দিন যত গড়াচ্ছিল, স্বাধীনতাকামী বাঙালির ঐক্য ততই সুদৃঢ় হচ্ছিল। বঙ্গবন্ধুর উদাত্ত আহ্বানে চলমান অসহযোগ আন্দোলনের সঙ্গে নিবিড়, প্রত্যয়, দৃঢ় একাত্মতা ঘোষণা করছিল স্বাধীনতাকামী বিভিন্ন ব্যক্তি, দল, সংগঠন। অসহযোগের একপর্যায়ে পূর্ব পাকিস্তান (বর্তমান বাংলাদেশ) পুরোপুরি অচল হয়ে পড়ে।
১৩ মার্চ বিভিন্ন স্থানে কৃষক, শ্রমিক, চাকরিজীবী, সাংবাদিক, সাহিত্যিক, লেখক ও শিক্ষকসহ সব শ্রেণি-পেশার মানুষের আন্দোলন চলছিল। এদিন সামরিক কর্তৃপক্ষ ১১৫নং সামরিক আদেশ জারি করে ১৫ মার্চ সকাল ১০টায় প্রতিরক্ষা বিভাগের বেসামরিক কর্মচারীদের কাজে যোগদানের নির্দেশ দেয়। এ নির্দেশনায় বলা হয়, নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কাজে যোগদানে ব্যর্থ হলে সংশ্লিষ্টদের চাকরিচ্যুত ও পলাতক ঘোষণা করে সামরিক আদালতে বিচার করা হবে। নির্দেশ অমান্যকারীদের সর্বোচ্চ ১০ বছর পর্যন্ত সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হবে।
সামরিক নির্দেশ জারির পরপরই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একটি বিবৃতি দেন। বিবৃতিতে তিনি বলেন, যখন আমরা সামরিক শাসন প্রত্যাহারের জন্য বাংলার জনগণের দাবির কথা ঘোষণা করেছি- ঠিক তখন নতুন করে এ ধরনের সামরিক নির্দেশ জারি পক্ষান্তরে জনসাধারণকে উসকানি দেওয়ার শামিল।
এদিন সকালে করাচি থেকে বিমানে ঢাকায় আসেন ন্যাপের সভাপতি খান আবদুল ওয়ালী খান ও ন্যাপ নেতা গাউস। বিমান থেকে নেমে ন্যাপ প্রধান বলেন, বর্তমান সংকট উত্তরণের লক্ষ্যে আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে আলোচনার জন্য আমি খোলা মন নিয়ে ঢাকায় এসেছি। সামরিক শাসন প্রত্যাহার ও নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর প্রশ্নে আমি তার সঙ্গে একমত।
চট্টগ্রামে বেগম উমরতুল ফজলের নেতৃত্বে অনুষ্ঠিত মহিলাদের এক সমাবেশে বাংলাদেশের জনগণের পরিপূর্ণ মুক্তি অর্জন না হওয়া পর্যন্ত বিলাস দ্রব্য বর্জন ও কালো ব্যাজ ধারণের জন্য নারী-পুরুষ সবার প্রতি আহ্বান জানানো হয়। পাকিস্তান সরকারের দেওয়া খেতাব ও পদক বর্জন করেন প্রখ্যাত চিত্রশিল্পী জয়নুল আবেদিন ও সাবেক জাতীয় পরিষদ সদস্য আবদুল হাকিম। ঢাকার জাতিসংঘ ও পশ্চিম জার্মান দূতাবাসের কর্মচারী ও তাদের পরিবারসহ ইতালি, ফ্রান্স, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও কানাডার ২৬৫ জন নাগরিক বিশেষ বিমানে পূর্ব পাকিস্তান ত্যাগ করেন।
এদিন স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতারা এক যুক্ত বিবৃতিতে বাংলাদেশ ত্যাগকারীদের বাড়ি-গাড়ি-সম্পদ কিনে বাংলার অর্থ বিদেশে পাচারে সহযোগিতা না করার জন্য জনসাধারণের প্রতি আহ্বান জানান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকবাল হল (শহিদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হল) প্রাঙ্গণে পরিষদের সব আঞ্চলিক শাখার আহ্বায়ক, সম্পাদক ও সদস্যদের সভা আহ্বান করা হয়। ছাত্র ইউনিয়ন, সিএ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ, নৌ পরিবহণ, ডক, পাট ও সুতাকলের শ্রমিক সংগঠনগুলো মিছিল-সমাবেশ করে অসহযোগ আন্দোলনে পূর্ণ সমর্থন জানায়। সন্ধ্যায় সাবেক জাতীয় পরিষদ সদস্য আফাজউদ্দিন ফকির এক বিবৃতিতে ‘লেটার অব অথরিটি’ দ্বারা ক্ষমতা হস্তান্তর করার জন্য প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার প্রতি আহ্বান জানান। তিনি অবিলম্বে পূর্বাঞ্চলের প্রতিরক্ষা বাহিনী পরিচালনার দায়িত্ব একজন বাঙালি জেনারেলের কাছে হস্তান্তর, বেঙ্গল রেজিমেন্টের সবকটি ব্যাটালিয়নের পরিচালনার কর্তৃত্ব বাঙালি অফিসারদের হাতে অর্পণ এবং এক মাসে পূর্ব বাংলায় যে অতিরিক্ত পাকিস্তানি সৈন্য আনা হয়েছে তাদের প্রত্যাহারের দাবি জানান।