচেয়েও বেশি আবেগী। তবে আমি চাই এই বিষয়টির এমন একটি সমাধান হোক যেখানে দুই পক্ষেরই কোনো ক্ষতি না হয়। প্রয়োজনে আমি নিজে গিয়ে স্যারের সাথে কথা বলব। তবুও যেন বিষয়টি অন্য দিকে না যায়।