জুলাই ২৮, ২০২২, ০৮:০০ এএম
দেশে একদিকে যখন করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতি, তখন বাড়ছে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যাও। এ যেন ‘গোদের ওপর বিষফোঁড়া।’ বর্ষাকাল এলেই ডেঙ্গু রোগের জীবাণুবাহী এডিস মশার উৎপাত বাড়ে। এ সময় এই মশার কামড়ে আক্রান্ত হয়ে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যাও বাড়ে।
বুধবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে পাঠানো করোনা বিষয়ক নিয়মিত সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, গত ২৪ ঘণ্টায় করোনাভাইরাসে দেশে আরও পাঁচজন মারা গেছেন। তাদের নিয়ে এখন পর্যন্ত ২৯ হাজার ২৮০ জনের প্রাণ কেড়ে নিল ভাইরাসটি। এরই মধ্যে স্বাস্থ্য অধিদফতরের ‘হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুম জানাচ্ছে, গত ২৪ ঘণ্টায় দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ডেঙ্গু আক্রান্ত ৯৯ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এরমধ্যে একজন মারাও গেছে।
জানা গেছে, চলতি বছরে বাংলাদেশে সরকারি হিসাবে দুই হাজার ৩০৫ জন মানুষ ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ১ হাজার ২১৬ জনই ভর্তি হয়েছেন বর্ষার শুরুর পর জুলাই মাসের প্রথম ২৬ দিনে। এই হিসাবের পঞ্চাশ শতাংশ মানুষ আক্রান্ত হয়েছে জুলাই মাসে।
রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতাল ঘুরে দেখা যায়, জুন মাসের থেকে জুলাই মাসে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব কিছুটা বেশি। প্রচণ্ড মাথা ব্যাথা, জ্বর, কাশি নিয়ে যাত্রাবাড়ি, জুরাইন, কেরানীগঞ্জ থেকে অনেকেই এসে ভর্তি হয়েছেন স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ মিটফোর্ড হাসপাতালে।
‘মা’গো এই জ্বর আর ব্যাথা সহ্য করতে পারি না। গায়ের ব্যাথায় আর বমিতে কেমুন কেমুন জানি লাগে।’ এইভাবে আর্তনাদ করে কথাগুলো বলছিলেন রাজধানীর মুগদা এলাকার বাসিন্দা আলেয়া বেগম। চারদিন ধরে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে ভর্তি হয়েছেন রাজধানীর স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ মিটফোর্ড হাসপাতালে।
পাশের বেডেই রয়েছে নয় বছর বয়সী শিশু পার্থ। কমলাপুরে দুই বোন আর বাবা-মার সাথে থাকে পার্থ। স্কুল শেষে এলাকার আশেপাশের মাঠে খেলতে পছন্দ করে সে। পরিবারের সদস্যরা জানায়, বাসায় মশা আছে আর তাই মশারি টানাই। কিন্তু ছোট মানুষ নানান জায়গায় যায়। কোথাও থেকে হয়তো মশা কামড়াইছে তাই জ্বর আসছে। প্রথমে বুঝতে পারিনি, মনে করেছিলাম সাধারণ জ্বর। কিন্তু চার দিনেও জ্বর না কমায় হাসপাতালে নিয়ে আসি। পরীক্ষা করে জানতে পারি, ডেঙ্গু হয়েছে।
জ্বর, সর্দি, কাশি, মাথা ব্যাথা নিয়ে ভর্তি হতে আসা রোগীদের স্বজনরা জানায়, বাসার আশেপাশে থেকে হয়তো মশা কামড়াইছে। যেহেতু বর্ষা মৌসুম সেহেতু ডেঙ্গু হতে পারে এমন ধারণা থেকে হাসপাতালে এসেছে।
মিটফোর্ড হাসপাতালের পরিচালক ব্রি. জে. কাজী মো. রশীদ-উন-নবী দ্য রিপোর্ট ডট লাইভকে জানান, চলতি মাসে ২-৩ জন করে ডেঙ্গু উপসর্গ নিয়ে রোগী ভর্তি হচ্ছে। এবার বৃষ্টি তুলনামূলকভাবে কম তবুও নগরবাসীর সতর্ক থাকা উচিত। বাসায় যেনো মশা না কামড়ায় সেই ব্যবস্থা নিতে হবে। আর বাইরেও সাবধান থাকতে হবে। কারণ করোনায় ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়লে কন্ট্রোল করা একটু মুশকিল হবে।
এ বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সংক্রামক রোগ বিভাগের পরিচালক নাজমুল ইসলাম দ্য রিপোর্ট ডট লাইভকে জানান, ডেঙ্গুর এ পরিস্থিতি আমাদের জন্য সতর্কবার্তা। বর্ষার মৌসুমে ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়ে ফলে নগরের প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ করে যাচ্ছে। তবে এই নাগরিক সমস্যায় নগরবাসীকেও সচেতন হতে হবে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ বলেন, এ বছর দেশে ডেঙ্গুর প্রকোপ ভয়াবহ না-ও হতে পারে। সমন্বিত কার্যক্রম গ্রহণের মাধ্যমে এডিসবাহিত রোগসমূহ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে।
এদিকে শহরের বাসা বাড়ির ছাদ বাগানে পানি জমে মশার প্রজনন ক্ষেত্র হয়েছে কিনা তা দেখতে ড্রোন ব্যবহার করে জরিপ চালাচ্ছে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন। ২০ জুলাই থেকে ডেঙ্গু বিরোধী সচেতনতামূলক প্রচার অভিযান শুরু করেছে উত্তর সিটি।
আর দক্ষিণ সিটি স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তারা দাবি করছেন গত মার্চ মাস থেকে ডেঙ্গু নিধনের কার্যক্রম চলছে তাদের আওতাধীন প্রতিটি অঞ্চলের ওয়ার্ডগুলোতে বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষকে নিয়ে ডেঙ্গুর বিষয়ে পরামর্শ সভার কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। পাশাপাশি বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের নিয়ে সচেতনতামূলক সভা করে সচেতন করার কাজটি চলমান রয়েছে।
ডেঙ্গুর প্রকোপ বেড়ে যাওয়ায় নিয়মিত মশক নিধন কার্যক্রমের পাশাপাশি ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন কর্তৃপক্ষ ডেঙ্গু সম্পর্কিত যে কোন তথ্য ও পরামর্শের জন্য নিয়ন্ত্রণ কক্ষ চালু করেছে। বিনামূল্যে ডেঙ্গু পরীক্ষার স্থান ও ডেঙ্গুজ্বর সম্পর্কিত যেকোনো তথ্য বা যেকোনো অভিযোগ জানাতে নিয়ন্ত্রণ কক্ষে ফোন করে জানতে পারবেন নগরবাসী।
দুই দশকের বেশি সময় ধরে দেশে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব চলছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ২০০০ সাল থেকে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ও মৃত্যুর বছরভিত্তিক তথ্য রাখছে। তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ২০০০ সালে ডেঙ্গুতে মারা গিয়েছিল ৯৩ জন। এর পরের দুই বছর যথাক্রমে ৪৪ ও ৫৮ জন মারা যায়। ২০০৭ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত টানা চার বছর ডেঙ্গুতে কোনো প্রাণহানি হয়নি।
২০১৯ সালে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা এর আগের সব বছরের রেকর্ড ছাড়ায়। বিভিন্ন গণমাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ সালে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে প্রায় ৩০০ জনের মৃত্যু হয়। তবে সরকারি হিসাবে মৃতের সংখ্যা ১৭৯।
গত ২১ বছর ধরে দেশে ডেঙ্গুর সার্বিক বিষয় নিয়ে তথ্য জানাচ্ছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। তবে মূলত ২০১৯ সালে ডেঙ্গুর প্রকোপ মারাত্মক আকার ধারণ করে। সেই বছর এক লাখের বেশি মানুষ ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়। মারা যায় ১৭৯ জন।